এই বাজারে নাম কখনো পাল্টেবে না!

টেলর কোম্পানির দোকান ঘর, নিলাম ঘর, লাল বাজার, কলকাতা, ১৮২৬

 

আমাদের কলকাতার অন্যতম প্রধান রাস্তা বা বলা ভালো জায়গা হলো লালবাজার। এখন অবশ্য বলা যেতে পারে লালবাজার হলো কলকাতার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু কথা হচ্ছে এই পুলিশ বাড়ির রঙ কিন্তু লাল, সেই জন্য কী জায়গাটার নাম লাল বাজার ? একদমই না। প্রায় দুশো বছর হয়ে গেল, জানা যায় 1850 সালে বেঙ্গল আগ্রা ডিকশনারি তে এই লাল বাজার রাস্তার উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে এখানে লাল বাজার ছিল না, ছিল লোল বাজার। অনেক বলে সেই সময় তৎকালীন কনসার্টবলদের পাগড়ির রঙ ছিল লাল আর তার থেকেই নাকি এই নাম। তবে এর থেকেই নামকরণ সেটাও বলা যাবে না, কারণ কোনো উপযুক্ত তথ্য নেই। আবার এখানে অনেকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে পারেন, কারণ অবশ্যই সেই সময় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের অনেক জায়গায় ছিল কলকাতায় বা বলা ভালো যে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পরিবার তাদের জমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে শাসন করার জন্য এবং সেই সঙ্গে একটা ইজারা পেত এই পরিবার। এই জায়গাটিতে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের হোলি বা দোলের দিন খুব করে হোলি খেলা হতো‌। জানা গেছে সেই সময় এই অঞ্চলে রঙের দোকান বসতো শুধু তাই নয় এই অঞ্চল হোলির রঙে রাঙা লাল হয়ে যেত। রঙের জন্য দিঘির জল ও লাল হয়ে যেত বলে এই দিঘি কে লাল দিঘি বলা এবং এখানে একটা বাজার বসে যেত সেখানে খালি রঙ বিক্রি হতো ঐ সময়ে‌। একই সঙ্গে এই কথা বলা হয়েছে যে এই উৎসবের জন্য লালবাজার রাস্তা ধরে নাকি রাজাবাজার স্ট্রিটের শুরু হয় এবং রাজাবাজারের জন্য নাকি শ্যামবাজারের স্ট্রিটের শুরু হয়। যদি ও এর কোন তথ্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

জেমস লং 

আবার অন্যদিক থেকে জানা যায়, রেভারেন্ড জেমস লং বলেছিলেন যে আসলে লালবাজার নামটা হয়েছে মিশন চার্চের মাধ্যমে আসলে তিনি বলেছিলেন চার্চের চূড়ার রঙ ছিল লাল আর তার থেকেই এই নাম। তবে এই তথ্যটি 1965 সালে অমৃত বাজার পত্রিকায় 16 মে যে খবর প্রকাশ যে কালী পুজোর সঙ্গে হোলি কে যুক্ত করা হয়েছে, আসলে কালী পুজোর সঙ্গে হোলির কোন সম্পর্ক নেই। আসলে বাংলায় হোলি এসেছিল শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরে, এখানে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বিভিন্ন স্থানে দেখানো হয়েছে এমনকি এও বলা হয়েছে যে ওখানে তাদের নাকি কোনো দোকান ছিল, অবশ্য এই নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি এমনকি আরো নানান ধরনের কথা রয়েছে সেগুলো কোনটাই খাপ খায় না। 1742 সালে ফ্রেঞ্চ দের একটি কলকাতার ম্যাপে এই লালবাজার নাম জানা যায়।

আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে সেখানে ফ্রেঞ্চ লেখা ছিল "Batarie de Lal Buzar" এইটার উল্লেখ ছিল।

