কলকাতার হারিয়ে যাওয়া খড়খড়ি জানালা

খড়খড়ি যুক্ত জানালা


জানালা বা window প্রতিটি বাড়িতে জানালা থাকে, এটা স্বাভাবিক নতুন করে বলার কিছু নেই। এমনকি মনের ও জানালাও থাকে সোনার কেল্লা ছবি তে সিধু জ্যাঠা ফেলুদা কে বলেছিলেন মনের জানালা খোলা রাখাতে।

কিন্তু জানেন এই জানালা শব্দটি কিন্তু বাংলা শব্দ না, এটি পর্তুগিজ শব্দ। হ্যাঁ শুনতে অবাক লাগে কিন্তু এটাই সত্যি। তাহলে বাংলায় জানালা বলে বাতায়ন কিংবা গবাক্ষ। কিন্তু এখন কোনো জানালা খালি নেই সেখানে বসে আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র এক কথায় A.C. তবে এখন কলকাতার খুব কম সংখ্যক পুরোনো বাড়ি এবং ঐতিহাসিক ভবন গুলি তে সেকালের জানালা দেখা যায়। যদি সেকালের জানালার উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কবিগুরু কথা, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটবেলা প্রসঙ্গে এক জায়গায় লিখছেন, ‘…খড়খড়ির ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে ঘরের ছিটকিনি দিতুম খুলে। দরজার ঠিক সামনেই ছিল একটা সোফা; সেখানে অত্যন্ত একলা হয়ে বসতুম।’ শিশু রবি খড়খড়ি দিয়েই প্রাচীন বটগাছটি দেখতেন। দেখতেন ছায়া ঘেরা পুকুর।সাধারণত এই জানালা গুলি লম্বা হতো আর জানালার দরজা গুলি হতো সবুজ রঙের, বিংশ শতকের কলকাতায় এই ধরনের জানালা দেখা যেত, তবে কেন সবুজ হতো তা জানিনা অনেকে মনে করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুব কম খরচ করতেন আর তখন নাকি সবুজ রঙের দাম খুব সস্তা ছিল তার সাথে গাছের পাতা রঙ সবুজ ব্যাস গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট। এই জানালা গুলো আলাদা নাম ছিল সবচেয়ে বেশি পরিচিত হলো ল্যভে জানালা ( louvered window ) বাংলায় যাকে খড়খড়ি যুক্ত জানালা হিসেবে পরিচিত, আসলে জানালা দরজা গুলির মধ্যে দোকানে শার্টারের এক খোপ ছিলো, এই খোপ গুলি মধ্যে জানালা বন্ধ থাকলেও খোলা যেত আর একধরনের আওয়াজ হতো, আর এই আওয়াজ গুলি জন্য এই জানালা গুলোর নাম হলো খড়খড়ি। এই খড়খড়ি যুক্ত জানালা বিদেশিদের হাতধরে আমাদের দেশে যায়গায় করে নিয়েছিল। ভূমধ্যসাগরে ওপারের নাকি এই জানালা বানানো হতো মার্বেল পাথর দিয়ে, খরচা হতো তেমনি। এদেশের কাঠ নিলো মার্বেল পাথরের যায়গা জানা যায় বাড়ি ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত এই জানালা হতো। ছাদের দিকে থাকতো বিভিন্ন রঙের কাঁচ, আর বাকিটা কাঠের খড়খড়ি যুক্ত। আর বলার অপেক্ষা রাখেনা যে সেই উচ্চতা অনুযায়ী জানালার সিক বা গ্রিল। 



