ব্রিটিশ আমলের সুন্দরবন

সুন্দরবন

 

আমাদের পশ্চিমবঙ্গর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো সুন্দরবন, এখানেই একমাত্র খাঁচা ছাড়া বাঘ দেখা যায় অবশ্য সবসময় দেখা যায় না। আমরা সবাই জানি যে এখানে প্রচুর সুন্দরী গাছ আছে বলে এই যায়গাটির নাম হলো সুন্দরবন। পশ্চিমবঙ্গের একদম শেষের দিকে সুন্দরবন অবস্থান করছে,এই সুন্দবনে একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন দেখা যায়। 

ম্যানগ্রোভ

অনেকে বলেন যে সুন্দরবন ছাড়াও এই যায়গাটির আরো একটি নাম রয়েছে সমুদ্রবন কারণ দক্ষিণ দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। আবার স্থানীয় মানুষজন এই অঞ্চলটিকে ডাকে চন্দ বান্ধে নামে, সেই জন্য সুন্দরবন নাম নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে, সেই জন্য ঐ বিতর্কে আর ধুকলাম না। বলা হয় সুন্দরবন ইতিহাস 200 থেকে 300 সাল পুরনো। শোনা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসার একশো বছর আগে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে থেকে এখানে চাষের কাজ শুরু হয়। আসলে আওরঙ্গজেবে চেয়েছিলেন এই এলাকার থেকে ও কর আদায় করতে কারণ তার লক্ষ্য ছিল যে করেই হোক দাক্ষিণাত্য কে জয় করা, যার ফলে তার টাকার প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন এবং বাঘের দৌরাত্ম্যে কোনো ভাবেই কর আর আদায় করা হয় নি।

তাঁত বুনছেন তাঁত শিল্পী


 জানা গেছে এই অঞ্চলে তাঁতের শিল্প খুব ভালো চলতো, এমনকি এই অঞ্চলে তাঁতের ব্যবসা খুবিই ভালো ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যখন ইংল্যান্ডে ভারতের তৈরি কাপড়ের উপর পঁচাত্তর শতাংশ 75% কর আরোপ করলো, ব্যাস ভারতের তাঁতীরা তাদের শিল্প ধরে রাখলেও ব্যবসা হারিয়ে ফেলল। তার পরে যখন spining mule আর বাস্প চালিত যন্ত্র চালু হয়, তখন রমরম করে ইংল্যান্ডের তৈরি সস্তা কাপড় ভারতীয় বাজারে ছেয়ে গেছে এর ফলে যা ক্ষতি তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষদের, কারণ ভারতের বাজারে ব্রিটিশদের তৈরি সস্তা কাপড় রমরমিয়ে চলতে থাকে।

spining mule

 তবে এই অঞ্চলে শুধুমাত্র তাঁত শিল্প প্রধান ছিল না, মনে রাখা দরকার যে সুন্দরবন অঞ্চল কিন্তু বদ্বীপ, যার ফলে পাশেই সমুদ্র এবং এর ফলে নুন বা লবণ শিল্প এখানে অন্যতম ছিল। মুগল যুগ থেকেই এখানে লবণ শিল্প বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করতো, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ সরকার ভারতকে নিজেদের উপনিবেশ পরিনত করার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবনের তৈরি লবণ বা নুনের উপর একচেটিয়া অধিকার নিয়ে নিয়েছিল এবং লবণ উপর কর আরোপ করেছিল 650 শতাংশ, যার ফলে আবার ও দেশের তৈরি নুন বা লবণ ব্যবহার না করে ব্রিটিশ সরকার তৈরি বিদেশি নুন ব্যবহার করতে হয়, কারণ 650 শতাংশ কর আরোপ হয়েছিল শুধু মাত্র সুন্দরবনের তৈরি লবণের উপরেই। 1830 সাল নাগাদ ব্রিটিশ তৈরি নুন পরাধীনভারতের বাজারে ছেয়ে গেলে, (এখন তো শুনছি ভুট্টার খই উপরে কর বসবে) বাধ্য হয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে লবণ তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং তার যায়গায় শুরু কৃষিকাজ। ব্রিটিশরা লক্ষ্য করেছিল যে হুগলি নদী তে পলি জমতে শুরু করেছে, যার ফলে বড় জাহাজ যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে, সেই জন্য কলকাতার জাহাজ ঘাঁটা অসুবিধার মধ্যে পড়ে, কিন্তু কলকাতা বন্দরের alternative দরকার, আর সেই জন্য ব্রিটিশ সরকার অনেক ভেবেচিন্তে সুন্দরবনের মাতলা নদী কে বাছলো এবং এখানেই কলকাতার বিকল্প জাহাজ ঘাঁটা তৈরী করবে বলে ঠিক করলো, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের 8,650 একর বনভূমি পরিষ্কার করা হয়েছিল এবং 1862 সালে এখানে একটি বন্দর ও জনপদ তৈরি করা হয়েছিল। ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেলের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল পোর্ট ক্যানিং। 

