কলকাতায় এখন আছে ইহুদি ইতিহাস

সিনাগগ 

 এসপ্ল্যান্ড ম্যেনশেন কথা বলতে গিয়ে, কে বানিয়েছেন সেই বাড়ি সে কথা বলেছি এও বলেছি তিনি ছিলেন একজন ইহুদি। কিভাবে ইহুদী জনগোষ্ঠীর কলকাতায় এসেছিলো সেই বিষয়ে আলোচনা করবো। Wikipedia অনুযায়ী অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আলেপ্পা বাগদাদ থেকে ইহুদী সম্প্রদায়ের বণিকরা ভারত তথা কলকাতায় আসতে শুরু করেছিলেন। জানা যায় তখন কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল এবং অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল কলকাতা। কলকাতার প্রথম ইহুদী নাগরিক ছিলেন শালোম ওবাদিয়া কোহেন। ইনি সুরাটে বাণিক হিসেবে ভালো নাম করেছিলেন এবং তার পর কলকাতায় ব্যবসা করতে এসেছিলেন 1798 সালে। শালোম ওবাদিয়া কোহেনের ভাগ্নে ও কলকাতা চলে আসেন, এরপর অনেক ইহুদী সম্প্রদায়ের মানুষজন কলকাতায় চলে এসেছিলেন আর উল্লেখ করা বিষয় হলো বেশিরভাগ ইহুদীরা ছিল আলেপ্পার আর কোহেন ও আলেপ্পায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 

বলা হয় দাউদ পাশার অত্যাচারে ইহুদী সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি ত্যাগ করে প‌ৃথিবীর বিভিন্ন যায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, জানা যায় উনিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতায় ইহুদীদের সংখ্যা ছিল এক হাজার আটশ। ইহুদীরা কলকাতায় অনেক বড় বড় ব্যাবসার সাথে যুক্ত ছিল, জানা যায় B.N. Elias ইহুদী সম্প্রদায়ের একজন বড় ব্যাক্তিত্ব যার নামে ভারতের অনেক বড় বড় কারখানা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল আগরপারা জুটমিল।

এমনকি ন্যাশেনল টোবাকো কোম্পানী এই পরিবারের ছিল। ডালউসি এলাকায় এই পরিবারের রিয়েলস্টেট এর অফিস ছিল। এসপ্ল্যান্ড ম্যেনশেন এর কথা আগেই একটা ব্লগে বলেছি। তবে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর কলকাতার ইহুদীরা কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি চিহ্ন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিনাগগ, জানা যায় কলকাতায় মোট পাঁচটি সিনাগগ রয়েছে, তাদের মধ্যে তিনটি সিনাগগ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বলে রাখা দরকার সিনাগগ হলো ইহুদী ধর্মালম্বিদের উপাসনালয়। আসলে যখন কলকাতায় অনেক ইহুদী বসবাস করেছিলেন সেই সময় তাদের উপাসনালয় অর্থাৎ সিনাগগ তৈরি হয়েছিল, যার নামে কলকাতার এজার স্ট্রিট মানে জোসেফ এজরা ও ইজেকিয়েল জুহাড কলকাতার পোলাক স্ট্রিটে 1855 সালে তৈরি করেন বেথ এল সিনাগগ।

বেথ এল সিনাগগ

জোসেফ এজরা


বেথ এল সিনাগগ এর ভেতরে ঢুকে দেখা যাবে নিল সাদা রং এর ছটা, প্রথম থেকেই এরকম সাজানো হয়েছে এই সিনাগগ টিকে।

এই সিনাগগ টির জানালায় রয়েছে লাল, নিল ও সাদা কাঁচ। এই সিনাগগ এর আধ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে আর একটা সিনাগগ, এই সিনাগগটি লাল ইটের তৈরি এবং এই ভবন টির উপরে রয়েছে একটি ঘড়ির টাওয়ার, ব্রেবোন রোডের উপর এই সিনাগগ টি তৈরি করেছিলেন ইলিয়াস ডেভিড জোসেফ এজরা তার বাবা জোসেফ এজরার স্মৃতির উদ্দেশ্যে। 

