কলকাতাকে রক্ষা করতে ওড়ানো হলো বেলুন !

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতার আকাশে বেলুন 

গত সপ্তাহে খবরের শিরোনামে এসেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমা। সেই বোমা ফাটানো হয়, কিন্তু যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময় কলকাতা কে রক্ষা করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। আসলে ব্রিটিশ সরকার ভাবতেই পারিনি যে কলকাতায় জাপানি বোমারু বিমান বোমা বর্ষণ করতে পারে।

যখন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারলো যে কলকাতায় জাপানি বোমারু বিমান আক্রমণ করবে তখন তারা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এই পদক্ষেপের মাধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বেলুন স্কোয়াড। প্রথমে বলে রাখা ভালো যে কী এই বেলুন স্কোয়াড! জানা যায় আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এইরকম বেলুন স্কোয়াড গঠন করা হয়, আসলে এই বেলুন স্কোয়াড ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে ম্যাপ হিসাব রাখতে বা প্লেনের উপর থেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সময় ও এই বেলুন স্কোয়াড ব্যবহার করা হয়েছে। জানা গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেলুন গুলি ব্যবহার করা হতো আর্টিলারি ডিভিশন গুলি আপডেট দেওয়া ও ডাঙ্গায় যেই সব সৈন্যদল আছে তেদের কাছে খবর পৌঁছানো। কিন্তু ক্রমে এই বেলুন স্কোয়াড আর কাজের ছিল কারণ দুটি শক্তি নিজের যুদ্ধ প্লেনে ব্যবহার করতে শুরু করলো। এবার হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। আমার প্রতিটি ব্লগে উল্লেখ করেছি অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আলাদা ছিলো না আসলে একটাই বিশ্বযুদ্ধ হয়ে ছিল, মাঝখানে সময়টা ছিল বিরতি। জানা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই বেলুন স্কোয়াডের বেলুন গুলি নতুন ভাবে ব্যবহার করা হয়। তখন এই বেলুন গুলি কে বলা হতো ব্যারেজ আবার এই বেলুন গুলি কে Blimps বলা হতো, এই বেলুন গুলি কে মাটির সাথে স্টিলের তার দিয়ে আটকানো থাকতো। শুধু একটা তার দিয়ে না অনেক গুলি তার দিয়ে। এই বেলুন গুলি ভরা থাকতো হাইড্রোজেন গ্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই বেলুন গুলির কাজ ছিল কোনো ব্রিজ কিংবা জাহাজ ডকের কে সুরক্ষা করা। এখন প্রশ্ন হলো ঐ বেলুন গুলো কীভাবে ব্রিজ কিংবা জাহাজ ডকে সুরক্ষা করবে ? আসলে বোমারু বিমান গুলি যখন বোমা বর্ষণ করতো একটু বিমান গুলি নিচে নেমে বোমা বর্ষণ করতো কিন্তু এই বেলুন গুলো বিমান কে নামতে দিত না। নিজের মারত্মক ক্ষতি হতে পারে এমনকি বেলুন সঙ্গে বোমারু বিমান গুলির বেলুন ক্রেশ হলে তো শত্রু পক্ষের ক্ষতি হতে বাধ্য। কিন্তু এই বেলুন গুলির কিছু অসুবিধাও ছিল যেমন যেহেতু এই বেলুন গুলি স্টিলের তার দিয়ে বাঁধা তাই, যদি কোনো সময় তার হালকা হলে বৈদ্যুতের সঙ্গে লাগতো তাহলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতো কারণ তার গুলো ছিল স্টিলের। আরো একটা বিপদ হলো যেহেতু স্টিলের তার ব্যবহার করা হতো তাই বেলুন গুলি ভারি হতো, তাই আক্রমণ হওয়ার আগেই এই বেলুন গুলি লাগানো হতো। কলকাতার বেলুন স্কোয়াড এর নাম ছিলো 978 বেলুন স্কোয়াড। কিন্তু এই বেলুন স্কোয়াড টি কলকাতার জন্য তৈরি হয়েনি, এই বেলুন স্কোয়াড তৈরি হয়েছিল সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য। জানা যায় যে অ্যাথলোন ক্যাসেল নামের জাহাজে লিভারপুল থেকে সৈন্যদল পাড়ি দেয় সিঙ্গাপুরে উদ্দেশ্যে, প্রথম এই জাহাজ থেমেছিল ফ্রিটাউন এবং পরে সেই জাহাজ থামে ডারবানে।

অ্যাথলোন ক্যাসেল 


 এই জাহাজ টি নয় সপ্তাহে পার হয়ে তার সিলন মানে এখনকার শ্রীলঙ্কা পৌঁছায়। তার মধ্যে উবোটের হামলা চালাবার ভয় ও ছিল, এখানে বলে রাখা দরকার উবোট এক ধরনের তৎকালীন জার্মান জাহাজ।