সেই দলিল যতদূর সম্ভব 

পোর্ট ক্যানিং 

 আমাদের পশ্চিমবঙ্গর একটি বিখ্যাত মিষ্টির নাম ও ক্যানিং দিয়ে আছে, সেই কথা অন্য একদিন বলা যাবে। হেনরি পিডিংটন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের আবহাওবীদ, এখন কোনো ঝড় আসলে বলি ঘুর্নিঝড় পরে অবশ্য আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়। এই ঘুর্নিঝড় বা ইংরেজি যাকে cyclone বলে এই নামটি কিন্তু পিডিংটন সাহেবের দেওয়া, গ্রীক শব্দ kyklos যার মানে গোল সেখান থেকে cyclone বা ঘুর্নিঝড় তৈরি করেন পিডিংটন সাহেব। 

হেনরি পিডিংটন

তার সৃষ্টি চার্ট


তিনি জানিয়েছিলেন যে 'He had noted that these storm nad a calm centre and that the winds around them ran anti-clockwise in the Northern hemisphere and clockwise in the Southern hemisphere. Because of the helical nature of the winds, he named them 'cyclones', পিডিংটন সাহেব যখন খবর যে সুন্দরবন অঞ্চলের মাতলা নদী তে নতুন বন্দর তৈরি করছে, সেই মুহূর্তে তিনি ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কে চিঠি পাঠালেন সেই চিঠিতে পিডিংটন সাহেব লিখেছিলেন যে, বন্দরের কাজ এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে, কারণ তিনি ছটি কারণ দেখিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো জলোচ্ছ্বাস এবং এখানে নোনা জলের জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় এছাড়া তিনি উদাহরণ দিয়েছিলেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানের যে গুলো প্রকৃতির দুর্যোগের জন্য ধংস হয়ে গেছে। পিডিংটন সাহেবের কথা তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পরোয়া করেনি, বরং তারা কাজ বন্ধ করার বদলে আরো জোরকদমে কাজ করেছিল, কিন্তু পয়লা নভেম্বর 1867 সালের রাতে এক ভয়াবহ ঘুর্নিঝড় ল্যান্ডফল করে সুন্দরবনে, যারফলে ক্যানিং হাউস এবং বনন্দের প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিহয়। ইংল্যিসম্যান পত্রিকায় লিখছিল যে A storm wave nearly 6 feet high carried away a portion of the riverbank jetties; the railway is much injured and the station destroyed”. The eye of the storm had passed right over Port Canning, according to the Bengal government's Annual Report for 1867-68.The station house, goods sheds and the railway hotel were all blown down; the Port Canning Company's store hulk Hashemy carried away a great portion of the Railway Jetty, and the fresh water tanks were salted by the storm-wave.” Around 90 people and 500 heads of cattle were reported lost and even the survivors suffered greatly for want of drinking water, since everything, including wells, had been inundated by sea water. The port and the town had been reduced to a “bleached skeleton”. এই কথাই পিডিংটন সাহেব লিখেছিলেন তার মৃত্যুর নয় বছর আগে, তিনি লিখেছিলেন “everyone and everything must be prepared to see a day when, in the midst of the horrors of a hurricane, they will find a terrific mass of salt water rolling in, or rising up upon them, with such rapidity that the whole settlement will be inundated to a depth of from five to fifteen feet”. ঠিক তাই হলো। সুন্দরবন অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে বলা হয় যে এর ফলে নাকি যেকোনো ঝড় কিছুটা হলেও কম প্রভাব ফেলে বলে জানানো হয় কিন্তু সুন্দরবনে কিন্তু যথেষ্ট প্রভাব ফেলে, 30 বছর পরে এখনোও ম্যানগ্রোভ লাগানোর কাজ চলছে, আসলে এক ইংরেজ সাহেব বা বলা ভালো স্কটিশ সাহেব স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন

