কলকাতায় এখনো রয়েছে মাইকেল মধুসূদনের বাড়ি

অতুল বসুর আঁকা মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রতিকৃতি 

 

মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা সাহিত্যে যিনি সনেট সৃষ্টি করেছিলেন। এই বছর মধু কবির দুশো বছরের জন্মদিন। আমাদের কলকাতায়, মল্লিক বাজারের মোড়ের কাছেই রয়েছে কবির সমাধি। কবির সমাধির পাশেই রয়েছে তার স্ত্রী হেনরিয়েটার সমাধি।

মধু কবির সমাধি 


এখানে বলে রাখা দরকার সব সমাধি কিন্তু সমান নয়, আসলে এই সমাধি গুলির মধ্যে দিয়ে বোঝানো হয়েছে সমাজের ধ্বনি ও দরিদ্র মানুষের অবস্থান। সমাধি ক্ষেত্র ঢুকেই ডান দেখা যায়, "মধু বিশ্রাম পথ" এই রাস্তার শেষে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধি। মধু কবির সমাধিতে লেখা রয়েছে "দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল এ সমাধিস্থলে"। 



এবার বলি কলকাতায় মধু কবির বাড়ি কথা। মধুসূদন দত্ত যশরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কবে মধুসূদন কলকাতায় এসেছিলেন? জানা যায় মধুসূদন দত্তের বাবা রাজনারায়ন উকিল ছিলেন এবং তিনি কলকাতায় ওকালতি করতে এসে খিদিরপুর বাড়ি টি কিনেছিলেন। মধুসূদন দত্ত যখন যশর ছেড়ে কলকাতায় এই বাড়িতে এসেছিলেন তখন তার বয়স নাকি সাত বছর, সালটি ছিল 1831 এই তথ্য জানতে পারি মধুসূদন দত্তের জীবনীকার যোগীন্দ্রনআথ বসুর থেকে। মা জাহ্নবী দেবী সাথে মধুসূদন দত্ত এই বাড়িতে আসেনা । মধুসূদন দত্তের আরেক জীবনীকার গোলাম মুরশিদের মতে মধুসূদন দত্ত তার ছোটভাই মহেন্দ্রনারায়নের মৃত্যু পর তার মায়ের সঙ্গে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। মধুসূদন মহেন্দ্রনারায়নের থেকে চার বছরের বড় ছিল, মাত্র পাঁচ বছর বয়েসে তার মৃত্যু হয়। মনে করা হয় 1833 - 34 সাল থেকেই রাজনারায়ন তার স্ত্রী জাহ্নবী দেবী ও ছেলে মধুসূদন কে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন। খিদিরপুরের কাছেই ছিল হিন্দু কলেজ, সেখানেই 1837 সালে ভর্তি হন মধুসূদন দত্ত। তার আগে থেকেই কলকাতায় ইংরেজি চর্চা শুরু করেন মধুসূদন দত্ত। খিদিরপুরের এই বাড়ি থেকেই মধুসূদন অনেক চিঠি লিখেছিলেন তার বন্ধু গৌরদাস বসাকে, গৌরদাস বসাকে লেখা অনেক চিঠি পাওয়া যায় আর হ্যাঁ এও জানা যায় যে ঐ চিঠি গুলি লেখা হয়েছিল খিদিরপুরের বাড়ি থেকেই।

