টেরেটি বাজারের চীনা মন্দির নাকি চার্চ

সি আই পি চার্চ 

 

ভারতের আর চীনের সম্পর্ক তৈরি হয় অনেক আগে থেকেই, যদি সময় মাপা যায় তাহলে তো সেই প্রাচীন যুগ থেকেই এই সম্পর্ক আরম্ভ হয়েছে। ইউ এন সাং ভারতে এসেছেন, ভারতীয় আদপকায়দা দেখেছেন এমনকি ভারতে তিনি থেকেছেন। তিনি ভারতে কে তার বইতে স্থান দিয়েছেন। এরপর যদি আসি তাহলে ব্রিটিশ ভারত কে ধরে নিয়ে চলতে হবে। কারণ ব্রিটিশ সরকার নিজেদের সুবিধার জন্য ভারত থেকে আফিম চীনে পাঠাতো অবশ্যই এর পর শুরু ব্রিটিশ চীন যুদ্ধ বলাই বাহুল্য যে ব্রিটিশ সরকার জিতেছিল। এর পরবর্তীকালে চীনের এক ব্যবসায়ী ব্রিটিশ সরকার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চিনির কল শুরু করেন সেই ব্যবসায়ী ছিলেন টং অছি। তার আসার ফলেই চীন থেকে অনেক মানুষ কলকাতায় আসা শুরু করেন। কিন্তু তার চিনির কল সাফল্য পায়নি এমনকি তার চীনা শ্রমিকরা কলকাতার টেরেটি বাজারে আসতে শুরু করেন। টং অছির কথা আগে একটি ব্লগে বলেছি তাই সেই কথায় আর গেলাম না। সেই সময় কলকাতায় চীনের নিজেস্ব বসতি তৈরি হয়ে গেছে, কলকাতার চীনরা ঠিক করেন যে নিজেদের একটি গ্রুপ বানাবেন এবং তার নাম ঠিক হয়ে যায়, তাদের গ্রুপ বলা হতো হুইগুয়ান অবশ্য অনেক একে মিটিং যায়গা বলে উল্লেখ করেছেন। এই গ্রুপের উদ্দেশ্য ছিল যে কোন জায়গায়টা থেকে কলকাতায় আসে তখনই তাদের সাহায্য করতে হবে যেমন যেমন দাঁতের ডাক্তার, কাঠের মিস্ত্রী কে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করা, এ ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের কাজ খুঁজে দেওয়া এমনকি তাদের বাড়ি খুঁজে দেওয়া এছাড়া রয়েছে বিছানা যোগার নতুন চীনা অধিবাসীদের জন্য। শুধু কী তাই, তাদের কেউ যদি মারা যায় তাদের তাঁর অন্ত্যস্টিক্রিয়া এই হুইগুয়ান দল করতো। কারণ সেই তাদের কোনো আত্মীয় স্বজন এই দেশে নেই যদি কেউ থেকে থাকে তার সংখ্যা ছিল খুব কমই, এমনকি এই দেশ থেকে চীনে তো মৃতদেহ পাঠানো সম্ভব ছিল না তাই হুইগুয়ান দল বা ক্লাব এই সবের দায়িত্ব নিত এবং মৃত ব্যক্তিদের সমাধি দিত এই গোষ্ঠী। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এখানে হুইগুয়ানদের নিজস্ব মন্দির ছিল। চীন থেকে বহু মানুষ কলকাতায় বসতি স্থাপন করেছে তার গোনা গুনি করলে দেখা যাবে মোট চারটি সম্প্রদায়ের মানুষ কলকাতায় বসতি গড়ে তুলেছিল, এখন মানে 2025 সালেও চীনা বসতি রয়েছে কলকাতায়। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চীনারা কিন্তু তাদের উপাসনালয় কে মন্দির বলে না, তারা বলে চার্চ। এর পিছনে বিভিন্ন করণ রয়েছে একটি কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে চীনা কমুনিটি জানিয়েছেন যে চীন থেকে ভারত তথা কলকাতায় এসে চীনারা দেখেছিল সব জায়গায় ব্রিটিশদের তৈরি বড়ো বড়ো সব চার্চ এখান সেখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছে,তাই তারা ঠিক করল যে তাদের উপাসনালয় কে চার্চ বলা হবে। তারা নিজেদের উপাসনালয় কে চার্চ বলেই ডাকবে বলে ঠিক করে। চীনাদের এই মন্দির বা চার্চ এর অন্যতম হলো সি আইপি চার্চ, এই চার্চটির কথা বলতে যাওয়া আগের চীনা কলকাতায় বসতি স্থাপন করে নিয়েছিলেন, প্রথমে তারা কাসাইতলার আসে পাশে উত্তরের দিকে পাকাপাকি ভাবে নিজের বসতি স্থাপন করে এই বাজারে নাম আগেই বলেছি, ঠিক ধরেছেন টেরেটিবাজার। এই জায়গায়র সঙ্গে ইতালির এক নাগরিক নাম যুক্ত, জানা যায় ইতালীয় নাগরিক স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাকারী এডুয়ার্ডো টাইরেটার, তার নামের সঙ্গে এই বাজারের নাম যুক্ত। এই টেরেকটি বাজারে চীনা শ্রমিক, চীনা দাঁতের ডাক্তার, চীনা ছুতোর ব্যবসায়ী নিজেদের ব্যবসা গড়ে তোলে। চীনা ডাক্তারদের আবার বলা হতো হুপাক। 1962 সাল চীন এবং ভারতের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, চীন ভারতের দখলে করে নিয়ে ভারতের বংশোদ্ভূত চীনাদের চীনের নাগরিক করে দেয়। অনেক চীনা মানুষ রাজেস্থানে নিজের ব্যবসা গড়ে তোলেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে টেরেটিবাজারের অনেক চীনা ক্লাব বা বিভিন্ন গ্রুপের নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র জ্বালিয়ে দেয়। এর ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা এবং চীনা চার্চের সাথে চীনা গ্রুপ বা ক্লাব কী সম্পর্ক সবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা পুঁড়ে যায়। তাই সি আই পি চার্চ ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয় সে বিষয়ে অস্পষ্ট ভাবে জানতে পারি, এই মন্দির বা চার্চ টি প্রতিষ্ঠিত হয় এগরা স্ট্রিটে আর এই চার্চটি প্রতিষ্ঠিত করে তৎকালীন জুতো প্রস্তুত কারকরা। 

