কলকাতার প্রাসাদ প্রমাণ বাড়ি স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি!

কলকাতার স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি 

 কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বাড়ি গুলি এখনোও নিজেদের ঐতিহ্য বহন করে চলছে। কারণ কলকাতা ব্রিটিশ সরকারের প্রথম রাজধানী। আপনি যদি ডালহৌসি চত্বরে একবার ঘুরে আসতে পারেন তাহলে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়ি গুলি চোখে পড়বে ( ব্যাক্তিগত মতামত অবশ্য একটি মাত্র চক্করে ডালহৌসি চত্বর ঘোরা সম্ভব নয় ) এই ডালহৌসি চত্বরে রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিল্ডিং, যেই জায়গায় এই বাড়ি টি দাঁড়িয়ে রয়েছে বর্তমানে এই জায়গাটির নাম হলো রেড ক্রোস প্লেস। আসলে ব্রিটিশ কলকাতাকে লন্ডন বানাতে চেয়েছিলেন, অবশ্য অনেকেই কলকাতা কে লন্ডন বানাতে চান, কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয় কারণ কলকাতা, কলকাতাই আর লন্ডন লন্ডনই। সে যাই হোক এই স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিল্ডিং কিন্তু অপুর্ব স্থাপত্য,  ব্রিটিশরা যখন এদেশের এসে নিজেদের হাতে ক্ষমতা তুলে নেয় তখন বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ স্থাপত্য কলার নির্দশন দেখা যায়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো এই স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিল্ডিং। তবে এই বাড়িটি যিনি ডিজাইন করেছিলেন তার আর একটি ডাজাইন করা বিল্ডিং এখনো ভারতে রয়েছে, তিনি হলেন ফ্রেডিক উইলিয়াম স্টিভেন্স।

ফ্রেডিক উইলিয়াম স্টিভেন্স

 তিনি তৎকালীন বোম্বে মানে এখনকার মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস অর্থাৎ তৎকালীন বোম্বের ভিক্টোরিয়ান টার্মিনাস ডিজাইন করেছিলেন। কলকাতার এই বাড়িটি তৈরি শুরু হয়েছিল 1894 সালে এবং বাড়িটি তৈরি শেষ হয় 1896 সালে। যারা ইউরোপ ঘুরে এসেছেন কিংবা ইউরোপীয় মানুষজন এখানে এসে ভাবতেই পারেন যে কলকাতায় কিংবা ভারতের ইউরোপীয় ধাঁচের তৈরি বাড়ি কেমন একটা ছন্দহীন মনে হয়, আসলে ব্রিটিশরা যে দুশো বছর এদেশের রাজত্ব করে গেছে সেইটা তারা সময়ের সাথে ভুলেই ভুলেই যায়। অনেকে দাবি করেন যে কলকাতায় এখন যে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিল্ডিং টি দেখা যায়, এইটা তুলনামূলক নতুন বিল্ডিং। এর অনেক আগেই 15 হেয়ার স্ট্রিটে এই স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স অফিস ছিল। এখনো হেয়ার স্ট্রিটে সেই বাড়িটি দেখা যায় যেখানে একসময় এই লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিস ছিল। অবশ্য এর কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যায় না। এখন যেই বাড়িটি আমার দেখি রেড ক্রোস প্লেসে সেইট হলো দ্বিতীয় অফিস স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের, আর এই বাড়িটি এডিনবার্গের স্ট্যান্ডার্ড লাইফ অ্যাসুরেন্স ভবনের প্রধান কার্যালয়কে প্রভাবিত হয়েছে। আসলে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রধান অফিস হলো স্কটল্যান্ডের  এডিনবার্গে। 

Standard Assurance Company Office At No. 3 George Street, Edinburgh

সেই জন্য এখানে একটু এডিনবার্গের স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কথা বলা দরকার, 1825 সালের মার্চের 23 স্কটল্যান্ডে একটি বিমা কোম্পানি তৈরি হয়, 1832 সালের এপ্রিল মাসের এই বিমা কোম্পানির নাম হয় স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। 1839 সালের june মাসের আট তারিখে এডিনবার্গের তিন নম্বর জর্জ স্ট্রিটে খুব বড় ভাবে এই কোম্পানি খুলে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই কোম্পানির আর্কিটেকচার। মূল ফটকে রয়েছে বাইবেলের দশটি কুমারী স্থাপত্য রয়েছে। এই স্থাপত্যটি ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিলেন জন স্টিল।

