কলকাতায় রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি সৌধ

লাস্কার ওয়ার মেমোরিয়াল 

 

আজকের গল্প একটি মিনার কে নিয়ে, অবশ্যই সেই মিনারটি কলকাতায় রয়েছে সমহিমায়। এই মিনারটি আবার war memorial হিসাবে বিখ্যাত। তবে আমাদের কলকাতায় খুব বেশি war memorial দেখা যায় না। কলকাতার এই war memorial বা মিনারটি রয়েছে হুগলি নদীর পূর্ব তীরে বিদ্যাসাগর সেতু কাছেই নেপায়ার রোডের উপর। এই পুরো এলাকাটি হেস্টিংস নামেই পরিচিত, এমনকি Google map এ এলাকাটিকে হেস্টিংস বলা হয়েছে।

Sir Charles Napier 

আর এই নেপার রোডের নাম করন হয়েছে Sir Charles Napier এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। নেপার সাহেব ভারতে এসেছিলেন 1841 সালে তবে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন কি না সেইটা জানি না। ভারতে ব্রিটিশ বাহিনীর প্রাক্তন চিফ কামান্ডার ছিলেন। এই সৌধটি চারটি মুখ যুক্ত, আর এই মুখগুলো আবার রাজকীয় বটে সেই জন্য TOI একে বলছে "majestic four-sided". কিন্তু এখন অব্দি এই সৌধটির নাম উল্লেখ করা হয়নি, এই সৌধটির নাম হলো লাস্কার মেমোরিয়াল। এবার জানা দরকার এই লাক্সারের মানে টা কী!

" লেখক, অমিতাভ ঘোষ, তার বিখ্যাত আইবিস ট্রিলজিতে ব্যাপকভাবে লাস্কারের উল্লেখ করেছেন। ট্রিলজির প্রথম বই, সি অফ পপিসে , তিনি লিখেছেন, "তিনি ভেবেছিলেন যে লাস্কাররা একটি উপজাতি বা জাতি, যেমন চেরোকি বা সিউক্স: তিনি এখন আবিষ্কার করেছেন যে তারা এমন জায়গা থেকে এসেছে যেগুলি অনেক দূরে ছিল এবং তাদের মধ্যে কিছুই ছিল না। সাধারণভাবে, ভারত মহাসাগর ছাড়া; তাদের মধ্যে ছিল চীনা ও পূর্ব আফ্রিকান, আরব ও মালয়, বাঙালি ও গোয়ান, তামিল ও আরাকানিরা।" হুবহু তুলে ধরলাম। এখানে বলে রাখা দরকার যে লাক্সার বা লাস্কারস একটি ফার্সি শব্দ, লাক্সারের মানে হলো নাবিক অথবা সামরিক বাহিনী বা ব্যাক্তিবর্গ যারা ভারত মহাসাগর থেকে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার গুদ অফ থেকে শুরু করে পূর্ব ফিলিপিন্সের পূর্ব দিক অব্দি বিস্তৃত। ইউরোপের বিভিন্ন জাহাজ গুলি তারা কাজ করতেন কুড়ি শতক অব্দি। আবার অনেকে মনে করেন আরবি শব্দ "আল - আসকর" এই শব্দটি এসেছে যার অর্থ প্রহরী বা সৈনিক।আবার পর্তুগিজ ভাষায় লাস্কারিয়ামের অর্থ এশিয়ান মিলিটারিম্যান বা নাবিক।

