কীভাবে তৈরি হলো ভারতের আবহাওয়া দপ্তর

Alipore observatory, Kolkata 1877



 এখন আমাদের বাংলায় তীব্র দাবদাহ চলছে, যদি আজকের Times of India খবরের কাগজে বলা হয়েছে যে গত চব্বিশ বছরের এপ্রিল মাসের তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভেঙেছে 2024 এর এপ্রিল মাস। কিন্তু সাধারণ মানুষ বা খবরের কাগজ অথবা news channel এগুলো জানতে পারছে হাওয়া অফিসের মাধ্যমে। কোনো ঝড় আসতে চলেছে কিংবা কবে কালবৈশাখী হবে অথবা কতদিন বৃষ্টি হবে এই সবকিছু কিছু আমার জানতে পারি হাওয়া অফিসের মাধ্যমে। জানেন এই 2024 সালে আমাদের ভারতের আবহাওয়া দপ্তর বা হাওয়া অফিস 150 বছরে পড়লো। ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের কথা বলতে গেলে, অনেক বছর পিছনে যেতে হবে, জানেন ভারত অনেক আগে থেকেই এই সব বিষয়ে উন্নত ছিল। তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্ব আগেই প্রাথমিক ও দার্শনিক শিক্ষায় আবহাওয়া শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘোরে যার ফলে ঋতু পরিবর্তন হয়, এবং এই ঋতু পরিবর্তনের ফলে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হয় এই সব লেখা রয়েছে উপনিষদে। বরাহমিহীরের শস্ত্রীয় রচনা এবং বৃহৎসংহিতা লেখা হয়েছিল পাঁচশো বছর আগে, আর সেখানেও উল্লেখ ছিল আবহাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ের। সেখানে এই কথা উল্লেখ ছিল, যে ভারতবর্ষ কৃষি প্রধান দেশ এখানে বর্ষাকালে ভালো বৃষ্টিপাত হলে কৃষিকাজ ও ভালো হবে যার ফলে খাবারের অভাব হবে না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখানো হচ্ছে বৃষ্টিপাতের পরিমাপ এবং আরো বলা হয়ছে বেশি বৃষ্টিপাত হলে যদি বন্যা বা কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় তাহলে, রাজস্ব কম আদায় করা হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা গুলিতে ত্রাণকার্য করা হবে। কালিদাস তাঁর মহাকাব্য মেঘদুতম যা লেখা হয়েছিল সপ্তম শতাব্দীতে সেখানে বর্ষা শুরুর তারিখ পর্যন্ত বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে কিভাবে বোঝা যাবে কোনটি বর্ষার মেঘ। 1636 সালে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নাম হ্যালি, তিনি ভারতের গ্রীষ্মকালীন বর্ষার উপর ভিত্তি করে তিনি একটি বই প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে বলা হয়েছিল এশিয়ান ভূমির ভর এবং ভারত মহাসাগরের পার্থক্যগত উত্তাপের জন্য বাতাসের ঋতু পরিবর্তন হয়। অনেক মনে করেন সাতেরো শতকে থার্মোমিটার এবং ব্যারোমিটার আবিষ্কার এবং বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাসের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী আইন প্রণয়নের পরে এর অনত্যম বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল। 

এবার বলি ব্রিটিশরা ভারতের আবহাওয়া সম্পর্কে কী বলেছিল "ফ্যানি পার্কস তার ডাইরিতে গরম কলকাতার গরম সম্পর্কে 1823 সালের মার্চ মাসে লিখেছিলেন " প্রায় চার মাস হল কলকাতায় এসেছি, এর মধ্যে এ দেশের আবহাওয়া সম্বন্ধে আমার ধারণা একেবারে বদলে গেছে। মার্চ মাস থেকে গরম হাওয়া বইতে আরম্ভ করল। এ হাওয়া সহ্য করা কঠিন। হঠাৎ চুল্লির মুখ খুললে যেমন তাপ লাগে মুখে তেমনি এই সময় দুপুরে বাইরে বেরুলে গরম হাওয়ায় মুখ পুড়ে যায়। পারতপক্ষে দিনদুপুরে এই সময় কাজকর্ম করতে বেরুনো খুবই কষ্টকর।" আর বৃষ্টি সম্পর্কে লিখেছিলেন "সকালে খুব গরম ছিলো, কিন্তু এখন বৃষ্টি আসছে । মনে হচ্ছে আকাশের জানালার পাট খুলে গেছে, ভেতর থেকে জলের তোড় নেমে এসে পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে । বাজ পড়ছে, তীব্র বিদ্যুতের ঝলক । দেশে কখনো এরকম বৃষ্টি দেখিনি, কিন্তু এখানে কেউ অবাক হচ্ছে না । সব বাড়িতেই `কনডাক্টর' আছে।"  কলকাতার কথা উল্লেখ করলাম কারণ কলকাতা ছিল সেই সময় ভারতের রাজধানী। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঠিক করলো নতুন দেশের আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে হলে কিছু একটা করতে হবে, কারণ এই দেশের আবহাওয়া সম্পর্কে সাহেবদের কোনো ধারণা ছিল না। সেই কারণে 1785 সালে কলকাতায়, 1796 সালে চেন্নাই এবং আরো কয়েকটি জায়গায় ভারতের আবহাওয়া সম্পর্কে চর্চা করার জন্য বেশ কয়েকটি স্টেশন চালু করা হয়।