ঠিক একই সময়ে আরও একটি ম্যাপে দেখানো হয়েছে Road to Lake. ভোলানাথ চন্দ্রের মতে লাল বাজার চত্বরটি ছিল লালমোহন বসাক এর তিনি এখানে দিঘি খনন করিয়ে ছিলেন। এরপর আর একটা তথ্য আছে যেখানে বলা হয়েছে সেই সময়ের ব্রিটিশ কালেক্ট J Z Holwell জানিয়েছিলেন লালবাজার কোন বাজার ছিল না, বরং একটি এলাকা ছিল, যেখানে 10 বিঘা এবং নয়টি কোটা জমি ছিল, যেখানে 81টি বাড়ি ছিল। তিনি আরও বলেন যে 'পূর্ব দিকে অ্যাভিনিউ', 'গ্রেট বান-গ্যালো রোড' এবং 'পুরাতন বৈতখানা স্ট্রিট' হল ট্যাঙ্ক স্কোয়ার থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত রাস্তার পুরো অংশটি অতীতে যে নাম দ্বারা মনোনীত করা হয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি। সৈন্য এবং নাবিকদের কাছে এটি ফ্ল্যাগ স্ট্রিট নামে পরিচিত ছিল, কারণ রাস্তার ওপারে খাবারের ঘরগুলিতে যাওয়ার জন্য পতাকার স্ট্রিং ছিল‌। তাহলে তো এই লালবাজার কে নিয়ে কত রহস্য জড়ানো। এছাড়া আরো জানা যায় যে এই লালবাজার নামটা হরিণবাড়ি স্ট্রিটের জন্য রাখা হয়েছিল 1784 সালে, কারণ এডওয়ার্ড টিরেটা 4 মে, 1784 তারিখে "লোল বাজার যা সাধারণত হারিবেরি স্ট্রিট নামে পরিচিত" -এ "প্রয়াত স্টিফেন শিয়া'র মালিকানাধীন" একটি বাড়ি এবং জমি বন্ধক রেখেছিলেন, এবং "লোল বাজার যা সাধারণত বোগডিন'স গার্ডেন নামে পরিচিত কিন্তু তারপর টিরেটার বাজার" -এর জমির স্থান বন্ধক রেখেছিলেন, যা পূর্বে সম্মানিত কোম্পানির কমরেড মাঠ ছিল। কতো যে লাল আর লোল এই জায়গাটিকে নিয়ে তার ভাবতে অবাক লাগে। এবার জানাই তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এডওয়ার্ড টাইরেটাকে একটি বাজার তৈরি করতে বলেন, আজ যেখানে লালবাজার অবস্থান করছে। আজকে যাকে আমরা লালবাজার পুলিশ স্টেশন হিসেবে পাচ্ছি সেটি তৈরি হয়েছিল, জন প্রিন্সেপ 1785 সালে তার এই জায়গাটি ক্রোমলিনের কাছে ব্রিক্রি করে বিরানব্বই হাজার টাকায়। এখানে একটা দলিলের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়েছে এই জায়গাটি রয়েছে অফিস, 'বুটিক দোকান' এবং জমি। আরো বলা হয়েছে যে এটি নাকি আগেকার দিনে কলকাতার গোল সাধারণ কারাগার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে আবার সেই কারাগার বা জেল কথা রয়েছে, যাইহোক জানা যায় ক্রোমেলিন সাহেব আবার এই জায়গাটি মরগেজ দেয় চার্লস ওয়েস্টার্ন নামের এক সাহেব কে ছাব্বিশ হাজার টাকায় 1786 সালে। কলকাতা গেজেট পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছিল সেখানে বলা হয়েছে "at the old Jail, in the Loll Bazar" from 1787 for some time. জন পাল্মার জিনি প্রিন্স অফ মার্চেন্ট ছিলেন এবং তিনি ছিলেন তখন আজকের লালবাজার প্রাসাদ প্রমাণ বাড়ির মালিক ছিলেন‌। পরবর্তীকালে তিনি এই বাড়িটি ব্রিটিশ সরকার কে বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই লালবাজার এর নামটা স্পষ্ট হলো না, পুরানো রেকর্ডে এটি "লোল" হিসাবে লেখা আছে এবং সম্ভবত "লোল" ছিল ""লোল শ্রাব" (ক্লারেট) এর অপভাষা। এই রাস্তাটি পুরাতন কলকাতার মদের দোকানের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু মদের থাকুক কিংবা যাই থাকুক কিন্তু নামের উত্তপ্তি যে কী করে হলো তা আজ ও ধোঁয়াশায় ভরা !

ছবির সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - P T Nair 

Comments