খিদিরপুরের কবির পৈতৃক বাড়ি 


 এই বাড়ি থেকেই মধুসূদন দত্তের ইংরেজি ভাষায় কাব্য রচনা শুরু হয়। চিঠি গুলির ঠিকানা ছিলো খিদিরপুরের বাড়ি। জানা যায় 1842 সালে মধুসূদন দত্ত বেন্টলিস মিসেলেনিতে যেই চিঠিতে কবিতা পাঠিয়ে ছিলেন সেইটি ও এই বাড়ি থেকেই। আরো জানা যায় যে এই বাড়িটি থেকেই মধুসূদন তার বন্ধু গৌরদাস বসাকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, যে তার মন একদম ভালো নেই। বাবা তার বিয়ে ঠিক করছেন আর মাত্র তিন মাস পরেই তার বিয়ে। মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন " At the expiration of three months from hence I am to be married; - dreadful thoughts! It harrows up my blood and makes my hair stand like quills on the fretful porcupine! My betrothed is the daughter of a rich zamindar;- poor girl! " অনেকে মনে করেন বাবার সাথে নানারকম সব ঝামেলার জন্য মধুসূদন খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। তার নতুন নাম হলো মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে হিন্দু কলেজ থেকে তাকে চলে যেতে হয় বাড়ির থেকে তো আগেই তাকে বের করে দিয়েছিলেন তার বাবা রাজনারায়ন দত্ত। তবে ছেলে কে খ্রিষ্টান ধর্ম নেওয়ার আগে শেষ চেষ্টা করেছিলেন রাজনারায়ন দত্ত। খিদিরপুরের বাড়ির প্রতিবেশী ছিলেন ভূকৈলাসের রাজা সত্যেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষাল, রাজনারায়ন দত্ত সত্যেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষাল কে বলেছিলেন তার লেঠেলদের নিয়ে মধুসূদন কে তুলে আনতে কিন্তু সেইটা হয়নি। হিন্দু কলেজ থেকে বেরিয়ে তিনি ভর্তি হন শিবপুরের বিশপস কলেজে।

সেই সময় হিন্দু কলেজ 


 1844 সালের 9 ফেব্রুয়ারি খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন মধুসূদন দত্ত। মনে করা হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর এই খিদিরপুরের বাড়ি থাকেন নি। কলকাতা থেকে মাদ্রাজে এখনকার চেন্নাই তে চলে আসে মধু কবি, একবারে শুন্য থেকে শুরু করে সবকিছু। মাদ্রাজে থাকাকালীন কবি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন এবং করেছেন সাংবাদিকতা। টিমথি পেনপোয়েম ছদ্মনামে তিনি কাব্য রচনা করেন মাদ্রাজে থাকাকালীন, সেই সময় 1848 সালে মধু কবির ইংরেজি কাব্য দ্য ক্যাপটিভ ল্যাডি প্রকাশিত হয়। জন ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন মধু কবি কে বলেন মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা করতে। এরপর সাত বছর মাদ্রাজে থাকার কবি কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। মাদ্রাজে থাকাকালীন কবি খবর পান তার বাবা রাজনারায়ন দত্তের মৃত্যু হয়েছে, এই খবর অবশ্য কবিকে তার পরিবারের লোক জানায় নি। এই খবর কবি পেয়েছিলেন তার বন্ধু গৌরদাস বসাকে লেখা চিঠির মাধ্যমে। কলকাতায় ফিরে এসে মধু কবি পুলিশকোর্টে কেরানির চাকরি নিয়েছিলেন, করছিলেন দোভাষীর কাজও। বলা হয় মায়ের মৃত্যুর পর খিদিরপুরের এই বাড়ি তে এসেছিলেন মধু কবি। এই বাড়ির জন্য তাকে অনেক মামলা মোকদ্দমা লড়তে হয়েছিল বলে জানা যায়। জাহ্নবী দেবী বেঁচে থাকাকালীন রাজনারায়ন দত্ত অনেক গুলো বিয়ে করেছিলেন আর সেই জন্য অনেক আত্মরিয়রা এই বাড়ি তে বসবাস করতেন। তারা চেয়েছিলেন এই বাড়ি নিজেদের হাতে রাখতে, সেই জন্য রাজনারায়ন দত্তের মৃত্যুর খবর তারা মধু কবি কে জানায় নি। রাজনারায়নের মৃত্যুর পর মধু কবি খিদিরপুর এই বাড়ি পুনরুদ্ধার করতে আসলে, কবি কে আত্মীয়দের মামলার মুখোমুখি হতে হয়। 

