কীভাবে নাম হলো চাঁদনী চক?

চাঁদনী চক মেট্রো স্টেশন 


আমাদের পশ্চিমবঙ্গর তথা এছাড়াও দিল্লি, পাটনা, পুনে এছাড়া ভারতের আর কত যায়গায় চাঁদনী চক কিংবা স্ট্রিট অথবা মার্কেট রয়েছে সেইটা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু চাঁদনী সঙ্গে যে একটা মুঘল কানেকশন জড়িয়ে সেটা সঠিক ভাবে বলতে পারা যাবে, বলা হয় দিল্লি তে নাকি প্রথম চাঁদনী চক নামে একটি বাজার ছিল। বলা হয় 1650 সালে এই তথাকথিত চাঁদনী চক তৈরি হয়, এই চাঁদনী নামটি দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের মেয়ে জাহানারা বেগম।

জাহানারা বেগম

এই চাঁদনী চক টি শহরে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠেছিল। এই জাহানারা বেগম ছিলেন অনেক গুনের অধিকারী, তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখক, স্থপতি, প্রকৌশলী এবং চিত্রশিল্পী, এর নকশায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইতিহাসবিদ Swapna Liddle তার বই Chandni Chowk: The Mughal City of Old Delhi, জানিয়েছেন যে “এই স্থানটি রাজকুমারী জাহানারা দ্বারা চালু করা হয়েছিল। জাহানারা খুব ধনী মহিলা ছিলেন। 1631 সালে তার মায়ের মৃত্যুতে, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে 5 মিলিয়ন টাকারও বেশি মূল্যের সম্পত্তি পেয়েছিলেন, যা তার মায়ের ভাগ্যের অর্ধেক ছিল, বাকি অর্ধেক তার ভাইবোনদের মধ্যে ভাগ করা হয়েছিল…। চকের মাঝখানে একটি বড় পুল ছিল, যা চাঁদনি বা চাঁদনীকে প্রতিফলিত করে, যা বর্গটিকে এর নাম দিয়েছে।" পাটনা এবং পুনের চাঁদনী কখনো যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে নি, তবে শুনেছি বিহারের রাজধানীর পাটনার চাঁদনী চক নাকি ইলেকট্রনিক ও হার্ডওয়্যার অন্যতম বাজার ওখানে দুশোটার ও বেশী দোকান রয়েছে। আর পুনের চাঁদনী চক নাকি অন্যতম ট্রাফিক মোড়। কিন্তু আমাদের কলকাতার চাঁদনী মার্কেট কিন্তু উপরুক্ত কাউর থেকে কম যায় না। অভিজিৎ চৌধুরী জানিয়েছেন কলকাতার চাঁদনী চক ছিল  “কলকাতা ছিল ঔপনিবেশিক রাজধানী, এবং ব্রিটিশরা, মুঘল সাংস্কৃতিক বাগধারার অনুরাগী না হয়ে, মুঘল বাজারের নাম গ্রহণ করত না। শহরের চাঁদনী চক 18 শতকে উঠে আসে। প্রথম দিকে, মশলা, মুদি এবং ফল বিক্রিকারী হকাররা স্থানীয়ভাবে চাঁদনী নামে পরিচিত অস্থায়ী ছাউনির নিচে স্টল স্থাপন করে। সম্ভবত বাজারটি তার নামটি পেয়েছে, "তিনি বলেছিলেন। কলকাতার একটি map থেকে জানা যায় চাঁদনী চক ছিল কলকাতার অন্যতম একটি বাজার বা বাণিজ্য কেন্দ্র, এছাড়া কলকাতার বিভিন্ন ইতিহাস নথি দেখে জানা যায় চাঁদনী চক হলো কলকাতার অন্যতম একটি প্রাচীন বাজার, 1784 সালের  A. Upjohn’s কলকাতা বা তৎকালীন ক্যালকাটার ম্যাপে চাঁদনী চক বাজার বলে একটি যায়গার উল্লেখ করা হয়েছে এবং এরসাথে চাঁদনী চক আরো তিনটি নাম পাওয়া যায় সেগুলি হলো 'চাঁদনী বাজার কা রাস্তা', 'চাঁদনি চোক' এবং 'গোরেমার লেন'। 


