ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড এখনকার ডায়মন্ড বিল্ডিংকোং এখনকার

ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং


কলকাতার মধ্যে রয়েছে আরও এক কলকাতা, এই কথা বললাম কারণ এখন কলকাতা জুড়ে রয়েছে হাইরাইজ বিল্ডিং। কলকাতার মধ্যে আরো একটি কলকাতা কে খুঁজতে গেলে কয়েকবার অত্যন্ত ঘুরতে কলকাতার মধ্যেই, সেই খোঁজার ফাঁকে পেলাম একটি দুর্দান্ত স্থাপত্য। যাকে এখন ডায়মন্ড বিল্ডিং হিসাবে আমার চিনি। এই স্থাপত্যটি কিন্তু আকাশচুম্বী কিংবা হাইরাইজ বিল্ডিং। এখনো এই স্থাপত্যটি রয়েছে কলকাতার 16 নম্বর স্ট্যান্ড রোডের উপর। বর্তমান সময়ে এই বিল্ডিংটি পরিচিত ডায়মন্ড হেরিটেজ হিসাবে। কিন্তু আগে এই বিল্ডিংটি নাম ছিল ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং হিসাবে। এই বিল্ডিং অবস্থান খুবই বিখ্যাত, কারণ গঙ্গা নদীর ওপারে থেকে এই স্থাপত্যটি লক্ষ্য করা যায়। প্রশঙ্গত এই বিষয়ে জানিয়ে রাখার দরকার যে এই বিল্ডিংটি কিন্তু তথাকথিত ব্রিটিশদের বিল্ডিং নয় এই স্থাপত্যটি স্কোটিশদের। কলকাতার আরও আরো অনেক বিল্ডিং রয়েছে যেগুলো স্কোটিশদের তৈরি যেমন, অ্যান্ড্রু ইউল, গিল্যান্ডার্স আরবুথনট কো এবং মার্টিন বার্ন। এই বিল্ডিং নাম আগে কার নামে ছিলো, সেটা আগেই বলেছি কিন্তু নামের কারণটা এবার বলি, জানা যায় ম্যাকেঞ্জি সাহেব আগে ভারতের এখনকার উত্তর প্রদেশের গাজীপুরে আসেন, ম্যাকেঞ্জি সাহেব পুরো নাম ছিলো রর্বাট ম্যাকেঞ্জি। স্কোটল্যান্ড এর শহর ক্যাম্পবেলটাউন, আর্গিল থেকে 1836 সালে কলকাতায় পা রাখেন। এর ঠিক চার বছর 1840 সালে পর তিনি উত্তর প্রদেশের গাজীপুরের ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির বেঙ্গল এজেন্ট হন। কলকাতায় আসার পর হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর পুরনো বন্ধু উইলিয়াম ম্যাকিননকের, সেই সালটি ছিল 1847. সেই সময় উইলিয়াম ম্যাকিননক সাহেব কলকাতার কাছে কাশীপুরে চিনির শোধনাগার চালাচ্ছিলেন। দুই সাহেবই ঠিক করলেন কতদিন আর চিনির শোধনাগার চালাবেন আর কোনো এজেন্ট হয়ে কাজ করবেন, দেশে তখন ব্রিটিশরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে, অন্যদিকে উইলিয়াম ম্যাকিননের পর্তুগিজ ইস্ট ইন্ডিয়া ব্যবসায়ীর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। দুই সাহেবই ঠিক করলেন নিজেদের কোম্পানি বানাবেন এবং দুজনেই কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার হবেন। এরই মধ্যে ক্যাম্পবেলটাউন আরো একজন সাথি এই কোম্পানিতে অংশ নিলেন তিনি ছিলেন ম্যাকিনন সাহেবের বন্ধু জেমস ম্যাকঅ্যালিস্টার। এই 1847 এই ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এই বছরই কাশিপুরেই ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং এই একই বছরের ডিসেম্বরে এই কোম্পানির দলিল সই করেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতারা। এই কোম্পানি টি প্রথমে চা, চিনি, চাল দিয়ে তাদের ব্যবসার পথ চলা শুরু করে, ধারনা করা যেতে পারে এই কোম্পানির ছিল এই সব জিনিসপত্রের হোলসেলার ছিলো। এরপর তারা জিনিস পত্র আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসায় যোগদেয়। এর জন্য তারা একটি জাহাজ ভাড়া করে ছিল। 1851 সালের মে মাসে এই কোম্পানির আর এক শেয়ার হোল্ডার এডওয়ার্ড হারগ্রেভস তিনি আবার প্রসপেক্টর ছিলেন, উল্লেখযোগ্য যে এই প্রসপেক্টর হলো এক ধরনের অনুসন্ধানকারী যারা পৃথিবীর বুকে সোনা এবং বিভিন্ন ধরনের দামী খনিজসম্পদ খুঁজে বেড়ায়। তিনি দাবি করেন যে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে সোনা খোঁজ পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড রাশ এই কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। পরের বছর রবার্ট ম্যাকেঞ্জি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন লগ্নি আনার উদ্দেশ্য, কিন্তু 1853 সালে কুইন্সল্যান্ডের উপকূলে তার জাহাজ এস এস অরোরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঐ একই সালে ফেরার পথে তিনি নিহত হন। কিন্তু কীভাবে হয়েছিল সেই বিষয়ে জানা যায়নি। এর পর ম্যাকিনন সাহেব, ম্যাকেঞ্জি সাহেব শেয়ারটি কিনে নেন। ম্যাকিনন সাহেব এর পর গ্লাসগো ও লিভারপুলে নিজের ব্যবসা প্রসারিত করেন এবং প্রতিটি জায়গায় একটি করে অফিস ও খোলেন। অবশেষে ম্যাকিনন সাহেব 1852 সালে নিজের একটি জাহাজ কেনেন যার নাম ছিল রাণী বা queen. জাহাজ টি তুলনা মূলক ছোট ছিল। লিভারপুলে এই কোম্পানির নাম ছিলো, ম্যাকিনন অ্যান্ড কোং গ্লাসগো তে এই কোম্পানির নাম ছিলো ম্যাকিনন অ্যান্ড কোং আর কলকাতায় এই কোম্পানির নাম আগেই বলেছি, এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কেন দুটি জায়গায় আলাদা আলাদা নাম কিন্তু কলকাতায় কেন ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং কারণ ম্যাকিনন সাহেবের শেয়ার কিনে নেন ম্যাকিনন সাহেব, তাই আলাদা। কিন্তু কলকাতা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় একসাথে ব্যবসা করতো ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং। ম্যাকিনন সাহেব ঠিক করলেন যে কলকাতা ও তৎকালীন বার্মা এখনকার মায়ানমারে স্টিম নেভিগেশনে কোম্পানি স্থাপন করেন এবং কলকাতা থেকে তৎকালীন রেঙ্গুন এখনকার ইয়ানগুনের মধ্যে ডাক ব্যাবস্থা চালু করতে তিনি সব কাগজপত্র সই করেন। যার ফলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি বি আই ( Bl ) তে পরিণত হবে। যেই সালে এই সব কিছু চলছিল সেই সালটি ছিল 1856, এর পরের বছর ভারতে শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের সময় এই কোম্পানি শ্রীলঙ্কা থেকে সৈন্যদের ভারতে নিয়ে এসেছিল। 

যেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি BI


1862 সালের মধ্যে এই কোম্পানি অনেক গুলি ডাক পরিবহনের জন্য নতুন রাস্তা বা বলা ভালো রুট তৈরি করে। সুয়েজ খাল যখন খোলা হয়েছিল তখন এই কোম্পানির জাহাজ প্রথম ভুমধ্যসাগর পার হয়, সাল টি 1869. এই সুয়েজ খাল খোলার জন্য ভারত ও ইউরোপের ভালো ব্যবসা প্রসারিত হয়েছিল। এমনকি 1870 সালে জলসীমা রক্ষার জন্য এই কোম্পানি একটি কমান্ডিং অবস্থান প্রদান করে। এই সেই সময় P&O অথার্ৎ The Peninsular and Oriental Steam Navigation Company টেক্কা দিতে আরম্ভ করে। কোম্পানি যখন বাড়ছে তার এজেন্টদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে তার ফলে, কাজের অতিরিক্ত পরিমাণ সামলাতে, BI-এর কলকাতার এজেন্ট ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং. তাদের লন্ডনের সমকক্ষ গ্রে, ডাউস অ্যান্ড কোং-এর কাছে একজন শিপিং সহকারীর জন্য অনুরোধ করেছিল৷ 1874 সালে ছাব্বিশ বছরের এক তরুণ জেমস ম্যাকে কলকাতায় এসেছিলেন তার চাকরি সুরক্ষিত করার জন্য। এবং চাকরি তে তার ক্রমশ্য বৃদ্ধি হতে থাকে, এমনকি কোম্পানির 15% শেয়ার তিনি কিনে নেন। সেই সময় এই কোম্পানির জাহাজের সংখ্যা ছিল 526. কিন্তু এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ম্যাটিনি সাহেবের কোনো উত্তরাধিকার ছিল না, 1890 সালে 70 বয়সে তিনি মারা যান। প্রথমে জেমস ম্যাকালিস্টার হল এবং তারপর তার ভাগ্নে ডানকান ম্যাকিনন তার স্থলাভিষিক্ত হন। ডানকানের অবসর গ্রহণের পর, যেহেতু তার উভয় পুত্রই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, ফার্মটির নেতৃত্বে ছিলেন লর্ড ইঞ্চকেপ, যিনি এখন এর দীর্ঘতম জীবিত অংশীদার ছিলেন। এর BI এবং P&O একসাথে কাজ করে কিন্তু নিজস্ব পরিচয়ে। 