ম্যাগান ডেভিড সিনাগগ
ইলিয়াস ডেভিড জোসেফ এজরা


1884 সালে এই সিনাগগ টি তৈরি করেছিলেন তিনি, আগেই বলেছি এই সিনাগগ টি লাল ইটের তৈরি, জানা যায় ঐ ইট গুলি নাকি ইতালির রেনেসাঁ আদলে তৈরি করা হয়েছে ছিল। এই সিনাগগটির ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়বে ইতালিয় রেনেসাঁ কারুকার্য খচিত খিলান, জানা যায় প্যারিস থেকে ফুলের নকশা যুক্ত পিলার আনা হয়েছিল। সিনাগগ ঝাড়বাতি গুলি অত্যন্ত সুন্দর এবং বলা হয় ঝাড়বাতি গুলি শুধু মাত্র কাঁচের নয়, ঝাড়বাতি গুলির কাঁচ মধ্যে সউক্ষ ভাবে ধাতব খোদাই করা রয়েছে। সিনাগগ গুলির জানালা গুলিতে নান রঙের কাঁচের ব্যাবহার হয়েছে, যার ফলে বাইরে থেকে রোদের আলো ভেতরে প্রবেশ করলে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। হলের মাঝখানে একটা উঁচু জায়গা আছে, এখানে ইহুদী পুরোহিতরা পার্থনা করেন। ইহুদী পুরোহিত কে বলা হয় রাবাই। হলের শেষ প্রান্তে রয়েছে গ্যালারির মতো একটি জায়গা এখানে একটু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়, এই জায়গাটি কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা এই কাঠের রেলিং কারুকার্য করা হয়েছে। তিনটি দরজা রয়েছে এখানে আর এই দরজা ভেতর রয়েছে ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ 'তোরা'। তোরা হলো ইহুদি ধর্মশাস্ত্রের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থের সমাহার, এখানে বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। এর উপরেই রয়েছে অর্ধ গোলাকৃতি গম্বুজ।

 


তিনটি দরজার মাঝখানের দরজার উপরে রয়েছে ইহুদিদের প্রতিক মেনোরা বা বাতিদান আর মাগেন ডেভিড। মেনোরা-র পাশে থাকে ছটি মুখের তারা। একে বলে মাগেন ডেভিড বা ইহুদি শিল্ড অব ডেভিড। এই ছয় মুখের তারার অর্থ, ঈশ্বর পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ উপর এবং নীচ— এই ছয় দিক দিয়ে ভক্তকে রক্ষা করেন। মাঝখানের দরজার উপরে রয়েছে টেন কম্যান্ডমেন্টস। 613টি নির্দেশ এর মধ্যে প্রথম দশটি নির্দেশ ইহুদিরা পালন করে, এমনকি দরজা পর্দা তে এই দশটি নির্দেশ মানে টেন কম্যান্ডমেন্টস রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে একমাত্র বেথ এল সিনাগগে একমাত্র ইহুদিদের বিবাহ ও বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

জানা যায় বেথ এল সিনাগগ তৈরি করতে খরচ হয়েছিল লাখ টাকা। সিনাগগ দোতলা হয় কারণ দোতালার ব্যালকনির মতো জায়গা রয়েছে যেখানে ইহুদি মহিলারা পার্থনা করে। বেথ এল কথার মানে হল ঈশ্বরের ঘর। তৃতীয় সিনাগগ হল নেভেহ শালোম, এই সিনাগগটি সবচেয়ে পুরনো সিনাগগ। কিন্তু এটি আর দেখা যায় না। 1831 সালে এই সিনাগগ টি তৈরি হয়েছিল, ইহুদিদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এই সিনাগগ টি ভেঙে ফেলে তার জায়গায় ম্যাগেন ডেভিড পথ প্রস্তুত করা হয়।

নেভেহ শালোম সিনাগগ 

কিন্তু 1910 সালে কলকাতা ইহুদি একসাথে হয়ে নেভেহ শালোম পুনরায় তৈরি করা হয়। 

কলকাতায় ইহুদিদের সমাধিস্থল


কলকাতায় এখনো রয়েছে ইহুদিদের সমাধিস্থল। কলকাতার প্রথম ইহুদি নাগরিক ছিলেন শালোম ওবাদিয়া কোহেন সেই কথা আগেই উল্লেখ করেছি কিন্তু, কোহেন সাহেব আসার পর পরই ইহুদিরা কলকাতায় আসতে শুরু করেন। এবার কথা ইহুদিদের কেই যদি মারা যায় তাহলে তাকে কোথায় সমাধিস্থ করা হবে! কোহেন সাহেব তার পরিচিত এক বাঙালি ব্যবসায়ী বন্ধু কে বলেন যে, আমাকে একটা যায়গা দিতে পারবে? সেই বাঙালি ভদ্রলোক আজকের ফুলবাগান ক্রসিংয়ের কাছে যায়গাটি দেখিয়েছিল। কোহেন সাহেবের পছন্দ হলো যায়গা আর বললেন, এই জমির দাম কত ? ঐ ভদ্রলোক বললেন দামের কোনো দরকার নেই এই জমি তোমাকে দিলাম। কিন্তু কোহেন সাহেব তো নারাজ, বিনামূল্যে এই জমি তিনি নেবান না। কারণ এই জমি তিনি নিজের তো নিচ্ছেন না, এই জমি তো ধর্মের কাজে লাগবে। অবশেষে সেই ভদ্রলোক বললেন তোমার যা ইচ্ছা তাই দাও, কোহেন সাহেব তার হাত থেকে একটি সোনার আংটি খুলে দিলেন। এতক্ষন যেই জমির কথা বললাম সেটাই হলো ফুলবাগান ক্রসিংয়ের কাছে 45 নারকেলডাঙ্গা মেন রোড যেখানে রয়েছে ইহুদিদের সমাধিস্থল। জানা যায় 1812 সালের পয়লা জানুয়ারি প্রথম কলকাতায় ইহুদি সম্প্রদায়ের হাসাম মুসাকে সমাধিস্থ করা হয়। এখানে বলে রাখা দরকার শালোম ওবাদিয়া কোহেন এর সমাধি এখানে আর খুঁজে পাওয়া যায় না এমনকি, কিছু দূরে 24 ইউ সি ব্যানার্জি রোডের ইহুদি সমাধিস্থলে কোহেন সাহেব এর সমাধি খুঁজে পাওয়া যায় নি।