সেই ম্যাপ

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে চাঁদনী নাম আসলো কিভাবে? সেই জন্য আবার দিল্লি যেতে হবে, জানা যায় যে মুঘল আমলে চাঁদনী চক ব্যবসায়ী আস্তানা, এখানে সবকিছু পাওয়া যেতো হয়তো সেই জন্য চাঁদের আলোর মানুষের আলোয় আলোকিত হতো বলে এই নামটি রাখা হয়েছিল, তবে Rana Safvi তার বই Shahjahanabad The Living City Of Old Delhi জানিয়েছেন যে "দিল্লির চাঁদনি চক ছিল একটি বিশাল এবং বিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র যা দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করেছিল। এর খ্যাতি সম্ভবত অন্যান্য শহরগুলিকে তাদের নিজস্ব মার্কেটপ্লেসের জন্য নামটি গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল,” তবে এই নামের ব্যাখ্যার সঙ্গে কিন্তু কলকাতার চাঁদনী চক কোনো মিল নেই। P.T Nayar তাঁর বই তে কলকাতার চাঁদনী চক কে  চাঁদনী মার্কেট বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে 1938 সালের জানুয়ারি মাসের 14 তারিখে এই রাস্তাটির নাম পাল্টে রাখা হয় চাঁদনী চক স্ট্রিট রাখা হয়। W H Carry তার বই 'The good old days of honorable John Company: being curious reminiscences during the rule of East India Company from 1600-1858' (1907) উল্লেখ করেছেন চাঁদনী আসলে অস্থায়ী ছাদ যেগুলো সাধারণত দোকানে দেখা যায়। ( ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় উনি চায়ের দোকান কথাই বলেছেন )  নায়ার জানিয়েছেন যে চাঁদনী চক ছিল নাকি এক দুর্বিসহ এলাকা এতটাই দুর্বিসহ ছিল যে, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কর্পোরেশন কে  26 ও 27 নম্বর জমি অধিগ্রহণ করে চাঁদনী চকের সাথে যুক্ত করতে হয়েছিল এলাকাটিকে বড় করার জন্য। R.J. Minney’s  তার  বই ‘Round about Calcutta’ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন সেই ঘটনাটি হুবহু তুলে ধরলাম "  Minney’s writings paint a vivid picture of pre-Independence Chandni Chowk, not altogether impossible to imagine. “A stout undressed Bengali sits on the mattressed floor, laid with white clean linen, fanning himself lazily. By his side stands a hookah with a long stiff spout. There is more bare body than shop. He probably does not depend on his shop for a living. An inquisitive passer-by, who peered in to gaze at his stock, was not even hailed as a possible customer,” এখানে বলে রাখা দরকার যে ইনি ব্রিটিশ হলেও ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যদি উপরোক্ত অংশটি বাংলায় বলতে হয় তাহলে বলা হয়েছে যে একজন শক্তপোশাকহীন বাঙালি গদি মেঝেতে বসে, সাদা পরিষ্কার লিনেন দিয়ে বিছানো, অলসভাবে নিজেকে পাখা দিচ্ছে। তার পাশে লম্বা শক্ত থোকাওয়ালা হুক্কা দাঁড়িয়ে আছে। দোকানের চেয়ে খালি শরীর বেশি। তিনি সম্ভবত জীবিকা নির্বাহের জন্য তার দোকানের উপর নির্ভর করেন না। একজন অনুসন্ধিৎসু পথচারী, যিনি তার স্টকের দিকে তাকানোর জন্য উঁকি দিয়েছিলেন, তাকে সম্ভাব্য গ্রাহক হিসাবেও সমাদৃত করা হয়নি, তিনি  তাঁর  লেখায় জানিয়েছেন  এই চাঁদনী বাজারে অনেক সময়ে মারামারি, বকাঝকা, ঝগড়া, এমনকি হাসাহাসি চলছে, আর তার সাথে রয়েছে ব্যাস্ততা। ক্যামেরার দোকান, সাইকেলের দোকান আর ছিল পায়রার দোকান। নাপিত রাস্তায় বসে থাকতো আর লোক দেখলেই সালাম ঠুকতো মানে আসুন গোঁফ দাড়ি কামিয়ে দেব। এইচইএ কটন তার বই ‘Calcutta, Old and New’ জানিয়েছেন যে চাঁদনিতে অনেক গলি এবং প্যাসেজ এর গলোক ধাঁধা তিনি আরো বলেছেন এখানে সারি সারি দোকান যেখানে দরজার পেরেক থেকে সিল্কের পোশাক সহ বিভিন্ন ধরনের যাবতীয় জিনিস।