কলকাতায় এক আবহাওয়াবিদ হ্যারি পিডিংটং এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণাপত্রে 1835 থেকে 1855 সালে যেইসব গ্রীষ্মকালীন ঝড় হয়েছিল সেই নিয়ে মোট চল্লিশটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রে সাইক্লোন শব্দটি ছিল, পিডিংটং সাহেব এই শব্দটি তৈরি করেছিলেন যার মানে হলো সাপের মতো কুন্ডলি। এইরকম সময়ে 1864 সালে কলকাতা উপর এক ভয়াবহ ঝড় হয়, কলকাতা তখন আস্তে আস্তে গড়ে উঠছিল। সেই ঘূর্ণিঝড়ে অনেক মানুষের প্রাণ গেছিল বাড়ি ঘর প্রায় ধুলোয় মিশে গেছিল। এরপর সাত বছর বৃষ্টিপাতের অভাবে খরা আর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঐ আবহাওয়া চর্চার স্টেশন গুলি সেটা বুঝতে পারেনি। এই রকম পরিস্থিতিতে 1875 সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা এই বোঝার কলকাতায় প্রথম স্থাপন হয় আবহাওয়া দপ্তর বা বলা ভালো observatory। কলকাতার দ্বায়ীত্ব পান স্যার হেনরি ব্লানফোর্ড। তিনি 1886 সালে বর্ষাকালের forecast করেছিলেন। কলকাতার অবসাভেটির প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন স্যার জন এলিয়ট তিনি কলকাতার অবসাভেটির প্রধান হয়েছিলেন 1889 সালের মে মাসে। পরে অবশ্য আবহাওয়া দপ্তরের হেড অফিস প্রথমে শিমলা তার পর 

IMD, Pune – 1928


মহারাষ্ট্রের পুনেতে আর তারপর দিল্লি আবহাওয়া দপ্তরের হেড অফিস স্থাপিত হয়।

IMD, Delhi – 1944


 আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1923 থেকে 1926 অব্দি আবহাওয়াবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলনোবিসের অতিথি হিসাবে ছিলেন, এবং এখানে বসে তিনি কিছু কবিতা লিখেছিলেন বলে জানা যায়। প্রশান্ত চন্দ্র মহলনোবিস আলিপুর আবহাওয়া দফতর ছেড়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জানা যায় যে প্রশান্ত মহলনোবিস এবং তার স্ত্রী যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন রাণী মহলনোবিস নামে, তাঁরা কবিগুরুর আপ্যআয়ন করতেন নিজের কোয়ার্টারে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর নিচের তলায় একটি ঘর ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য, তবে তিনি ঐ চত্বরে একটা বড় বট গাছ ছিল সেখানে তিনি বসতে বেশি পছন্দ করতেন ঘরের তুলনায়। 

কবিগুরু 


এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ঘরে টিকে একটি ছোট্ট মিউজিয়াম পরিনত করা হয়েছে। বতর্মানে ভারতের আবহাওয়া দপ্তর আরো আধুনিক হয়েছে যার ফলে কোনো বড় ঝড় বা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কতটা সেই সব কিছু অনেক আগেই জনসাধারণ জানিদেয় ভারতের আবহাওয়া দপ্তর। 


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://imdweather1875.wordpress.com/2020/01/14/celebrating-145th-foundation-day-on-15th-january-2020-india-meteorological-department-inheritance-of-145-years-serving-the-nation/





Comments