কলকাতার মিলিটারি শপিং মল


কলকাতার কনক বিল্ডিং ওরফে Army & Navy Stores

 

আমাদের কলকাতা বা ক্যালকাটা। এই কলকাতা এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কনক বিল্ডিং। আসলে একসময় এই বাড়িটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার একই ছাদের তলায় সব জিনিসপত্র পাওয়া যায় এমন দোকান, না তখন ও মেট্রোপলিটন বিল্ডিং এর সৃষ্টি হয় নি। কনক বিল্ডিং সম্পর্কে একটু বলা দরকার, কনক বিল্ডিং ছিল আসলে তৎকালীন আর্মি ও নেভি স্টোর।

বলে রাখা দরকার যে এই আর্মি নেভি স্টোর একটি শাখা ছিল কলকাতার কনক বিল্ডিং। 1871 সালে সেপ্টেম্বর মাসের 15 তারিখে আর্মি ও নেভির বিশিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা মিলে ঠিক করলেন একটি কর্পোরেটিভ সোসাইটি তৈরি করেন লন্ডনে। বলাই বাহুল্য যে এই কর্পোরেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের কর্তা ব্যক্তিরা ব্রিটিশ। এই আর্মি ও নেভি অফিসারা এই দোকানটি জিনিস পত্র সাপলাই করতো আলপিন থেকে সব কিছু, জনসাধারণের যেই সব জিনিসপত্র খুব কম টাকায় এখানে পাওয়া যেতো। অবশ্য এখানে মেম্বাররা এই দোকান কেনা কাটা করতো, এখানে মডেলটা আসলে ছিল সেনাবাহিনীর নিম্ন শ্রেণীর জন্য। 1872 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লন্ডনে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে প্রথম দোকান শুরু করে। 

প্রথম Army & Navy Stores


এই দোকান শুরু হওয়ার পর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। কলকাতার আসার আগে ভারতের আসার আগে 1875 সালে প্যারিসে এই আর্মি নেভি দোকান খোলে। 

মুম্বাইয়ে Army & Navy Stores


এই আর্মি ও নেভি স্টোর কাছে অনেকদিন ধরে ভারতের মাটিতে এই দোকান খোলার জন্য ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশরা আবেদন জানাতে থেকে, অবশেষে ভারতের মাটিতে 1889 সালে তৎকালীন বোম্বে অর্থাৎ এখনকার মুম্বাই তে। আসলে ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশরা নিজের দেশ এবং নিজের দেশের জিনিস মিস করতেন আর সেই জন্য এই ব্যবস্থা তাঁরা নিয়েছিলেন। 1901 সাল নাগাদ আর্মি ও নেভি স্টোর কলকাতায় তাদের ব্যবসা শুরু করেন, তবে তৎকালীন বেঙ্গল ক্লাব ঠিক করেছিল যে তারা চৌরঙ্গী তে, যে যায়গায় এই দোকানটি ছিল সেখানে নতুন একটা ক্লাব হাউস তৈরি করবে, অনেক দিন ধরেই যায়গা তাদের নজরে ছিল। কিন্তু সদস্যরা পুরনো যায়গা থেকে যেতে নারাজ! এই নিয়ে অনেক বাকবিতণ্ডা হয় কিন্তু অবশেষে নতুন ক্লাব হাউস তৈরি হয়নি, তার বদলে এখানে গড়ে উঠে এই আর্মি নেভি স্টোর। শোনা যায় যে সেই সময় এই প্লটের দাম মন্টেগু ম্যাসি লিখেছেন 2,50,000 বা টাকা 3,00,000. হয়তো এইটা সিকিউরিটি ছিল যে ভবিষ্যতে হেলে পড়বে না। এই স্টোর টি মানে আজকের কনক বিল্ডিং কে রাইটার্স বিল্ডিং সঙ্গে তুলনা করা হতো, কারণ এখন পাশ থেকে গেলে বোঝা যাবে না যে এইটা কোনো সরকারি ভবন নয়। তবে এখনো অব্দি এই বিল্ডিংটির স্থপতি কে অথবা কে ডিসাইন করেছিলেন বিল্ডিংটি কে সেটা জানা যায় নি। তবে হ্যাঁ আর সব ইউরোপীয় বিল্ডিং সাথে এর মিল রয়েছে। লাল সাদা রঙের ছটা বের হচ্ছে এই বিল্ডিং টি থেকে তার সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য পিডামেন্ট ওরফে যাকে সহজ বাংলা ভাষায় বলা যায় গ্রিক মন্দির উপরে ত্রিভুজ আকৃতির ছাদ দেখা যায় সেই গুলি কে পিডামেন্ট বলা হয়, ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন বিল্ডিং গুলি তে এই স্থাপত্য শিল্প দেখা যায়।

