কলকাতার শতাব্দী পুরনো ধোবি খানা!

সেই ধোবি ঘাট 

 এখন প্রায় সব বাড়িতেই চলে এসেছে ওয়াশিং মেশিন কাপড় কাঁচার যন্ত্র। তার আবার বিভাগ রয়েছে অটোমেটিক আবার সেমি অটোমেটিক এই সব। সেদিন টিভিতে মুন্না ভাই এম বি এস দেখছিলাম, তখন একটা খটকা লাগলো আচ্ছা আমাদের কলকাতায় তখনকার বোম্বে বা এখনকার মুম্বাই মতো ধোবিঘাট নেই? শুনেছি মুম্বাই এর ধোবিঘাট দেখতে বিদেশিরা আসে। তাই খোঁজ করতে গিয়ে দেখলাম আমাদের কলকাতায় ও একটি ধোবিঘাট রয়েছে। ঠিক ধরেছেন আজকের কলকাতার ধোবিঘাটের কথাই বলবো। জানা গেছে এস ডব্লিউ গুড তার বই মিউনিসিপ্যাল ক্যালকাটা ইটস ইনস্টিটিউশন ইন দেয়ার ওরিজিন অ্যান্ড গ্রোথ এ 1916 সালে এই ধোবি ঘাটের উল্লেখ রয়েছে। গুড সাহেব এর এই বইটি যখন প্রকাশিত হয় তখন গুড সাহেব ছিলেন মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের প্রাক্তন ডেপুটি কমিশনার। কলকাতায় কেন এবং কিভাবে ধোবি ঘাটের উদ্বোব হয়ে ছিল, সেই বিষয়ে গুড সাহেব আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে “1889 সালে বোম্বেতে ইতিমধ্যে খোলা ধোবিখানাগুলির অনুরূপ পাবলিক ধোবিখানা নির্মাণের জন্য চেয়ারম্যানের প্রস্তাব সাধারণ সমর্থনের সাথে মিলিত হয় এবং 1890 সালের জানুয়ারিতে কমিশনাররা এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেন, যার খরচ ঋণ তহবিলে চার্জ করা হয়। তদনুসারে 32,000 টাকা ব্যয়ে 3 নং উলফতবাগান রোড, কাসিয়াবাগানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু 1895 সাল পর্যন্ত আর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যখন বিল্ডিং এবং সরঞ্জামের জন্য প্রায় 37,000 টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল।" পরে অবশ্য এই জায়গাটির নাম হয় উডবার্ন পার্ক আর একটু পরে এই নামের কারণ টা বলছি। গুড সাহেব আরো বলেছেন যে "1896-97 সালে 23,400 টাকা ব্যয়ে 100টি ধোয়ার পাথর এবং পর্যাপ্ত পরিশ্রুত জল সরবরাহ করা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল।" পরবর্তীকালে 1906-7 নাগাদ তৎকালীন ব্রিটিশাধীন কলকাতা কর্পোরেশন ঠিক করে যে ঐ এলাকার সৌন্দর্যয়ন করা দরকার সেই জন্য উলফতবাগানের ধোবি ঘাটটি কর্পোরেশন কিনে নেওয়ার প্রস্তাব জানান মিস্টার গালস্টাউনও এই প্রস্তাবটি গ্রহন করেন। মিস্টার জেসি গালস্টাউন কর্পোরেশন কে একই সঙ্গে জানান যে ধোবি ঘাটের ও পুনর্বাসন বা বলা ভালো পুননির্মাণ করতে হবে। কর্পোরেশন রাজি হয় এবং শহরের যে কোনো জায়গায় কাচার জন্য একশোটি পাথর নির্মাণ করে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়ে ছিল, অবশেষে পুরনো কাঁসাইবাগানের কবরস্থানে চুক্তি অনুযায়ী ধোবি ঘাটটি পুননির্মাণ করা হয় এবং পাথর স্থাপন করা হয়। জানা যায় এই কবর স্থানে রয়েছে টিপু সুলতানের পুত্র ওয়াজিদ আলির কবর। 1901 সালে কবরস্থানে জমিটি ব্রিটিশরা দখল করেছিল। গুড সাহেব জানিয়েছেন যে কলকাতায় আরও ধোবি ঘাট বা ধোবি খানা তৈরি হয়েছিল, তার লেখা থেকে জানা যায় 1903-4 সালে কলকাতায় দশ হাজার পাঁচশ টাকা খরচ করে কুড়িটি কাপড় কাঁচার পাথর স্থাপন করা হয়েছিল তবে কাপড় কাঁচার পাথরের সংখ্যা ছিল ত্রিশ।