জার্মান ইউ বোট


 কিন্তু শ্রীলঙ্কায় এসে জাহাজের ক্রু মেমম্বার জনাতে পারে তাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি সমুদ্রের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তারা ঠিক করলেন শ্রীলঙ্কার যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করবে না তার পরিবর্তে অস্ত্র প্রশিক্ষণের একবার রিভাইস দিয়ে নেবে যতক্ষণ না পর্যন্ত অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায়। এই বেলুন স্কোয়াডের লিডার ঠিক করলো তার ফিরে যাবে, একটি ডাচ জাহাজ যার নাম ছিল এম এস সিবাজাকের মাধ্যমে কিন্তু জাহাজ টি প্রথম থেকেই খারাপ ছিল। 

এম এস সিবাজাক


শ্রীলঙ্কাতেই দেখা গেল সেই জাহাজের বয়লার খারাপ, তারপর ডারবানে পৌঁছানোর পর আবার দেখা যায় জাহাজটির আর এক সমস্যা। সেই সময় খবর এল মধ্যপ্রাচ্য অবস্থা খুব খারাপ তাই স্কোয়াডেন লিডার কে নির্দেশ এল তাঁরা আরএমএস মৌরেতানিয়া জাহাজ করে সুয়েজ খালের দিকে রওনা হয়, এবং ইসমাইলিয়া পৌঁছানোর পর তারা ইডেনের ( Aden ) দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে বেলুন স্কোয়াড বেলুন মাধ্যমে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হওয়ার পর, তাদের কাছে নির্দেশ আসে রেঙ্গুন দিকে রওনা হওয়ার জন্য। কারণ সেই সময় জাপানি সেনাবাহিনী রেঙ্গুন কে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলেছে আকাশ,স্থল, জল সবদিকে থাকে রেঙ্গুনকে ঘিরে ফেলা হয়েছে, এইরকম সময় একটি অস্ট্রেলিয়ান জাহাজ বাড়ি দিকে রওনা হচ্ছে ঐ জাহাজটির নাম কী ছিল তা জানা যায়নি, সেই জাহাজটির মাধ্যমে রেঙ্গুনে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। রেঙ্গুনে প্রতিরক্ষার দরকার সেই জন্য বেলুন স্কোয়াডেন নির্দেশ দেওয়া হলো বাহিনী নিয়ে রেঙ্গুন পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু সরাসরি যাওয়ার উপায় নেই, তাই এখনকার মুম্বাই তৎকালীন বম্বে হয়ে সিলনের দিকে পাড়ি দেওয়া। সিলনে পৌঁছে জানা জাপানি সেনাবাহিনী পুরোপুরি রেঙ্গুন কে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে তাই সেখানে গিয়ে আর লাভ নেই। এখন বেলুন স্কোয়াড গন্তব্য হলো কলকাতা। কারণ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আন্দাজ করেছিল জাপানি এবার টার্গেট কলকাতা, তাই কলকাতাকে বাঁচাতেই হবে জাপানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে, এমনকি চার্চিল আমেরিকা বলেছিলেন তাদের কিছু সৈন্যদল কে কলকাতা তে মোতায়েন করতে, হয়েছিলও তাই। আবার চার্চিল সরকারের ভয় ছিল আমেরিকা আবার ভারত কে সমর্থন না করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য, সেই জন্য আলাদা একটা বই প্রকাশিত হয়েছিল শুধু মাত্র আমেরিকার সৈন্যবাহিনীর জন্য। আবার বেলুন স্কোয়াডের কথায় ফিরি, কলকাতায় আসার পর বেলুন স্কোয়াড কে নিয়ে যাওয়া হয় ফোর্ট উইলিয়ামে। গার্ডেনরিচের কাছে খিদিরপুরের পাশে তখন জায়গাটি ছিল বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের সদর দপ্তর ওরফে BNR এর ওখানেই পাঠানো হয় এই বেলুন স্কোয়াডকে। ওদিকে তো জাপানি বোমারু বিমান যে কোনো সময় হামলা চালাতে পারে, তাই বেলুন স্কোয়াড তাদের কাজ আরম্ভ করে দেয়, কলকাতা কে রক্ষা করার জন্য। 978 বেলুন স্কোয়াডের নেতৃত্বে ছিলেন রবার্ট ওয়ালিস বেরেসফোর্ডের। 