হলুদ গোলের মধ্যে দেখানো হয়েছে 


 এরই সাথে দেখা যায় স্টুকো একধরনের অর্ধকৃতি চাদের মতো স্টাইল একই ভাবে ব্রিটিশ স্থাপত্য দেখা যায়, এই জন্য রাইটার্স বিল্ডিং সঙ্গে গুলিয় যায়। এই বাড়িটির লম্বা করিন্থিয়ান ক্যাপিটাল সহ লম্বা স্তম্ভগুলি কেন্দ্রীয় পেডিমেন্টকে ধরে রাখে যার ফলে নীচ তলার ছোট্ট পিডামেন্টটি এই বিল্ডিং ঢোকার মুকুট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিল্ডিং এর অনেক স্থাপত্যের সঙ্গে কলকাতার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বাড়ি স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি মতো, এছাড়া এই বিল্ডিং এর সামনের দিকের অর্ধাবিত্তকার খিলান গুলি একটি চিহ্নিত করে যাকে বলা হয় স্প্যান্ড্রেলগুলিতে স্টুকো। 

ছবিতে দেখানো হয়েছে 


কলকাতার এই দুটো বিল্ডিং ছাড়া এই স্থাপত্য আর কোনো যায়গায় দেখা যায় না। এই বিল্ডিং ভেতরে অবশ্য আধুনিক হয়েছে তবে বাইরেটা যতটা সম্ভব পুরনো ধাঁচে রয়েছে। এই বিল্ডিং কিন্তু এখনকার সুপারমার্কেটে মতো কাজ করতো, একই ছাদের নিচে সব কিছু। এক ছাদের নিচে সব কিছু বলছি কারন সেই সময় আর্মি নেভি স্টোর এ দর্জি থেকে শুরু করে কোন কাগজপত্র ছাপানো, অথবা ট্রাভেল এজেন্ট, ব্যাঙ্কার, ক্যাটারার, বীমা দালাল ও ছিল। শুধু তাই নয় এই আর্মি নেভি স্টোর এ পিথ হেলমেট বলে রাখা দরকার যে পিথ হেলমেট

পিথ হেলমেট 


 ব্রিটিশ অফিসার কিম্বা ব্রিটিশ সৈনিকরা ব্যবহার করতো। এছাড়া এখানে পাওয়া যেতো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য এক ধরনের বাক্স এই যাকে বলা হতো Thunder box.

Thunder box


 এই সব জিনিসপত্র যে এখানে পাওয়া যেতো সেইটা জানার আর্মি নেভি স্টোর একটা ক্যাটালগ তৈরি করেছিল, সেই ক্যাটালগ সব লেখা থাকতো, সঙ্গে ছবি ও ! 

ক্যাটালগের ছবি


শুধু কী তাই এই স্টোরে ভারতীয়দের জন্য জিনিস পাওয়া যেতো, জানা যায় কলকাতার আর্মি নেভি স্টোরে দুর্গাপুজোর আগে পুজোর জিনিস পত্র পাওয়া যেত। "বিখ্যাত ইংলিশ কৌতুক অভিনেতা এবং লেখক টেরেন্স অ্যালান 'স্পাইক' মিলিগান, যিনি 1918 সালে আহমেদনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি স্মরণ করেন যে তিনি কতটা অধীর আগ্রহে আর্মি এবং নেভি স্টোরের ক্যাটালগটির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন" অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে ব্রিটিশদের জীবনযাত্রার আর্মি নেভি স্টোর কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল। 1876 সাল নাগাদ, ফার্মটি টেইলারিং এবং প্রিন্টিং-এর পাশাপাশি কাজ করে। সেই সময় আর্মি নেভি স্টোর এর স্কচ হুইস্কি খুব জনপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে শহরের ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। 

সেই ছবি


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্মি ও নেভি স্টোরগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রথমে 1930 এর গ্রেট ডিপ্রেশন, তারপর ব্লিটজ, যাতে টার্নহ্যাম গ্রিন এবং পোর্টসমাউথ প্রাঙ্গনে মারাত্মক বোমা ক্ষতি হয় এবং প্লাইমাউথ ডিপো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত 1948 সালে কলকাতার আর্মি নেভি স্টোর বন্ধ হয়ে যায় তারপর 1952 সালে মুম্বাই এ সালে শেষ এই আর্মি নেভি স্টোর বন্ধ হয়ে যায়। এখানে বলে রাখা দরকার যে কলকাতার প্রথম শপিংমল যাকে আগে বলা হত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর সেইটা কিন্তু মেট্রোপলিটন বিল্ডিং নয়! কলকাতা আর্মি নেভি স্টোরটি অধিগ্রহণ করা হয় এবং নাম রাখা হয় কনক বিল্ডিং।এই ভাবেই কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস যা কলকাতা কে চেনায় অন্যভাবে।

আর্মি নেভি স্টোর এর বিঞ্জাপন 


ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://www.tutorialathome.in/history/army-navy-store

https://www.facebook.com/share/p/1Fe4XMkxTR/?mibextid=xfxF2i


যদি সাহায্য করেন তাহলে খুব উপকার হয় 


Comments