সেই প্যাভিলিয়ন


 এই সমাধিস্থলে অনেক সমাধি রয়েছে। এই সমাধিস্থলে ঢুকতেই বাদিকে রয়েছে একটি প্যাভিলিয়ন সেইটা আবার এক সময়ে প্রার্থনালয় হিসাবে কাজ করতো, প্যাভিলিয়নের দেওয়ালে স্টার ওফ ডেভিড আছে আর একটি মার্বেল ফলকে লেখা রয়েছে এই প্যাভিলিয়নটি তৈরি করেছিলেন মিসেস গালা ডেভিড তার বাবা শৌল ডেভিড ল্যানিয়াডোর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এখানে একটি মার্বেল ফলকে উল্লেখ করা হয়েছে যে 1927 সালে সমাধি স্থলে জল এবং বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা করেছিলেন মিসেস ফ্লোরা ই. ই. এজরা। পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের সঙ্গে ইহুদি সমাধিস্থানের পার্থক্য রয়েছে, পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে গেলে দেখা যাবে সমাধি গুলি বিভিন্ন ভাবে সাজানো হয়েছে, কিন্তু ইহুদি সমাধিস্থলে এইরকম কিছু দেখা যায় না। তবে রঙ্গন দত্তের wordpress থেকে জানতে পারলাম পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের সঙ্গে ইহুদি সমাধিস্থলের একটা মিল রয়েছে, দুই সমাধিক্ষেত্র অনেক শিশুদের কবর রয়েছে। এমনকি ইহুদি সমাধিস্থলে তো কয়েকটি কবর তো এক ফুটেরও কম, এইটা সত্যি খুব দুঃখজনক। এখানে একটি 15 ফুট উঁচু একটি টাওয়ার রয়েছে, একে বলা হয় জেনিজাহ টাওয়ার। এটি জোসেফ রাহামিন জুডাহের সম্মানে তার স্ত্রী এবং ছেলেরা তৈরি করেছিল তার সমাধির উপর এই টাওয়ার।

সেই টাওয়ার 

 এইখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইহুদি রিতী অনুযায়ী হীব্রু ভাষায় কোনো কিছু লেখা কোন কাগজ বা বই ফেলে দেওয়া যায় না, এগুলো কে সাধারণত সিনাগগের গোপন যায়গায় রেখে দেওয়া হয়। যাতে সঠিক সময়ে সেগুলোকে নিয়ম মেনে নিস্পত্তি করা হয়। যেখানে এগুলো কে রাখা হয় তাকে বলা হয় "জেনিজা" এই জেনিজা শব্দটি এসেছে প্যারসের মূল শব্দ "গঞ্জ" এর মানে হচ্ছে ভান্ডার। এখানে উল্লেখ্য যে কলকাতার কয়েকটি যায়গা যেমন টালিগঞ্জ আর বালিগঞ্জ। ভাবতে অবাক লাগে একটি যায়গার নামকরণ কত ইতিহাস। যাইহোক আবার মুল বিষয় ফেরা যাক, ইহুদি সমাধিস্থলে একটি পাঁচ ফুটের ছোট্ট টাওয়ার আছে। এই টাওয়ারটি হিব্রু ও ইংরেজি লেখা রয়েছে দানে কথা। আসলে এটি একটি দানপাত্র, কাউকে সমাধি দেওয়া পর যে যার ইচ্ছে মতো এখানে দান করেন আর প্রতিবছর এই দান সংগ্রহ করে গরীবের দেওয়া হয়।


 এই ইহুদি সমাধিস্থলে নাহুমের সমাধি রয়েছে, আশা করি নাহুমকে চিনিয়ে দিতে হবে না। 2017 সালের আগে এই ইহুদি সমাধিস্থল ঝোপ জঙ্গলে ভরা ছিল কিন্তু এখন এখানে গেলে দেখা যাবে সুন্দর ভাবে এই সমাধিস্থল চলছে, ঝোপ জঙ্গল নেই।

সমাধি গুলির সংস্কার করা হয়েছে। 

এই সবকিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কলকাতা।


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://www.peepultree.world/livehistoryindia/story/living-culture/kolkatas-jewish-legacy

 https://rangandatta.wordpress.com/2014/11/19/jewish-cemetery-kolkata-calcutta/






  

Comments