তিতুমীর ও বারাসাত

তিতুমীর 

 

এই জায়গাটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একদম প্রথম দিকে উল্লেখ করা হয়, তখন জমিদার রাজ এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তার আগে জায়গাটির নাম কিছু কথা বলা দরকার। জায়গাটির নাম বারাসাত। বারাসাতে নাম কিভাবে হলো সেই দুটি তথ্য পাওয়া যায়, প্রথম বলা হয়েছে যে বারাসাত হলো একটি আরবি শব্দ, এর মানে হলো এভিনিউ আবার এও বলা হয় বারাসাত শব্দটির অর্থ হলো পথের শোভা। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে জগৎ শেঠ পরিবারের বারো জন সদস্য নাকি এখানে থাকতেন, তাই অনেকেই মনে করেন যে বারো শেঠের অপভ্রংশ হয়ে বারাসাত হয়েছে। আবার আরো একটি মত রয়েছে বারাসাতের নাম নিয়ে জানা গেছে এই বিশেষ ধরনের পুজোতে পুরো মূর্তি পুজো হয় না হয় মুন্ড মূর্তি পুজো। এই মুন্ডমূর্তিকে বলা হয় 'বারা'। সাতজন দেবীর 'বারা' এই মূর্তির দুই রূপ। পুরুষ ও নারী। বৈদিক পানপাত্রের নাম এদের নাম হয়েছে। বাংলার একটি বিশেষ স্থানে একসঙ্গে ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবির মুন্ডমূর্তি পুজো হত। পুজো পদ্ধতি তান্ত্রিক। সেখান থেকে এই জায়গার নাম হয়েছে, আর এই স্থানের নাম হলো বারাসাত। তবে বারাসাতের গল্প আরে একদিন বলা যাবে, আজকে বারাসাতের কথা বলছি কারণ তিতুমীর। 

