ভুলে যাওয়া ম্যাকডোনেল !ফোয়ারা

ম্যাকডোনেল ফাউন্টেন 


 

আমাদের কলকাতা শহরে রয়েছে এমন এক যায়গা কিংবা স্মৃতি সৌধ যা কিনা বারবার মনে করিয়ে দেয় ঔপনিবেশিক শাসনের কথা। অনেক কিছু রয়েছে যেগুলো স্মৃতির আড়ালে চলে গেছে আবার অনেকে যায়গা রয়েছে যেগুলো সবসময় মানুষের মনে গেঁথে গেছে যেমন এই শীতের শহরে বার বার মনে পড়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান শুনেছি পুকুর বুজিয়ে ব্রিটিশরা আজকের ময়দান সৃষ্টি করেছিল। সে যাই হোক, ঐ তর্কে নাইবা গেলাম। কিন্তু জানেনই তো আমাদের কলকাতা শহরকে ব্রিটিশরা ভারতের প্রথম রাজধানী করেছিল। তারা ঠিক করেছিলেন কলকাতাকে লন্ডনের মতো গড়ে তুলবেন, সেই জন্য কলকাতার রাস্তায় ফোয়ারা গড়ে তোলা হয়েছিল একটি ফোয়ারা কথা আগেই বলেছি সেইটা হলো প্যানিওটি ফোয়ার। সেইটা এখন আছে ধর্মতলার কার্জন পার্কে দুঃখের বিষয় এখন সেই ফোয়ারা আর কাজ করে না। সেই রকম আর এক ফোয়ারা রয়েছে কলকাতায়। সেই ফোয়ারা নাম হলো ম্যাকডোনেল ফোয়ারা। কলকাতার হাইকোর্টের কাছেই টাউন হলের বিপরীতে রয়েছে এই ফোয়ারাটি। এই ফোয়ারাটির নাম কেন ম্যাকডোনেল সেই বিষয়ে এবার আলোকপাত করা দরকার, এই ফোয়ারাটির নামকরন করা হয়েছে উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেলের নাম অনুসারে, Wikipedia তে বলা হয়েছে ম্যাকডোনেল সাহেব 1829 সালের ডিসেম্বর মাসে 17 তারিখে জন্মগ্রহণ করে এবং 1894 সালের 31 জুলাই 64 বয়সে তার মৃত্যু হয়। 27 বছর বয়সে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে বেসামরিক পদে যোগদেন। টেলিগ্রাফ পত্রিকার একটি খবর অনুযায়ী ম্যাকডোনেল সাহেব 1850 সালে বিহারের সারান জেলার সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগ এবং 1855 সালে বিহারের ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল। আর দুবছর পর শুরু হয় ভারতের প্রথম স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ অথবা সিপাহী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে ম্যাকডোনেল সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে। 1857 সালের মহা বিদ্রোহের আঁচ পৌঁছেছিল বিহারেও, ম্যাকডোনেল সাহেব ও চেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে অস্ত্র ধরতে। সেই সুযোগ এসেছিল তার কাছে, বিহারের ভোজপুরে আগের নামছিল শাহবাদে পোস্টিং ছিলো ম্যাকডোনেল সাহেবের।

উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল


 1857 সালের জুলাই মাসের 30 তারিখে ম্যাকডোনেল সাহেব ব্রিটিশ নাগরিক এবং সৈনিকদের ত্রাণ পার্টিতে যোগদান করে। বিহারের আররাহ তে ম্যাকডোনেল সাহেব নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার সঙ্গে ছিল বাবু কুনুয়ার সিংহ। ম্যাকডোনেল সাহেবের যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সেপাইদের সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই করার, কিন্তু ম্যাকডোনেল সাহেব এবং তার সৈনরা পিছুহঠটতে বাধ্যহন। সেই সঙ্গে মৃত্যু হয় ম্যাকডোনেল সাহেবের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন চার্লস ডরবারের। ম্যাকডোনেল সাহেব ও তার কোম্পানি পিছুহঠে এসে পৌঁছায় গঙ্গার একটি উপনদী শোণ নদীর তীরে। নদীর ধারে একটি নৌকা দাঁড়ানো ছিল সেই নৌকায় উঠে পড়ে ম্যাকডোনেল সাহেব ও কোম্পানি। তখন ম্যাকডোনেল সাহেবের সাথে ছিল পঁয়েত্রিশ জন। যতক্ষণ তারা নৌকায় ছিল বাইরে থেকে সিপাহীরা সেই নৌকাটিকে ঘিরে রেখেছিল, এবং সেই সঙ্গে নৌকার উপর চলেছিল মাস্কেটের গুলি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ নৌকায় টিকে থাকা যাবে না। কিন্তু নৌকা তো চলছেই না আসলে নৌকার রডারের শিকল বাঁধা ছিলো তারা খুলতে ভুলতে গেছিলো। ম্যাকডোনেল সাহেব নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে, কারণ সেইসময় নাকি সিপাহীদের গুলি চলছিল এবং আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল নৌকায়। সামান্য একটা ছুরি নিয়ে নৌকার শিকলে বাড়ি মারতে শুরু করে, অবশেষে শিকল ভাঙ্গে, এবং নৌকা চলতে শুরু করে। ম্যাকডোনেল সাহেব এইভাবে পঁয়েত্রিশ জনের প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন। 1860 সালে উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল কে ভিক্টোরিয়া ক্রস দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। জানা যায় 167 বছরের ইতিহাসে মাত্র সাত জন নাগরিক এই ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন তার মধ্যে ম্যাকডোনেল সাহেব ছিলেন দ্বিতীয় ব্যাক্তি। উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল সাহেবের এই ভিক্টোরিয়া ক্রস টি দেখাযায় লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামে।

