কীভাবে তৈরি হলো বন্দে মাতরম ?

বন্দে মাতরম 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতে গেলেই প্রথমেই মনে বন্দে মাতরম এই গানটির কথা। 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 

অবশ্য, বন্দে মাতরম আসলে একটি কবিতা। বর্তমানে বন্দে মাতরম স্বাধীন ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত। মানে National Song আর জন গণ মন হলো ভারতের National Anthem যেটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন 1911 সালে। 1870 সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দে মাতরম কবিতাটি রচনা করেছিলেন। তবে বলা হয় 1875 সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশ পায়।

বঙ্গদর্শন পত্রিকা

 এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিন্তু একজন ভারতীয় আমলা ছিলেন। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন অর্থাৎ মহাবিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহ দাগ ফেলেছিল বঙ্কিমচন্দ্রের মনে, সেই সময় তিনি কলেজ পড়ছেন মানে 1857 সাল। 1858 সালে তিনি বিএ পাস করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করতে ঢোকেন। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেম বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত ধারনা। এবার বলি চাকরি তে যোগ দেওয়ার পর তিনি 1873 সালে ডেপুটি কালেক্টর পদে নিয়োগ হন এবং তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের জেলার ডেপুটি কালেক্টর এবং তাকে বহরমপুরে পাঠানো হয়। ওই সময় মুর্শিদাবাদের জেলার বহরমপুরেই ছিলেন কর্নেল ডাফিন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা। আর এই ব্রিটিশ অফিসারে সঙ্গে ঝামেলা বাঁধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। প্রতিদিনের মতোই একদিন পালকি করে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কী এক অজানা কারণে তার পালকি শর্ট কার্ট নিয়ে ছিল এবং এই রাস্তাটি ছিল ব্যারাক স্কয়ার মাঠের মধ্যে দিয়ে। সেই সময় নাকি কর্নেল ডাফিন ক্রিকেট খেলছিলেন, সেই মাঠে যেখান থেকে বঙ্কিমবাবুর পালাকি যাচ্ছিল। তখন নাকি ক্রিকেটে খেলায় বিঘ্ন ঘটে। অত্যন্ত রেগে জান ডাফরিন সাহেব, (হয়তো রান করতে পারছিলেন না।) পালকি থেকে জামা ধরে পালকি থেকে নামান বঙ্কিমবাবু কে তারপর চলল বঙ্কিমবাবুর ঘুষি। আবার বলা হয় যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পালিকি থেকে নেমে কর্নেল সাহেব কে বলেন "Who the Devil you are?” কারণ কর্নেল ডাফিন তার পালকি আটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মচারী এমন ব্যবহার, কেউ কেউ মেনে নেয় না। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মানেন নি, সরাসরি কর্লেন ডাফিনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর সমস্ত ঘটনার সাক্ষী ছিল অনেক জনসাধারণ। জানা যায় বঙ্কিমবাবুর পক্ষে দেড়শো জন আইনজীবী তাঁর পক্ষে ওকালতনামায় সই করেছিলেন। 1874 সালে আদালতে প্রথম শুনানি হয় এই কেসের, এবং আদালত জানান যে নিজের মধ্যে মিটমাট করে নিতে। অবশেষে খোলা আদালতে কর্নেল ডাফিন খোলা আদালতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ক্ষমা চান। আর এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জেলা জজ বেনব্রিজে, তিনি সেই সময় ক্রিকেট মাঠে উপস্থিত ছিলেন। আর তখনই আদালতের দর্শক আসন থেকে আবাওজ ওঠে, এর মানে একজন ব্রিটিশ সরকারের সামরিক অফিসারে অপমানিত হওয়া তাও আবার একজন ভারতীয় কাছে। এখানে উল্লেখ্য যে তখন আদালতে ব্রিটিশরা ঢুকতে পারতো। এই রকম পরিস্থিতিতে আদালতে একটি 'ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন' তৈরি করে দেয় এবং দেখা যায় যে সত্যি কর্নেল ডাফিন চেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে শেষ করে দিতে। এখানে উল্লেখ্য যে সেই ক্রিকেট মাঠে লালগোলার রাজা যোগীন্দনারায়ণ উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি আন্দাজ করেছিলেন যে কর্নেল ডাফিন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে নির্মুল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই জন্য অনেক গবেষক দাবি করেন যে 1873 সালে ক্রিকেট মাঠে বঙ্কিমচন্দ্রকে শারীরিক নির্যাতন এবং অপমান করার পর বন্দে মাতরমের ধারণাটি আসে বলে মনে করেন। আবার আরো একটি মত রয়েছে, লালগোলার রাজা যোগীন্দনারায়ণ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনুরোধ করেছিলেন যে বহরমপুর ছেড়ে রাজপ্রাসাদে গিয়ে থাকার জন্য। 

লালগোলা রাজবাড়ি 

হয়তো তিনি আন্দাজ করেছিলেন কর্নেল সাহেব আবারও কিছু করতে পারে। অবশেষে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে রাজি করিয়েছিলেন লালগোলার রাজপ্রাসাদে গিয়ে থাকার জন্য। বঙ্কিমবাবু ব্রিটিশ সরকার কাছে ছুটির জন্য আবেদন করেছিলেন, সেটা মঞ্জুর হয়। রাজপ্রাসাদে এখন অবশ্য সেটা রাজবাড়ি, সেখানে থাকার সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় আলোচনা মন দেয়, এবং সেখানে এক কালী মূর্তি দেখে তার মনে এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর মাতৃভূমি উপর একটি মাথার খুলি, এবং সেই মাতৃভূমি ক্রমশঃই শশানে পরিণত হচ্ছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন বন্দে মাতরম তৈরি হয়েছিল আধ্যাত্মিক, উপনিবেশিক এবং বুদ্ধিমত্তার মিলমিশ হয়ে। তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই সময় তৎকালীন অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, বলা হয় প্রথম ভারতীয় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তিনি তার অফিস ছিল বারাসাতে।

বারাসাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অফিস এবং বাড়ি ছবি সৌজন্যে জয়দীপ দাস

 চব্বিশ পরগনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কাজ করেছেন 1834 থেকে 1861 অব্দি। তারপর 1861 সালে 'যৌথ' পদ টি উঠে যায় পড়ে থাকে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট। সেই অফিসটি এখনো আছে তবে সেটা প্রায় পোড়ো বাড়িতে পরিনত হয়েছে। জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের দশ বছর আগেই বন্দে মাতরম গানটি স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিল। জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে এই গানটি 1896 সালে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবেশন করেন এবং গানটি সুরকার ও তিনি ছিলেন। আর এখানে উল্লেখ্য হল ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল 51-A(a) তে National Anthem কে সন্মান জানানো হলেও National Song কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।  

আর সব ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://www.indiatoday.in/india/story/august15-independence-day-national-song-vande-mataram-origin-bankim-chandra-chatterjee-chattopadhyay-1840927-2021-08-14
 

https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/bankimchandra-chattopadhyay-forgave-a-british-in-berhampore

Comments