সেই ছবি 

 প্রথমে অবশ্য এই বিমা কোম্পানি তথা আরো কোম্পানি গুলি ভারতের চাকরিত বা ভারতে চাকরি করতে যাবেন এমন ব্রিটিশদের বীমা করতে রাজি ছিলনা, কারণ ভারতের আবহাওয়া কোনভাবেই ব্রিটিশ পক্ষে কার্জকর না, দ্বিতীয় গরম, তৃতীয় ম্যালেরিয়ার মশা এবংকলেরা এবং কালো জ্বরের মতো রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। যার ফলে খুব কম বয়সে ইউরোপীয়রা মারা যাওয়া ফলে মৃত্যুর কারণ ক্রমশঃই বাড়িতে থাকার ফলে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি সহ অনেক বীমা কোম্পানি গুলি ইউরোপীয়দের উপনিবেশে ভ্রমণ বা চাকরি করতে যাওয়া বীমা করতে চাইতো না। কিন্তু অনেক ত্রুটি নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এই বীমা গুলি করতো। আসলে ইংরেজিতে একটা কথা আছে No Risk, No gain. একটু তো ত্রুটি নিতেই হবে, যার ফল স্বরূপ ভারতের কলকাতা সহ বিভিন্ন জায়গায় তারা তাঁদের বীমা কোম্পানি গোড়ে তোলে। কলকাতার তৎকালীন ট্যাঙ্ক স্কোয়ারে একটি জমি অধিগ্রহণ করে এবং আগেই বলেছি 1896 সালে এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল। এই ভবনটি বাড়ি টি দুটি ব্লকের উপর দাঁড়িয়ে আছে, জানা যায় একটি ব্লকের আর একটি ব্লকে থেকে একটু উঁচু, যদিও দুটি ব্লক এই তিনতালা। কিন্তু প্রথম এবং দ্বিতীয় তলা সংযোগ করা হয়েছে দুটি ব্রিজ দিয়ে। যেহেতু দুটি সেতু রয়েছে তাই নীচ তলার ব্রিজ নিচে গলি আছে তার আবার আলাদা নাম রয়েছে, এর নাম হলো ভ্যান্সিটার্ট রো। এই নাম রাখার কারণ হলো, 1759 থেকে 1764 পর্যন্ত হেনরি ভ্যান্সিটার্ট বাংলর গর্ভনর জেনারেল ছিলেন।

হেনরি ভ্যান্সিটার্ট

 হয়তো এই কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার ছিলেন এই হেনরি ভ্যান্সিটার্ট সেই জন্য হয়তো আলদা করে গলির নাম রেখেছিল স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। ধুসর বাদামি বেলে পাথর দিয়ে তৈরি এই বাড়িতে উপরদিকে রয়েছে একটি কুপোলা এবং আবহাওয়া অফিসের মতো একটি আবহাওয়া ভেন, এখানে একটু কুপোলার ( cupola ) কথা বলে রাখার দরকার এগুলো এটি একটি ল্যাটিন শব্দ যার মানে ছোট কাপ।

এই বাড়ির কুপোলা

 সাধারণত এটি ভেন্টিলেটর কাজ করে, ইউরোপীয়দের অনেকের বাড়িতে এটি দেখাযায়। সাধারণত এর উপরেই থাকে আবহাওয়া ভেন। তবে এই কুপোলা এসেছে গ্রিক স্থাপত্য শিল্পের মাধ্যমে, আর কলকাতার স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দেখলে মনে হয় ইংল্যান্ডে থেকে সরাসরি চলেছে এসেছে। এই বাড়িতে ঢোকার সময় আমরা মূল পেডিমেন্টের প্রধান খিলানযুক্ত গেটওয়ের উপরএ দেখতে পাবো বাইবেলের সেই দশ কুমারীর ভাষ্কর্য যারা নিজেদের বর আসার জন্য অপেক্ষা করছে প্রদীপ নিয়ে। 

সেই ভাষ্কর্য যেমন আছে এডিনবার্গে 

ঠিক একই স্থাপত্য রয়েছে ইংল্যান্ডের স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি তে। এছাড়াও কোম্পানির ঢোকার সময় চোঁখে পড়বে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নাম খোদাই করা কিন্তু এই নামের নিচেই রয়েছে দুটি মানুষের ভাষ্কর্য এই দুটি স্থাপত্য কিছু বলতে চাইছে। কোম্পানির নামের নিচেই ডানদিকে রয়েছে গ্রিম রিপারের ভাষ্কর্য আর বা দিকে রয়েছে মশাল বহনকারী এক কুমারী। এবার এই গ্রিম রিপারের সম্পর্কে বলি এই গ্রিম রিপারের হাতে একটি খুলি রয়েছে , বলা হয় গ্রিম রিপারের ভাষ্কর্য মৃত্যুর প্রতিনিধি এর ধারনাটি এসেছে 14 শতকে ইউরোপে নাকি ব্ল্যাক ডেথ হয়েছিল, সেখান থেকে এই গ্রিম রিপারের ধারনা এসেছে আর মশাল হাতে কুমারী বলতে চেয়েছে আলোর সন্ধান।

