কীভাবে ভারত চা'য়ের প্রতি আসক্ত হলো !

চা

 চা এই একটা পানীয় সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। কিন্তু ভারত তথা বাংলায় ব্রিটিশদের হাত ধরেই চা এসেছিলে। আর এই চা ভারতবাসী কে এমন ভাবে আসক্ত করলো যে বলার কথা নয়, সকাল বেলায় উঠে চা চাইই! সকালবেলা উঠে এই চা খাওয়া ব্যপারটা একটি নাম রয়েছে বেডটি। আবার অনেকে রয়েছে যাদের চা না খেলে সকলের ইয়ে হয় না। কিন্তু জানেন তো চা কিন্ত মেড ইন চায়না। ভারতে ও পাওয়া যায় অনেক দিন আগে থেকেই কিন্তু জানা ছিল না। কিন্তু জানেন চা কিন্তু আগে পানীয় ছিল না, পানের মতোই চা চিবিয়ে খাওয়া হতো, একটি ওষুধের মতো।

শেন নং

 শ্রী কৌশিক মজুমদার প্রণিত নোলা বই থেকে জানতে পারি চীনের সম্রাট শেন নং জল ফুটিয়ে খেতেন, একদিন সেই জলে চায়ের পাতা ব্যাস তারপর থেকেই চা হয়ে গেল পানীয়। 

বলা হয় চীনা বৌদ্ধ পন্ডিতরা, চীনের উত্তর দিকে চা কে জনপ্রিয় করে তোলে ওষুধ হিসাবে। অনেক মনে করে বৌদ্ধ ধর্ম যত বিস্তার পেয়েছে তার সাথে সাথে বিস্তার পেয়েছে চা। চীনে যখন ট্যাঙ্গ সাম্রাজ্যের শুরু হয় তখন চায়ের বিস্তার বেড়ে যায়। আর চা শুধু মাত্র আর ওষুধের হিসেবে পান করা হতো না, মুখের টেষ্ট পাল্টানোর জন্য ব্যবহার শুরু হয়। চীনে ট্যাঙ্গ সাম্রাজ্যের সময় চায়ের প্রসেসিং শুরু হয় এবং আরো নতুন নতুন ভাবে চায়ের বিবর্তন শুরু হয়, এই সময়ে সারা সিল্ক রুট ধরে পুরো মধ্য এশিয়ায় চা ছড়িয়ে পড়ে এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত চা ছড়িয়ে পরেছিল। এই ভাবে যখন সারা বিশ্বে চা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তখন ব্রিটেন কী আর বাদ যাবে! এখানকার দিনে সবচেয়ে বেশি যে চা খাওয়া হয় সেটা হলো লা চা বা Black Tea. 



এই চা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয় চীনে যখন মিং রাজত্ব চলছিল।

Hongwu
মিং রাজত্বের রাজা

 এই সময় তে পর্তুগিজ ও ডাচ মানুষদের কাছে এই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে লা চা বা Black Tea ওটাও জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে চা জনপ্রিয় হয় যখন চা এ দুধ মেশানো হয়। আসলে এক পর্তুগিজ রাজকুমারী সাথে বিয়ে হয় এক ব্রিটিশ রাজার, ঐ রাজকন্যে খুব চা খাওয়ার নেশা ছিল, তিনি পুরো রাজপরিবার কে চা খাওয়ার নেশা ধরিয়ে দেয় ব্যাস পুরো ইংল্যান্ড জুড়ে চা খাওয়া শুরু হয়ে গেল। আর গরম চা কাঁচের কাপে ধাললে কাপ ভেঙে যেত, ঐ জন্য গরম চায়ে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হতো। ব্রিটিশদের জীবনযাত্রার মধ্যে চা একদম ঢুকে গেল, কিন্তু দাম ও বেশি ছিল চায়ের ব্রিটেনের। জানা যায় সেই সময় চা একমাত্র চীন থেকে রপ্তানি করা হতো, আর ইংল্যান্ডের কোনো জিনিস চীনে জনপ্রিয় ছিল না যার ফলে ব্রিটিশদের রুপোর বদলে চীন থেকে চা রপ্তানি করা হতো। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার দেখালো যে এই চায়ের জন্য তাদের জমানো রুপোর শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীন থেকে চা আমদানি ও রুপোর রপ্তানি করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঠিক করলো চীনের জনগণ কে এমন একটা কিছু তে আসক্ত করতে হবে, সেটা শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিতে পারে। এবার আসি ভারতের কথায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারতে আসলো বানিজ্যের উদ্দেশ্যে তারপর কবিগুরুর ভাষায় "বণিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজ দন্ড রুপে" ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিরাজ কে হারিয়ে বাংলা দখল করলো, আর বাংলায় শুরু হলো আফিম চাষ। 



এই আফিম চীনে রপ্তানি শুরু করলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, আর তার বদলে চা আমদানি করলো। ব্যাস আফিমে এমনি মজে গেল চীনের মানুষ যে একটি পরিসংখ্যান দেখলই বোঝা যায় 1880 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাইশ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল।

আফিমে আসক্ত চীন 


 এই আফিম চীনে এক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই সময় চীন সরকার আফিম আমদানি বন্ধ করে দেয়।