চীনা খবরের কাগজ 


এটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 1882 সালে পরে স্থানবদল করা হয় তখন সাল ছিল 1905. চীনের চারটি জেলা থেকে আসা মানুষজন এই চার্চটি এবং একটি ক্লাব তৈরি করেছিল। এমনকি চার্চের নামের সঙ্গে একটি যোগাযোগ রয়েছে, জানা গেছে ক্যাটন ভাষায় সি এর মানে হলো চার। বর্তমানে এই চার্চের সঙ্গে পাঁচটি সম্প্রদায় এর সঙ্গে যুক্ত বলে আইপি যুক্ত হয়েছে, তবে এখন এই চার্চ বা মন্দির এর সঙ্গে অনেক চীনা সম্প্রদায়ে যুক্ত হয়েছে বলে এখানে দুটি উৎসব পালন করা হয়। একটি উৎসব হয় এপ্রিল মাসে আর একটা হয় জুন মাসে, কলকাতায় চীনের প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন সি আইপি চার্চে, দেখেছিলেন ড্রাগন নাচ। এই মন্দির বা চার্চে জুয়াড়িদের বড় আড্ডা হতো কিন্তু একদশক পর এই চার্চ টি নতুন করে রক্ষনাবেক্ষণ শুরু হয় এবং আইন অনুযায়ী জুয়া খেলা সম্পূর্ন রুপে বন্ধ হয়ে যায়। এই চীনা মন্দির বা চার্চটির নিচ তলার ঘরে বড় একটি বড় বোর্ড ঝুলানো আছে এখানে নাকি চীনা ভাষায় এই মন্দির বা চার্চের ইতিহাস লেখা আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠা হওয়ার দিন বা সাল লেখা নেই।সি আইপি ক্লাবটি সক্রিয় এবং চীনা সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে জড়ো হন, তাস খেলেন, ক্যারাম খেলেন, ধূমপান করেন এবং ট্যাংরা থেকে সাপ্তাহিকভাবে প্রকাশিত কলকাতার একমাত্র চীনা সংবাদপত্র পড়েন, যা এখন ট্যাংরা থেকে প্রকাশিত হয়, আর ঐতিহ্যমেনে কোন রাজার সময় এই মন্দির হয়ে আর কী কী তা লেখা রয়েছে সেই বোর্ডে। এখানে 1st ওঠার সময় দেখা যাবে, এই তলায় রয়েছে চীনা দেবী কোয়ান ইয়িন এর। 