সেই পাথর 


 কিন্তু কেন এতো শোবো ঘাট বা খানা তৈরি হয়েছিল সেই সময় ? সেই বিষয়ে গুড সাহেব খোলাখুলি কিছু বলেনি। এর কারণ জানা যায় স্বাধীন ভারতে 1948 সালের ইন্ডিয়ান মেডিকেল গেজেট এ , যেখানে কর্পোরেশনের স্থ্যাস্থ অধিকর্তা এম ইউ আহমেদ জানিয়েছেন যে প্লেগ কলকাতায় নতুন নয়। 1898 সালে কলকাতায় প্লেগ আক্রমণ হয়, 1898 সালের এপ্রিল মাসের তিরিশ তারিখে শহর প্লেগ সংক্রমণ বেড়ে যায়, এবং মহামারি হিসেবে গণ্য হয়। আরো জানা গেছে যে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়। মার্চ এবং এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি প্লেগ আক্রমণ ও প্লেগের জন্য মৃত্যু হয় বেশি। আর এই কথাও প্রমাণিত হয় যে কলকাতায় 1948 সালে আবার প্লেগ আক্রমণ হয়। ব্রিটিশ সরকার সেই সময় বিভিন্ন ভাবে প্লেগ সমস্যা হাবুডুবু খাচ্ছিল এবং খুঁজছিল কিভাবে কাপড় জামা পরিষ্কার করা যায় আরও বৈজ্ঞানিক ভাবে করা যায়। সেই মেডিকেল গেজেট থেকে আরো জানা যায় যে 1898 সালে প্লেগের 247টি হামলা হয়েছিল যার মধ্যে 203টি ক্ষেত্রে লোক মারা গিয়েছিল। 1899 সালে, প্লেগের আক্রমণের সংখ্যা তীব্রভাবে বেড়ে 2,467-এ পৌঁছে এবং পরবর্তীকালে, মৃত্যুর সংখ্যাও 2,341-এ উন্নীত হয়। 1900 সালে এই সংখ্যাটি 8,822-এ 8,278 জন মারা গিয়েছিল এবং 1901 থেকে 8,611টি হামলার বিপরীতে 7,883টি এবং 1902 সালে 7,781টি হামলার বিপরীতে 7,278টি মৃত্যুর সাথে 1901 সাল থেকে কমতে শুরু করে। তবে গুড সাহেব উপরুক্ত ঘটনার কথা না লিখলেও তিনি কিছু ক্লু দিয়েছিলেন তার লেখার মধ্যে, গুড সাহেব জানিয়েছেন তখন যেই সব ধোবি খানা গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ গর্ভামেন্টে, সেগুলো শুধু মাত্র নাগরিক সুবিধা জন্য নয়। সেই ধোবি খানায় ধোপাদের স্বাস্থ্য আধিকারিকের অনুমোদন করা রাসায়নিক ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করা হতো না এবং কোনো রোগে আক্রান্ত বা সংক্রামক ব্যাধি আক্রান্ত ব্যক্তির কিংবা প্রাণীদের ( আমার ধারণা এখানে প্রাণী বলতে কুকুর, বিড়ালের কথা বলা হয়েছে ) এই সব ধোবি খানা ঢুকতে দেয়া হয় না। তবে যখন কসাঁইবাগানের সাথে হাজরা এবং ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের কাছে কর্পোরেশন নতুন ধোবি খানা তৈরি করে যার নাম রাখা হয় উডবার্ন পার্ক। এই নামের কারণ হল তৎকালীন সময়ে প্লেগ রোগ নিরাময়ে পি.জি. অর্থাৎ প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার স্যার জন উডর্বানের নাম অনুসারে এই জায়গাটির নাম করা হয়।