সেই মেডেল 

খবরের কাগজে সাহেবের নাম 


 ম্যাকডোনেল সাহেবে আবার ভারতে ফিরে আসেন, এইবার তিনি নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রট পদে যোগদেন। এরপর তিনি আবার বিহারের তৎকালীন পাটনা জেলার বিচারপতি নিয়োগ হন, এরপর তিনি কলকাতা হাইকোর্টে নিয়োগ হন এবং 1886 সাল অবধি কলকাতা হাইকোর্টেই বিচারপতি ছিলেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ড ফিরে আসেন এবং চ্যাটেলহাম কলেজ গভর্নর হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং 1894 সালে নিমুনিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। এই ছিলো ম্যাকডোনেল সাহেবের কথা। 

ম্যাকডোনেল সাহেবের সমাধি 


এবার বলি সেই ফোয়ারা কথা, 1966 সালে ডেসমন্ড ডয়েগ দ্যা স্টেসম্যান পত্রিকায় একটি সিরিজ শুরু করেছিলেন কলকাতার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহি মনুমেন্টদের নিয়ে, তিনি নিজেই মনুমেন্ট গুলির ছবি ইলেস্ট্রেড করেন। সেখানে তিনি এই ফোয়ারাটির অবস্থা দেখে খুব হতাশ হয়েছিলেন কারণ ফোয়ারাটির অবস্থা এখন অব্দি শোচনীয় হয়ে আছে।

পাশাপাশি ম্যকডোনেল ফাউন্টেন আঁকা ছবি এবংম্যকডোনেল ফাউন্টেন 

A sketch of the fountain as seen in Desmond Doig’s 1966 book, ‘Calcutta: An Artist’s Impression’


 ডেসমন্ড ডয়েগ বলেছেন “Only dismantling the fountain completely could have done more to hide it from view.” এখন 2024 গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে কিন্তু এখন শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এই ফোয়ারা। জানা যায় ব্রিটিশরা এখনকার মুম্বাই তখনকার বম্বেতে এই ধরনের একটি ফোয়ারা যার নাম হলো ফ্লোরা ফাউন্টেন তৈরি করেছিল। সেটি এখনো সমহিমায় কাজ করছে এবং মুম্বাই তে এই ফ্লোরা ফাউন্টেন বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক।

মুম্বাই এর ফ্লোরা ফাউন্টেন 


 হ্যাঁ আমাদের ভাগ্য খারাপ ফোয়ারা টি আছে কিন্তু সেখান থেকে আর জল বেরয় না। অনেকটা ভেঙে ও গেছে। এই ভিক্টোরিয়ান যুগের ফোয়ারাটিতে নিও গ্যাথিক কাজ রয়েছে। ফোয়ারাটির দুপাশে ফুলের নকশা রয়েছে। 

সাইডে ফুলের কাজ


ফোয়ারাটির উপর দিকে ছোট একটি গ্রীক মন্দিরে নকশা রয়েছে ঠিক তার নিচে মানে মাঝখানে রয়েছে একটি মার্বেলের পাথরে ফলক জানা যায় এককালে ওখানে লেখা ছিল “manly rectitude and kindly disposition” কিন্তু এখন সেই লেখা আর দেখা যায় না মার্বেল ফলকে । ঠিক তার নিচে রয়েছে গার্গোয়েল স্টাইলের সিংহের মাথা।

সেই সিংহ 


 এই সিংহের মাথা থেকেই জল বের হত, আর এই জল ধরে রাখার জন্য ফোয়ারা দুপাশে দুটো পেতলের পাত্র থাকতো সেখান থেকে ঘড়া জল খেত বলে জানা যায়। তবে এখন দেখলে সেটা আর বোঝার উপায় নেই। কিন্তু জানেন আর সব সৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভে একটি জিনিস প্রায় দেখা যায় যেই ব্যক্তিকে স্মৃতির উদ্দেশ্যে সৌধটি তৈরি হয়েছে তার জন্ম এবং মৃত্যুর বছর, কিন্তু এই সৌধটিতে উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল সাহেবের জন্ম বা মৃত্যু সাল উল্লেখ নেই , এই ফোয়ারা একদিকে লেখা রয়েছে 1850 আর অন্য দিকে লেখা রয়েছে 1856.

Arrow সাহায্য দেখানো হয়েছে সেই সাল

এই ছবিটি তে আরো ভালো ভাবে বোঝানো হয়েছে 
ছবি সূত্র - The Concrete Paparazzi 

 এরমানে হলো ম্যাকডোনেল সাহেবে সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে এত বছর বাংলা কাজ করেছেন। যাওয়া আসার পথে চোখে পড়ে যেতেই পারে এই ফোয়ারা।  

 


 ছবি সূত্র - Internet

তথ্য সূত্র - https://www.telegraphindia.com/my-kolkata/places/a-forgotten-fountain-near-calcutta-high-court-that-celebrates-a-forgotten-man/cid/1912289


https://www.telegraphindia.com/my-kolkata/places/mcdonnell-fountain-at-dalhousie-square-a-gem-gathering-dust/cid/1839333

Comments