এখনকার চাঁদনী চক বা মার্কেট 

 কটন সাহেবের ভাষায় “labyrinth of ill-kept passages, lined with shops, in which may be found a wonderful collection of sundries, from a doornail to a silk dress.” কটন সাহেব যোগ করেছেন যে "তাদের"নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করা অনেক আরামদায়ক, এবং এখানে তো ভিড় নেই, নিজের পচ্ছন্দমত জিনিস আরাম পাওয়া যায়।

সেই সময়ের নিউ মার্কেট বা হগ সাহেবের বাজার 

নিউ মার্কেটের দোকান গুলিতে দরকষাকষি করা যায়, কিন্তু চাঁদনি মার্কেটে দরকষাকষি করার সঙ্গে সঙ্গে যিনি কিনছেন তাঁকে সেই সবের ব্যাপারে জানা হতে হবে, তার সাথে তার পকেটের খেয়াল রাখতে হবে কারণ চাঁদনী মার্কেটে খুব চোরের উপদ্রব। কটন সাহেব নিউ মার্কেট কে তাদের বলে উল্লেখ করেছেন, কারণ যেই সময় তিনি এই বইটি লিখেছিলেন তখন নিউ মার্কেট বা হই সাহেব এর বাজারে ভারতীয়দের ঢুকতে দেওয়া হতো না। 1937 সালে তৎকালীন ব্রিটিশ কলকাতা কর্পোরেশন ঠিক করে যে কলকাতার বাজার গুলির নাম পাল্টানো প্রয়োজন, সেই অনুযায়ী তারা কলকাতা গেজেটের সংস্করণে সরকারী বিজ্ঞপ্তি দেয়, কিন্তু কেন নাম পাল্টানোর দরকার হয়ে পড়লো সেই বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার কোনো কারণ উল্লেখ করেনি। সেই অনুযায়ী চাঁদনী চক 1ম লেনের নাম পরিবর্তন করে চাঁদনী অ্যাপ্রোচ করা হয়েছিল। গুরিয়ামা লেনের নাম পরিবর্তন করে চাঁদনি চক স্ট্রিট করার ঘোষণা দেয়‌। এই কথা P.T Nair তার বইতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দিনের পর দিন চাঁদনি মার্কেটে তার যায়গায় বাড়িয়ে চলেছে, এবং এর সাথে ফুটপাত দখল করেছে হকরা এই চাঁদনী মার্কেটের প্রতিবেশী হলো নিউ মার্কেট এখন নাকি দেখলে বোঝার উপায় নেই কোনটা চাঁদনী মার্কেট আর কোন টা হগ মার্কেট যতক্ষণ হগ সাহেবের বাজারের বোর্ড দেখতে পারছেন। তবে কলকাতার চাঁদনি মার্কেট কিন্তু কলকাতার মানুষের মন জয় করে নিয়েছে বছরের পর বছর ধরে, কতকিছুর সাক্ষী এই চাঁদনী চক বা মার্কেট। মোঘল আমল থেকে চাঁদনী জলজল করছে। 

ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - 

 P.T Nair

https://www.hindustantimes.com/india-news/indias-many-chandni-chowks-101734285447431.html

https://indianexpress.com/article/research/streetwise-kolkata-chandni-chowk-name-could-have-come-from-the-canopies-of-its-shops-7519191/


Comments