সেই ভাষ্কর্যের ছবি
 

মানে একদিকে আলো ও আরেক দিকে অন্ধকার। এছাড়াও এই বাড়িটির চারটে আলাদা আলাদা মুখ রয়েছে, এই মুখের ভাষ্কর্য গুলি এই বিল্ডিং ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যায় উপর দিকে একজন এক নারীর মুখের ভাষ্কর্য এই মুখের ভাষ্কর্য গুলি কে কীস্টোন বলা হয়, তাছাড়া আরো তিনটি কীস্টোন রয়েছে তিনটি পুরুষের কীস্টোন রয়েছে। হয়তো কোনো দেবতা বা রাজার মুখের কীস্টোন কিংবা কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের। 

সেই মুখ গুলির ভাষ্কর্য 


যেহেতু এই বিল্ডিংটি দুটি বল্কে বিভক্ত তাই এর পুর্ব দিকের বিল্ডিং এর একটি ত্রিভুজের পিডামেন্টে রয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিহ্ন রয়েছে একদম উপরে বা দিকে রয়েছে ইউনিকর্ন যা স্কটল্যান্ডের জাতীয় প্রাণী এবং তাদের আসল কোট অফ আর্মসের বৈশিষ্ট্য (পরে এটি পরিবর্তন করা হয়েছিল)। ডানদিকে ইংরেজ সিংহ। বছরের পর বছর জরাজির্ন অবস্থায় থাকায়, বাকি বিবরণ আর দৃশ্যমান হয় না বিশেষ করে কোট অফ আর্মসের কেন্দ্র ঢাল। 

এরো দিয়ে দেখানো হয়েছে কোট অফ আর্মাস আর দিকে একটি জানালায় দেখা যাচ্ছে অ্যভম ইভ

জানা যায় যে এই কোম্পানির বিজ্ঞাপনে গ্রীক দেবতা হারকিউলিস কে বেছে নেওয়া হয়েছিলো।

সেই বিজ্ঞাপন 

 যেহেতু এই বিল্ডিংটি এতটাই বড় যে তার কোনায় কোনায় ইতিহাস উঁকি মারছে, যেমন এই বাড়িটির বিভিন্ন জানালায় বিভিন্ন ভাষ্কর্যের ভরা, যেমন একটি জানালার ভাষ্কর্যে দেখা যাচ্ছে দুটি মানুষের মুর্তির হাতে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। আর একটি জানালায় দেখাযাচ্ছে একটি মানুষের ভাষ্কর্যে দেখা যাচ্ছে একটি মানুষের মানুষ ভারতীয় বাদ্য যন্ত্র তবলা বাজাচ্ছে। আরো একটি জানালায় দেখা যায় যে অ্যাডাম এবং ইভের ভাষ্কর্য। এছাড়াও বিভিন্ন ভাষ্কর্য দেখা যায় এই বাড়িটি তে। এছাড়াও যদি আরো উপরে অর্থাৎ মানে ছাদে গেলে দেখা যায় বড় কুপোলা রয়েছে, তার চারপাশে আরো ছোট্ট কুপোলা। বড় কুপোলার সঙ্গে আবহাওয়া ভেন টি রয়েছে। অনেকে দিন ধরে এই বিল্ডিংটির রেষ্টোরেশন চলছিল, অবশেষে সেটা শেষ হয় তবে এখন এই বিল্ডিং টি আর স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নয়। এখানে অবশ্য অনেক অফিস রয়েছে তবে, ভেতরে এখনো ঐতিহ্যে ভরা, তবে বাইরে এখনো একটি ফলকে লেখা রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এখনো এই বাড়িটি কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো কখনোই ভূলবেনা এই বাড়িটি কে আর ভূলবেনা আরো একজন কে। 

ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://www.tutorialathome.in/heritage-commercial-buildings/standard-life-assurance-building

http://double-dolphin.blogspot.com/2014/03/the-standard-life-assurance-building.html?m=1

https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/victoria-era-building-gets-new-lease-of-life/articleshow/49706132.cms

 

Comments