স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন

 একজন ব্যবসায়ী 1910 সালের দিকে গোসাবায় একটি জমিদারি এবং একটি সমবায় প্রতিষ্ঠার জন্য 9,000 একর বনভূমি খালি করেছিলেন। উনি সুন্দরবন অঞ্চলে নিজের ব্যবসার জন্য বন সাফ জমি পরিষ্কার করে ছিলেন হ্যামিল্টন সাহেবের ছিল ট্রেডের ব্যবসা, যার ফলে সুন্দরবন অঞ্চল সবচেয়ে ভালো সেই জন্য নয় হাজার একর জমি পরিষ্কার করা হয়েছিল। হ্যামিল্টন সাহেব অফিস আছে কলকাতায়। হ্যামিল্টন সাহেব চেয়েছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলের সাথে কলকাতার যোগাযোগ ঘটাতে। তিনি চেয়েছিলেন একটি কপার্টিভ মুভেন্ট ঘটাতে কিন্তু সেটা ফেল করে যায়। সেই যাই হোক সবচেয়ে বড় কথা হলো এখান এখন সুন্দরবনের মূলত আর্থিক ব্যবস্থা হলো মধু ব্যবসা এবং মাছধরা। তবে এখন সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বাড়াতে হবে কারণ আমফান, বুলবুল, ফণী ঝড় কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের ততটা প্রভাব ফেলতে পারেনি কারণ সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সুন্দরবন অঞ্চলের সঙ্গে কিন্তু তেভাগা আন্দোলন সঙ্গে জড়িত, সুন্দরবন অঞ্চলের সুন্দরবনে নতুন উপনিবেশ শুরু হয় ব্রিটিশদের এই এলাকায় আসার সাথে সাথে। ক্লদ রাসেলের তত্ত্বাবধানে জমি পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছিল এবং টিলম্যান হেনকেল দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে টিলম্যান হেনকেলের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবনের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তিনি ভূমি বন্দোবস্ত প্রণয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং তার নিজের প্রশাসনের জন্য পৈতৃক কল্যাণের অবস্থান প্রকাশ করেন। হেনকেলের প্রচেষ্টা ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে তার উত্তরসূরিদের দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছিল। এই এলাকায় বিভিন্ন কালেক্টর জেনারেলদের দ্বারা গৃহীত বিভিন্ন ভূমি পুনরুদ্ধার নীতির ফলে, এই জলাভূমিতে ধীরে ধীরে কিন্তু বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। ভূমি পুনরুদ্ধারের সিক্যুয়াল ছিল বন্দোবস্ত স্তরবিন্যাস এবং ফলস্বরূপ কৃষকদের নিপীড়ন। এর ফলে তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সুন্দরবন অঞ্চলের সঙ্গে এভাবেই ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তবে সুন্দরবন কে পুনরায় ম্যানগ্রোভ বন লাগাতে হবে, বিভিন্ন ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে পারে পশ্চিমবঙ্গ।

ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - wikipedia, বিভিন্ন পত্রিকা এবং 

THE SUNDARBANSFolk Deities, Monsters and Mortals Sutapa Chatterjee Sarkar


Comments