অনেকের মতে ল্যভে জানালার ল্যভে শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ থেকে, কারণ প্যারিসে একটি মিউসিমের নাম ল্যভে। আবার আরো একটি মতে এই জানালা গুলির নাম জলৌসি, এই জলৌসি শব্দটি ইতালির যার ফলে এই জানালা গুলির নাম ইতালির থেকেই এসেছে। আসলে খড়খড়ি যুক্ত জানালার কারণ রয়েছে, যেই বিদেশি শক্তি বাংলায় নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তাদের কাউর বাংলার আবহাওয়া সহ্য করতে পারছিল না, তাদের খড়খড়ি যুক্ত জানালার ফলে গরম এবং আদ্র আবহাওয়া ক্রশ ভেন্টিলেশন হতো যার ফলে খড়খড়ি তুলে দিলে আলো-হাওয়া আসত, তবে রোদ আসতে পারতো না। ফলে ঘরদোর ঠান্ডা থাকত। শুধু ঘর না তৎকালীন বারান্দায় এই খরখড়ি যুক্ত জানালা বসানো হতো যার ফলে জানালা বন্ধ করে খড়খড়ি উঠিয়ে দিলে জল ও আসবে না আবার ঠান্ডা হাওয়া খাওয়া যাবে। সেই সময় মহিলার অন্দর মহলে থাকতো, সবার সামনে বেরোনোর ক্ষেত্রে তাদের বাঁধা ছিল, বাহির মহলে কী হচ্ছে তাদের জানার কৌতূহল ছিল প্রচুর, এই খরখড়ির মাধ্যমে তাদের এই কৌতূহল নিবারণ হতো। তবে শুধু এই জানালা গুলিকে ল্যভে জানালা বলা হয় না অনেক সময় এই ধরনের জানালা গুলি কে সার্সি অথবা ময়ুরপঙ্খী জানালা বলা হতো, চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা সিনেমার একটি দৃশ্য ভোলা যায় না, যেখানে খহখড়িতে চোখ রেখে উদাস দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে চারুলতা। 

সেই দৃশ্য 

খড়খড়ি যুক্ত জানালা কিন্তু কলকাতার শুধু বাড়িতে দেখা যেত না বেশিরভাগ চার্চে এই ধরনের জানালা দেখা যেত। ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রভাব শুধু ঐতিহাসিক ভবন যেমন রাজভবন, সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল, প্রিন্সেপ ঘাট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, টাউন হল ইত্যাদিতে ভবন গুলি তে এখনো দেখা যায় খড়খড়ি যুক্ত জানালা, এখন হাতে গোনা এই খড়খড়ি জানালা দেখাযায়। তবে এখন শুনেছি বড়ো বড়ো কারখানাতেও এই খড়খড়ি যুক্ত জানালা ব্যবহার করা হয়, সেখানে এই গুলির নতুন নাম স্ল্যাটেড উইন্ডো, তবে কাঠের বদলে স্টিল প্লেট দিয়ে এগুলি তৈরি করা হয়, তবে কারণ কিন্তু একই ভেন্টিলেশন। তবে আধুনিক খড়খড়ি হলো উইন্ডো ব্লাইন্ড।

উইন্ডো ব্লাইন্ড

 তবে এটি আলাদা করে লাগালো হয় কাঁচের জানালার উপর, বিভিন্ন সাইজ এবং বিভিন্ন মাপের হয় এগুলি। 1930 সালে একটি বিখ্যাত বাড়ির সবকটা জানালায় এই উইন্ডো ব্লাইন্ড লাগানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আর এই কাজটি পেয়েছিল বালিংটনের ভালিংটন ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ড কোম্পানি, সেই বিখ্যাত বাড়িটি ছিল 102 তলা আর বাড়িটির নাম এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং।

এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং

তবে আমাদের শহরে এই ধরনের জানালা হারিয়ে যাওয়া কারণ আছে, যেই সব বাড়ি গুলিতে এই খরখড়ি যুক্ত জানালা ছিল সেগুলো সবই ভেঙে গেছে বা ভাঙার পথে কারণ হাইরাইজ বিল্ডিং তৈরি। মহানগর কলকাতা ভোলেনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে চারুলতার খড়খড়ি জানালা কথা। 

ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://www.telegraphindia.com/culture/all-about-calcuttas-louvered-windows/cid/1821642

সার্সি, খড়খড়ি, ময়ূরপঙ্খী জানালা হারাচ্ছে কলকাতা https://bengali.indianexpress.com/photos/kolkata-news/sarsi-kharkhari-peacock-windows-are-disappearing-from-kolkata-286318/

Comments