বর্তমান অবস্থায় কবির বাড়ি 


গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচালনা থেকে জানা যায়, এক সময় তো কবির আত্মীয়রা রটিয়ে দিয়েছিল মধুসূদন দত্ত মারা গেছে। অবশেষে কবি মামলায় জয় লাভ করে 1856 আবার অনেকে মনে করেন সালটা হবে 1861. কিন্তু কবি এই বাড়ি তে থাকেন নি। কবি চিঠির মাধ্যমে আন্দাজ করেছিলেন এই বাড়ি দাম হবে চার হাজার টাকা। কিন্তু মধু কবি তার এই বাড়ি বিক্রি করে দেন বিদেশে যাওয়ার জন্য। মধুসূদন দত্ত এই বাড়ি বিক্রি করেছিলেন তার প্রতিবেশী এবং ছোটবেলার বন্ধু রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই হরিমোহন বন্দোপাধ্যায় বা গনেশের কাছে সাত হাজার টাকায়। বাড়িটির পাশের জমি ও পিছনের জমি এক হাজার ছশোটাকায় মধুসূদন বিক্রি করেন ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্কের কর্মচারী জেমস ফ্রেডিকে। বাড়ি বিক্রির জন্য মধুসূদন দুঃখ প্রকাশ ও করেছিলেন। এই বাড়িটি একটু মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বাড়িটিতে দুটি সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট হয়েছে। খিদিরপুর যেহেতু মেটিয়াবুরুজের কাছে আর ওয়াজেদ আলি শাহ মেটিয়াবুরুজ ছিলেন, সেই জন্য এই বাড়িতে মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে আর এই বাড়ি যে সময় তৈরি হয় তখন ছিল ব্রিটিশ আমল সেই জন্য এখানে ইউরোপিয়ান কাজ ও দেখা যায়। ছাদ ও দেওয়াল ছিল বড় বড় আর ছিল বড় বড় জানালা, ঐ সব জানালা গুলো কে বলা হত ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। 

কত বড় জানালা 


যেহেতু বাংলার আবহাওয়া ব্রিটিশরা বেশি সহ্য করে পারত না আর বৃষ্টি বহুল অঞ্চল হওয়ায় সেই সময় প্রায় বেশিরভাগ বাড়ি ছাদ ছিল জলছাদ, সেই জন্য গরসকালে ঘর ঠাণ্ডা থাকতো। এই জলছাদ তৈরির জন্য চুন, সুরকি, গুড়, খড় এই সব মিশিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি হতো এই ছাদ। সাধারণ দোতলা বাড়ি হতো ( এখনকার মতো নয় ) বাড়ির ঠিক মাঝখানে থাকতো খোলা উঠোন। 

বলাহয় যে বিদেশ থেকে ফিরে এসে মধু কবি খিদিরপুর অঞ্চলে মনসাতলা লেনের একটি বাড়িতে থাকতেন তবে তার পৈতৃক বাড়ি তে না, সেই বাড়ি থেকে কবি তার সাহিত্য রচনা করেছিলেন। 25 তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী এখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির ঠিকানা ২০বি, কার্ল মার্ক্স সরণী। এই বাড়ি এখনো হেরিটেজ তকমা পায়নি, এই বিষয়ে নিয়ে কোনো নিস্পত্তি হয়নি। হেরিটেজ কমিশন খোঁজ খবর নিয়ে দেখে যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আমলে বাড়িটির কেনা বেচার কোনো নথি পাওয়া যায় নি। হেরিটেজ কমিটি বাড়ি আশেপাশে মাইকেল মধুসূদন নামে ফলক বা মূর্তি বসানোর কথা বলেছিল। অনেক হাত বদলের ফলে বাড়িটি তার বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে, তাও দুর থেকে দেখলে বোঝা যায় এই বাড়িটি বনেদি বাড়ি। অনেক ঝড় ঝাপটা মধ্যে ও এখন অব্দি টিকে রয়েছে মধু কবির বাড়ি।


ছবি সূত্র - Internet

তথ্য সূত্র - https://bangla.hindustantimes.com/bengal/kolkata/micheal-madhusudhan-datta-house-now-trying-to-sale-by-owners-31671426052187.html#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=17059992747411&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Fbangla.hindustantimes.com%2Fbengal%2Fkolkata%2Fmicheal-madhusudhan-datta-house-now-trying-to-sale-by-owners-31671426052187.html


https://eisamay.com/editorial/post-editorial/post-editorial-on-mudhusudan-duttas-house/articleshow/58640798.cms#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=17059145986287&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Feisamay.com%2Feditorial%2Fpost-editorial%2Fpost-editorial-on-mudhusudan-duttas-house%2Farticleshow%2F58640798.cms

Comments