সেই ছবি 


1947 সালে যখন ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, 1956 সাল পর্যন্ত ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং ভারতে তাদের কাজ চালিয়ে যায়, কিন্তু এদের হেড কোয়ার্টার ছিল লন্ডনে। 

মুম্বাইতে Mackinnon Mackenzie & Co. বিল্ডিং 

তৎকালীন বোম্বে এখনকার মুম্বাই তে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং অফিস এখনো আছে, কিন্তু শুধু বিল্ডিং টি বাকি কিছুই নেই। সে যাই হোক এতক্ষণ ধরে তো ম্যাটিনি সাহেবের কথা ও তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার কথা বললাম এবার বলি কলকাতার ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং এর অফিস টির কথা এই অফিস টি ছিল ইঞ্চকেপ হাউস এর মধ্যে এই ইঞ্চকেপ ছিলেন একসময়ের বাংলার গভর্নর জেনারেল, এই লর্ড ইঞ্চকেপের মূল বাড়ি ছিল ক্যামাক স্ট্রিটে। 

কলকাতায় ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং

আর এই বাড়িটি বানানো হয় ছিল বেলে পাথর দিয়ে, জানা যায় যে এই স্থাপটি তৈরি হয়েছিল নিও-ক্লাসিক্যাল ও তৎকালীন ব্রিটিশ রেনেসাঁ মিশ্রনে। বেলে পাথরের বড় বড় থামছিল, এবং নীচ তলায় বা গ্রাউন্ড ফ্লোরের কোণা গুলো দেখতে অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি যেরকম দেখা যায়। আরও চোখ পড়ে এই স্থাপত্যটি চাররটি কলামের উপর। 1925 থেকে 1926 সালের মধ্যে ম্যাকিনটোশ বার্ন অ্যান্ড কোং এই বিল্ডিংটি নির্মাণ করে আর এই বিল্ডিংটির একটি অংশ ছিল ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং হাতে আর বাকি অংশ টা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল।

কলকাতার ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং একদিক


তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড ( SAIL ), ইউনিট ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া   UTI , ICI, IFCI ইত্যাদি। এই স্থাপত্যটির একটি বড় গম্বুজ চূড়া ছিলো, এখানে বলে রাখা দরকার যে গম্বুজ আকৃতি বৌদ্ধ স্থাপত্য অংশ, এই গম্বুজ আকৃতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং আমাদের রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখাযায়। কিন্তু 1998 সালের নভেম্বর মাসের 7 তারিখে রাত দুটোর সময় এই ভয়াবহ আগুন লাগে এই বিল্ডিং এ, সেই আগুন কীভাবে লেগেছিল সেইটা আজ অবধি জানা যায় নি। 

সেই আগুন 


সেই ধ্বংস স্তুপ 

অনেকে মানুষ আহত হয়েছিল, প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়েছিল এই বাড়িটি। 2010 সালে এই বিল্ডিং টি কেনেন এক রিয়েল এস্টেট সংস্থা যার নাম হলো ডায়মন্ড গ্রুপ, তাদের কে এই শর্তে বিক্রি হয়েছিল ইঞ্চিকেপ হাউসে রিনোভসন করতে হবে ঠিক আগের মতো, বিশেষত সামনের দিক এবং ভিতরের কিছু অংশ। 

এখনকার সময় ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি

এই রিনোভসনের ও বিশেষতো আগের মতো গড়ে তোল দায়িত্ব পড়ে দুলাল মুখার্জি ও মনীশ চক্রবর্তী উপর, তাদের নেতৃত্বে পুনরায় গড়ে ওঠে এই স্থাপত্য পুরনো শৈলী কে বজায় রেখে, এই রিসটোরেশনে খরচ হয়েছিল একশো কোটি টাকা। অনেকে আবার এই স্থাপত্যটিক হেরিটেজ হিসাবে মান তে চায় না, যেহেতু এটি নতুন করে তৈরি হয়েছিল। তবে যাই হোক এই বিল্ডিং কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি, রিনোভেশন বা রিস্টোরেশন যাই হোক না কেন কিন্তু সেইটা পুরনো শৈলিকে বজায় রেখেই।যার ফলে আমাদের মহানগর কলকাতা কখনো ভুলবে না ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং কে এবং তাঁদের অফিস ইঞ্চকেপ হাউসকে!

 ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://www.tutorialathome.in/heritage-commercial-buildings/mackinnon-mackenzie-building

https://defonseka.com/front-page/the-articles/history/2132-2/

Comments