কোয়ান ইয়িন


ইনি হলেন করুনার দেবী এই অংশটি লাল এবং হলুদ বা সোনার রঙের ব্যবহার বেশী এবং এর ছাদ টি ঢালু এবং এই ছাঁদ টি লাল রঙে সুসজ্জিত এমনকি এই অংশে ঢুকলে বোঝা যায় বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। এমনকি এখানে ইলেকট্রিক ঘন্টা রয়েছে, যার ফলে একবার সুইচ টিপলেই যতবার ঘটনা বাজার দরকার ততটুকু বাজবে। 

চার্চের ভিতরের ছবি


এর পাশে আরো এক চীনা দেবীর অবস্থান করছেন, ইনি হলেন সমৃদ্ধির চীনা দেবতা চোই সান তবে অনেকে মনে করেন ইনি হলেন পৃথিবীর দেবতা টুডিগং-এর একটি মূর্তি হিসেবেও চিহ্নিত করে। এর বা দিকে আরও একটি মন্দির রয়েছে এখানে রয়েছে চীনা যুদ্ধের দেবতা কোয়ান তি জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। সি আইপি মন্দির বা চার্চটির একটু দূরে রয়েছে আরও একটি মন্দির বা চার্চ যেখানে চীনের যুদ্ধের দেবতা কোয়ান তি র উদ্দেশ্য তৈরি করা হয় এবং দুই চার্চের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন যুদ্ধের অস্ত্র। সি আই পি চার্চে অনেক কাঠের আসবাবপত্র দেখা যায় অন্য চীনা মন্দির বা চার্চের মতো। বলা হয় এই কাজ গুলো নাকি একজন ব্যক্তি করেছেন। তিনি ছিলেন আথু্ নামের এক ব্যক্তি এই কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করেছেন, তিনি ছিলেন একজন শিল্পী। বলা সি আইপি চার্চে বেশিরভাগ জিনিস চীন থেকেই আনা হয়েছিল, সঙ্গে ছিল কোয়ান ইয়িন এর মূর্তি আরও জানা গেছে এই মন্দির বা চার্চটির ছাদিটি পর্যন্ত চীন থেকে আনা হয়েছিল।কিং রাজবংশের শেষ শাসক গুয়াংজু সম্রাট মন্দিরটিকে একটি উদ্ধৃতি পাঠিয়েছিলেন বলে জানা যায়, যা এখনও সি ইপের ভিতরে কোথাও থাকতে পারে। গুয়াংজু সম্রাটের উত্তরসূরি ছিলেন দুর্ভাগ্যজনক পু ই, যার সংক্ষিপ্ত রাজত্ব চীনে জাপানি আক্রমণের ফলে ব্যাহত হয়েছিল এবং অবশেষে কমিউনিস্ট বিপ্লবের দ্বারা শেষ হয়েছিল। মন্দিরের ছাদ থেকে ঝুলন্ত একটি বৃহৎ এবং সূক্ষ্ম কাঠের খোদাই যা দেখতে নৌকার মতো। এটি আসলে, শিল্পীর স্বর্গ ও পৃথিবীর ধারণা এবং একটি গাছের গুঁড়ি থেকে খোদাই করা হয়েছে। সি আই পি চার্চে যে করুনার দেবীর অবস্থান অর্থাৎ কোয়ান ইয়িন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে, এমনকি টেরেটি বাজারে এই প্রাচীন চীনা দেবী কে চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে পুজো করা হয়, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মে ইনি বারশো শতাব্দী অব্দি এনাকে পুরুষ দেবতা হিসেবে বলা হয়েছে। বৌদ্ধ অবলোকিতেশ্বরের আদলে বিকশিত হয়েছেন । অবলোকিতেশ্বর হলেন একজন বোধিসত্ত্ব যিনি সমস্ত বুদ্ধের করুণাকে মূর্ত করেছেন। কিংবদন্তি অনুসারে, কোয়ান ইয়িনকে স্বর্গে স্থান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা ত্যাগ করে মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য পৃথিবীতে থাকতে বেছে নিয়েছিলেন। তার পুরো নাম, গুয়ানশিয়িন, যার অর্থ "যিনি মানব জগতের কান্না দেখেন এবং শোনেন"। চীনা ধর্মের ব্যাপারে আসক্ত মানুষ এবং সাধারণ মানুষ কলকাতা এই চীনা মন্দির কে এখন মনে রেখেছে।

ছবি সূত্র - Internet 

তথ্য সূত্র - https://www.sid-thewanderer.com/2016/11/sea-ip-church-and-brief-history-of.html

Visit | Have you been to these Chinese temples of Old Chinatown in Kolkata? - Telegraph India https://share.google/xf1NW4qn1VRirp2xh

Comments