তৎকালীন বারাসাতের map


বাংলার বিপ্লবীদের কথা বলতে গেলে তিতুমীর কথা বলতেই হবে। তখন ভারতে সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আর জমিদারা সাহেবদের নিজেদে কাজে ব্যবহার করা জন্য সাহেবদেরর বিভিন্ন ভাবে খুশি রাখতেন। তিতুমীর নাম নিয়ে ও একটা গল্প রয়েছে। তিতুমীর নাকি খুব অনায়াসে তিতো জিনিস খেয়ে নিতেন আর সেখান থেকেই নাকি "তিতু" নামটি এসেছে আর তিতুমীরের আসল নাম হলো সৈয়দ মীর নিসার আলী আর এখান থেকেই মীর নিয়ে হয়ে তিতুমীর। এই তিতুমীরের জন্ম হয় 1782 সালের 27 এ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার চাঁদপুরে, বর্তমানে এই জায়গাটির উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতে অবস্থিত। এখন বুঝতে পারছেন কেন প্রথমে বারাসাত দিয়ে শু করলাম। ছোট বেলা থেকেই তিতুমীরের সুঠাম স্বাস্থ্য ছিল। এরপর যখন স্কুলে তখন এখনকার মতো স্কুল ছিল না, ছিল পাঠশালা। পাঠশালায় চার বছর বয়সে ভর্তি হয় তিতুমীর। এরপর একে একে তিতুমীর শিখতে থাকে বাংলা, পার্সি, উর্দূ , অঙ্ক , আরবি এবং ফরাসি। এছাড়াও ছোটবেলা থেকেই তিতুমীর শিখেছিল অসি চালনা, তীর চালনা, মুষ্টিযুদ্ধ ও লাঠি খেলা প্রভৃতি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিতুমীর বিভিন্ন কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকে, এরপর একদিন কলকাতায় এক কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তিতুমীর। এবং সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিতুমীর। শোনা এরপর নাকি কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় তিতুমীরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতার এক জমিদারের সান্নিধ্য এসে তিতুমীর যুদ্ধ বিদ্যাও শিখেছিল, এরপর তিতুমীর আরো বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। তৎকালীন অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলার জমিদাররা তিতুমীরের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় অত্যাচারি জমিদাররা ব্রিটিশ সঙ্গে জোট বেঁধে তিতুমীর ভক্তদের উপর কর চাপাতে শুরু করে। তিতুমীর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। নীলকর সাহেবরা অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে বিভিন্ন ভাবে সাধারণ কৃষকদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে আর স্বাভাবিক ভাবেই তিতুমীরের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় তিতুমীরের পাশে দাঁড়াতে মিসকিন শাহ্‌ ও তার দলবল যোগদান করে। গোবরাগোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, নাগপুরের গৌড়ী প্রসাদ চৌধুরী, তারাকান্দির রাজনারায়ণ, গোবরডাঙ্গার কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের সাথে তিতুমীরের ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। প্রত্যেকেই সম্মুখ যুদ্ধে তিতুমীরের কাছে পরাজিত হয়। ফলে তিতুমীর তার সমস্ত এলাকা জুড়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে এবং হিন্দু-মুসলিম উভয়েই তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তার দলে যোগ দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে নদীয়া, চব্বিশ পরগনা কিছু অংশ তার দখলে চলে আসলে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং উক্ত অঞ্চল মিলিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে এটিই বারাসাত বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিত। সেই সময় তিতুমীর বারাসাত কে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে কোনো খাজনা দিতে অস্বীকার করে। এসব খবর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাছে পৌঁছালে, তিতুমীর কে শায়েস্তা করতে ব্রিটিশ কোম্পানি তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই সঙ্গে গোবরডাঙ্গা ও নদীয়া জেলার জমিদাররা ব্রিটিশ সঙ্গে হাত মিলিয়ে 1830 সালে তিতুমীর বাহিনীকে আক্রমণ করে। কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর এইসব শক্তি কে পরাজিত করে। তিতুমীর বুঝতে পেরেছিল এই রকম হামলা আরো হতে পারে সেই জন্য তিনি 1831 সালে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য নারকেলবেড়িয়া অঞ্চল বাঁশের কেল্লা তৈরি করতে উদ্যত হয়। কিন্তু এই রকম সময় তিতুমীর ও তার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায় কৃষ্ণদেব রায়, দিনটি ছিল অক্টোবর মাসের 29 তারিখ। কিন্তু কৃষ্ণদেব রায় ও হেরে যায় তিতুমীর বাহিনীর কাছে। আবার নভেম্বর মাসের 6 তারিখে আবার হামলা চালায় কৃষ্ণদেব রায় কিন্তু আবার ও হারের মুখ দেখতে হয়। কিন্তু তিতুমীরের উপর এই হামলা চালাতে সাহায্য করে ব্রিটিশরা। সেই সময় ব্রিটিশ নীলকুঠি ম্যানেজার ডেভিস বিভিন্ন ভারি অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে নারকেল বাড়িয়ায় হামলা করে। কিন্তু ম্যানেজার ডেভিস অবস্থার অবনতি দেখে পালিয়ে যায়। এই হামলার পর পর আরো এক জমিদার দেবনাথ হালদার নারকেলবেড়িয়া আক্রমণ করে এবং হেরে যায় এমনকি তিনি মারা গেছিলেন। আবার নভেম্বর মাসের 13 তারিখে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালায় কিন্তু তাও ব্রিটিশ বাহিনী হেরে যায়। 

উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক


কিন্তু তিতুমীর কে শায়েস্তা করার জন্য স্বয়ং তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক প্রশিক্ষত সৈন্যদল এবং অনেক গোলা বারুদ নিয়ে বারাসাতের উদ্দেশ্যে রওনা হতে বলেন কর্নেল স্টুয়ার্ট কে, বাঁশের কেল্লা হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিতুমীর বীরত্বের সঙ্গে লড়েছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে এবং একটি গোলার আঘাত প্রাণ হারান তিতুমীর। শোনা 250 জন কে গ্রেফতার করা হয় তাদের অনেকেই ফাঁসি এছাড়া বিভিন্ন কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এখন মনে রেখেছে তিতুমীর মতো শহীদ কে আমাদের শহর কলকাতা। 

ছবি সূত্র - internet 


Comments