আফিম যুদ্ধ 

 এর ফলে শুরু হলো ইঙ্গ চীন যুদ্ধ 1839 সালে থেকে 1842 অব্দি, এখানে বলে রাখা ভালো যে 1839 সালেই চীন আফিম আমদানি বন্ধ করে দেয়। স্বাভাবিক ভাবেই চীন ইংরেজদের কাছ হেরে যায় এবং হংকং ইংরেজ কাছে চলে আসে। কারণ চীন যুদ্ধে হেরে যায়। কিন্তু ব্রিটিশরা যতই জিতে যাক যুদ্ধে কিন্তু চা তো সেই চীন থেকেই কিনতে হচ্ছে, আর শোনা যায় চা কিভাবে প্রস্তুত করে চীনারা সেটা কখনোই বাইরের জানতো পারতো না। এই রকম সময় ব্রিটিশ জানতে পারে যে ভারতের আসামে একধরনের জংলি চা পাওয়া যায়, আসাম এবং বাংলার দার্জিলিং এর ভৌগলিক অঞ্চল চা এর তৈরি জন্য প্রস্তুত, সেই কারণে ব্রিটিশ আরো একটা প্ল্যান তৈরি করলো ব্রিটিশ সরকার ঠিক করলো এক বোটানিস্ট রোবাট ফরচুন কে গুপ্তচর হিসেবে পাঠানো হলো এবং তিনি চীনে কুড়ি হাজার রকমের চা প্রস্তুতির পদ্ধতি, আট জন চা শ্রমিকদের ভারতে নিয়ে এসেছিল।

রর্বাট ফরচুন 


 এই ভাবেই আসাম, দার্জিলিং ও নিলগিরি চা প্রস্তুত শুরু হয়। কিন্তু অনেক মনে করেন এই সব কিছু করেও ব্রিটিশ তাদের প্রিয় cuppa চা থেকে বঞ্চিত ছিল। এই ভাবেই চা সারা ইউরোপে রপ্তানি করতো, কিন্তু ভারতীয় মধ্যে চা কীভাবে জনপ্রিয় হলো ? জানা যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চেয়েছিল ভারতবাসী কে ও চা তে আসক্ত করতে, তারা ভালো স্ট্রেটিজি নিয়েছিল। তারা বিনামূল্যে রেল স্টেশন, সিনেমা হল, ইউনিভার্সিটি, বিভিন্ন ফেক্টরি এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ফ্রীতে চায়ের প্যাকেট দিতে শুরু করে, জনসাধারণ ফ্রী তে কোনো জিনিস পেলে নেবেই। হলোও তাই আস্তে আস্তে বিভিন্ন জায়গায় চায়ের গুমটি খুলতে লাগলো। অনেকে মনে করতেন ভারতের যেইসব জায়গায় থেকে চা রপ্তানি হতো সেই জায়গার বাবুরা চা খেত বা বলা ভালো পান করতো যেমন কলকাতা, বোম্বে মানে এখনকার মুম্বাই।

সেই বইয়ের ছবি

 জন ওভিংটন তার বই A Voyage to Surat in the year 1689 তে উল্লেখ করেছেন ভারতীয়রা চায়ে লেবু আবার কোনো চায়ে মশলার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। 1920 সালে কলকাতায় Tea Cabin, এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় চায়ের স্টল খুলতে লাগলো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিভিন্ন কলকারখানা কাছে। চায়ের স্টলে বসে মানুষজন, ছাত্র গল্প গুজব করতো, এখানে আরো একটা তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন বাঙালি ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র জানিয়েছেন যেসব মানুষ চা পান করতো ঠিক একই রকম মানুষ এর বিরোধিতা করে। 1930 সাল নাগাদ বিপ্লবীরা ও চায়ের গুমটি কিংবা স্টলে আসতে শুরু করে, কারণ সেই জায়গায় থেকে অনেক কিছু জানা যেত কারণ ব্রিটিশ পুলিশ ও তো এই জায়গা থেকে চা খেত। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশদের চা ব্যবসা ধাক্কা খেল কারণ চা ছিল সাম্রাজ্যবাদের প্রতিক। গান্ধীজি চা শ্রমিকদের কম মাইনে কথা উল্লেখ করেছিল, যার ফলে চা শ্রমিকরা ধর্মঘট কিংবা চা শ্রমিকের কাজ ছেড়ে দিল। গান্ধীজি এই কথা উল্লেখ করেছিল STRONG TEA IS A POISON. 1942 সালে চা এর বিরুদ্ধে গান্ধীজি তার বই Arogya ni Chavi

গান্ধীজির সেই বই

 অনেককিছু উল্লেখ করেছেন। শোনা যায় গান্ধীজি নাকি ছাগলের দুধ খেত। 

স্বদেশী আন্দোলনের আগে চা এর বিজ্ঞাপন 

স্বদেশী আন্দোলনের পরে চা এর বিজ্ঞাপন 


এই স্বদেশী আন্দোলনের ফলে চা ব্যবসায়ীরা ঠিক চা যে ভারতীয় হাসিবে মানুষের কাছে প্রচার করতে হবে। আর চা ভারতীয় পানীয় আসাম ও দার্জিলিং উৎপাদন হচ্ছে, যার ফলে অবশ্যই চা ভারতীয় পানীয়। স্বাধীনতার পর চা জাতীয় পানীয় হয়ে যখন স্থানীয় ব্র্যান্ড গুলি চা উৎপাদন শুরু করে দেয়। আবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের চা পাওয়া যায় যেমন কাশ্মীরের চা বলতে বোঝায় কাওয়া (Kahwa) আবার লাদাখে বাটার চা জনপ্রিয়। তাহলে বুঝতে পারছেন কেন চা এত জনপ্রিয় ভারতে।

ঋণ স্বীকার শ্রী কৌশিক মজুমদার প্রণীত নোলা 

ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://medium.com/age-of-awareness/indian-tea-culture-and-its-british-roots-fd61d5ad7a8a

https://avtans.com/2017/06/05/how-indians-became-tea-totaller/

https://www.seriouseats.com/tea-for-everyone

Comments

Anonymous said…
দারুণ