সেই ফলক 


 মোটামুটি ভাবে 24 একর জমি উপর তৈরি এই ধোবি ঘাটিতে 180টি পাথর দিয়ে স্থাপিত হয়েছিল, যার মধ্যে 1913-14 সালে 167 পাথর দখল করা হয়। গুড সাহেব লেখা থেকে জানা যায় ধোপাদের ব্যবহার করা প্রতিটি পাথরের জন্য মাসিক 2 টাকা এবং প্রতিটি সহকারীর জন্য মাসে অতিরিক্ত 1 টাকা দেয়।

"এই চার্জগুলি প্রদানের জন্য ধোপাকে একটি মাসিক টিকিট দেওয়া হয়, যার নাম এবং তার চাকরের নাম, যদি থাকে, ধোবিখানা সুপারভাইজার দ্বারা নিবন্ধিত হয়।" এখন এই ধোবি ঠিকানা হলো কলকাতার 62 রিচি রোড। কিন্তু এই ধোবি ঘাট ঢুকতে গেলে এর সালের ফলক দেখে চকম খেতে কারণ এর ফলকে সাল লেখা রয়েছে 1902 এর 15 আগস্ট কিন্তু সাহেব জানিয়েছেন এই ধোবি ঘাট স্থাপিত হয় 1903 থেকে 1904 সালের মধ্যে। তবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে 1902 সালে থেকে 1907 সালের মধ্যে এখানে ধোবি ঘাটের পুননির্মাণ করা হয়। এখন এই ধোবি খানায় 108 টি কাপড় কাঁচার পাথর রয়েছে, সেগুলি নয়টি সারিতে বিভক্ত আর প্রতিটি সারিতে 20 টি করে কাপড় কাঁচার পাথর রয়েছে। এখানে কাপড় ইস্ত্রি করা হয় ভারতে তথা বাংলায় পর্তুগীজরা ইস্ত্রি করার প্রচলন করে এখানে বলে রাখা দরকার বাংলায় ইস্ত্রি শব্দটি পর্তুগীজ ভাষা থেকেই এসেছে। 1910 সাল নাগাদ তৎকালীন কলকাতা কর্পোরেশন ঠিক করেছিল পাথর উপর কাপড় কাঁচার বদলে তার যায়গায় steam washing plant বসাবে হয়তো কোনো ব্রিটিশ গর্ভামেন্টে বড় অফিসার জামা কাপড় কাঁচার সময় ছিড়ে গেছিল সেই জন্য এই ব্যবস্থা নিয়েছিল কলকাতা কর্পোরেশন ইংল্যান্ড থেকে 1914-15 সালে 6925 টাকা খরচ করে মেশিন পত্র আনিয়ে ল্যান্সডাউন ধোবি খানায় একটি বিল্ডিং তৈরি করে যার খরচ পড়েছিল 4238 টাকা। 1913-14 সালে উত্তর ধোবি খানা থেকে আয় হয়েছিল 1069 টাকা আর দক্ষিণ ধোবি খানা থেকে 1914-15 সালে আয় হয়েছিল 6068 টাকা। কিন্তু এই সব করে কলকাতা কর্পোরেশন লোকসান হয়েছে ষোলো হাজার টাকা। কিন্তু এই লোকসান সহ্য করে নিয়েছিল তৎকালীন কলকাতা কর্পোরেশন। এখন এই ধোবি ঘাট কে মনে রেখেছে আমাদের কলকাতা সে যতই বাড়িতে বাড়িতে ওয়াশিং মেশিন আসুক না কেন! 

ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://www.getbengal.com/details/oldest-dhobi-khana-of-india-is-still-operational-in-kolkata

Comments