রবার্ট ওয়ালিস বেরেসফোর্ডে


কলকাতার বেলুন স্কোয়াডের হেড অর্থাৎ স্কোয়াডেন লিডার রবার্ট ওয়ালিস বেরেসফোর্ডের সবচেয়ে বেশি বিবরন পাওয়া যায় কর্পোরাল হেনরি হার্ডির লেখা থেকে। জানা যায় রবার্ট ওয়ালিস বেরেসফোর্ডের ছিলেন রয়েল এয়ার ফোর্সের একমাত্র ব্যাক্তি যিনি বেলুন গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন এমনকি তিনি একজন রয়েল এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। কর্পোরেল হার্ডির লেখা থেকে জানা যায় রবার্ট ওয়ালিস বেরেসফোর্ডে পুরুষদের একটি দল গঠন করেছিলেন যারা কার্ডিংটনে স্কোয়াড্রনের অংশ হবেন এই দলটিতে বারো জন পুরুষ, একজন কর্পোরাল, একজন সার্জেন্ট এবং দুইজন অফিসার ছিল। নথিতে লিপিবদ্ধ করা কিছু নাম হল কর্পোরাল কোওয়ান, সার্জেন্ট ফ্রাঙ্ক কেইরানন, ডোনাভান, জোন্স, ফিটজপ্যাট্রিক, ডিকেসন, মরিসন, স্নো, অ্যালান, ইভেন্স, কক্স এবং অন্যান্য। এতো গেল স্কোয়াডেন লিডার কথা, এবার জানাই বেলুন হাইড্রোজেন গ্যাস ভরার জন্য হাইড্রোজেন গ্যাসের জেনারেটর গুলি গুলি রাখা হয়েছিল হুগলি নদীর তীরে। কারণ যদি বোমারু বিমান BNR এর ভবনের হামাল চালালে জেনারেটর ধ্বংস হয়ে যেত, তাই হাইড্রোজেন গ্যাসের জেনারেটর গুলি সম্পূর্ণ নিরাপত্তার স্বার্থে হুগলি নদীর তীরে স্হাপন করা হয়। আনন্দবাজার পত্রিকা সূত্রে জানা যায় বেলুন গুলি নাকি অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হয়েছিল। খিদিরপুর ডক, হাওড়া ব্রিজ, ফোর্ট উইলিয়াম, এসপ্লানেড মতো কলকাতার আরও বিভিন্ন যায়গায় এই বেলুন গুলি ব্যবহার করা হতো বোমারু বিমান হানা ঠেকানোর জন্য। বেলুন স্কোয়াড কে সাহায্য করবার জন্য আলাদা দশজনের একটি টিম, গঠন করা হয়।

এই ভাবে বেলুনে হাওয়া ভরা হচ্ছে 


 খিদিরপুর ডকের অনেক নৌকায় ব্যবহার করা হয়েছিল। এমনকি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অনেক সৈনিক ও এই সব কাজে সাহায্য করেছিল। 1942 সালে 10,16,28 ডিসেম্বর এবং 1943 সালে 17 এবং 23 জানুয়ারি এই সব মিলিয়ে খিদিরপুর ডকের উপর 131 বোম ফেলে জাপানি বোমারু বিমান। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল 23 তারিখের বোমা বিস্ফোরণে। জানা যায় সরকারি ভাবে হতাহতের সংখ্যা ছিল 70. অবশেষে তো জাপানি যুদ্ধে হেরে যায়। কিন্তু এই রকম সময় দেখা দেয় বাংলার দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষের সময় 978 বেলুন স্কোয়াড জামশেদপুর সহ রাজ্যের বিভিন্ন যায়গায় ত্রাণ বিতরণ করে। এই সফল অভিযানের জন্য রবার্ট ওয়ালিস বেরেসফোর্ডে বিশেষ প্রশংসা পত্র দেয়াও হয়।

সেই প্রশংসা পত্র 

 

সেই ফলক 


এখনো BNR এর সদর দপ্তরে মনে সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ের সদর দপ্তরে এখন একটি ফলক আছে যা বার বার কলকাতাকে মনে করিয়ে দেয় 978 বেলুন স্কোয়াড এর স্মৃতি এছাড়া ও ভবানীপুরের সমাধিক্ষেত্র অনেক রয়েল এয়ার ফোর্সের কর্মিদের সমাধি রয়েছে যারা 978 বেলুন স্কোয়াডের সদস্য ছিল এমনকি 978 স্কোয়াডন লিডারের সমাধি রয়েছে এই ভবানীপুরের সমাধিক্ষেত্রে। 

ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - আনন্দবাজার পত্রিকা 

http://www.bbrclub.org/75282_squadron_leader_robert_wal.htm

 

https://indianvagabond.com/2017/08/07/balloon-squadron-that-protected-calcutta-against-japanese/


https://roathlocalhistorysociety.org/tag/balloon-squadron/ 

Comments