জানা যায় 1914 - 1918 মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় 896 জন লাক্সার ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জন্য লড়াই করেছিলেন এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। 896 জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই স্মৃতি সৌধ বা ওয়ার মেমোরিয়াল তৈরি করে। এই ওয়ার মেমোরিয়াল ডিসাইন করেছিলেন, উইলিয়াম ইনগ্রাম কিয়ার। এখানে বলে রাখা দরকার যে এই সৌধটিত ইন্দো মোঘল স্টাইল লক্ষ্য করা যায়, আবার এই কথা বলা যে চিত্তরগড়ের victory tower বা বিজয় স্তম্ভ এর সাথে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। ব্যাক্তিগত আমার তা মনে হয় না। এই কিয়ার সাহেব শুধু এই সৌধটি ডিসাইন করেছিলেন তা কিন্তু নয়, তিনি খিদিরপুর ব্রিজ, হাওড়ার শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড সাইন্স ইউনিভারসিটির বিল্ডিংটি তার ডিসাইন করা। এমনকি খরগপুর আই আই টি অর্থাৎ Indian Institute of Technology তারই ডিসাইন। 1934 সালের ভূমিকম্পে কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের চুড়াটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এই কিয়ার সাহেব চুড়াটি কে নতুন করে তৈরি করেন এবং সেই জন্য তিনি পাঁচশ টাকা পুরস্কার পান। আবার এই তথ্য পাওয়া যায় এই কিয়ার সাহেব লাস্কার মেমোরিয়াল এর ডিসাইন জন্য ঐ পুরষ্কার টি পেয়েছিলেন এইটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে 1920 সালে। 1924 সালের 6 ফেব্রুয়ারি লাস্কার ওয়ার মেমোরিয়াল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, সেই সময় বাংলার গর্ভনর জেনারেল ছিলেন লর্ড লিটন।

লর্ড লিটন 

সৌধটির চারদিকে চারটি মিনার দ্বারা বেষ্টিত এবং সৌধটির একদম উপরে একটি গম্বুজ রয়েছে।

সেই ফলক

লাক্সার মেমোরিয়াল ভিতরে কয়েকটি ফলক রয়েছে, একটি ফলক রয়েছে সেখানে কবে এই সৌধটি উন্মোচন করা হয় এবং তখন কে বাংলার গভর্নর জেনারেল ছিলেন। আর একটি ফলকে বলা হয়েছে 896 জন নাবিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এখানে একটি জিনিস লক্ষ্যনিয় যে "লাস্কার" কথাটির উল্লেখ নেই বরং তার যায়গায় বলা হয়েছে নাবিক, আরো বলা হয়েছে বাংলা আসাম এবং ভারতের নাবিক।

সেই ফলক 

 এই সৌধটি নাকি প্রায় ভুলেই গেছিল মানুষ TOI এর একটি খবর থেকে জানা যায়, 1980 সালে জনৈক উইলিমাস এর ছেলে জেমস কলকাতায় ঘুরতে এসে সৌধটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে খুব আফসোস করেন, তার এই আফসোস তিনি উল্লেখ করেছিলেন বলে জানা যায়। এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে যায় 1994 সালে এরকমই এক শীতের সকালে কামান্ডোর মোহান্তি মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে এই সৌধটির কথা জানতে পারেন এবং ঐ সৌধটির তাৎপর্য কথা জানতে পেরে তিনি সৌধটিকে ঠিক করার পরিকল্পনা করেন। সৌধটির ঠিক করার কথা জানতে পেরেছিলেন জেমস। এবং এই খবর ও পাওয়া যায় পরে তিনি সৌধটি দেখতে এসেছিলেন। জেমস এর খুব ইচ্ছে ছিল কামান্ডার বি কে মোহান্তির সঙ্গে দেখা করার, কিন্তু ততদিনে মোহান্তি সাহেব অবসর নিয়ে দিল্লীতে চলে গেছেন। দেখা কিন্তু তাদের হয়েছিল, দিনটা ছিল শনিবার জেমস হংকং থেকে দিল্লীতে নেমেছিলেন আর সেই দিন মোহান্তি সাহেব দিল্লী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাদের দুজনের দেখা হয়েছিল। জেমস বলেছিলেন মোহান্তি দেখেছিলেন বলে সৌধটিকে পুনরুদ্ধার করা গেছিল। 

দেওয়ালে Sir Charles Napier ছবির সঙ্গে তার ছেলে James Keir


তিনি আরো যোগ করেছিলেন ঐ সৌধটি পুনুরুদ্ধার না হলে তার বাবার এই অসামান্য কাজ হারিয়ে যেত এবং বাংলা ও আসামের নাবিকদের কথা ভুলে যেত, মোহান্তি সাহেব সৌধটিকে পুনরুদ্ধার করে তার বাবার অসমান্য কাজটি আবার জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেছেন এবং সেই সব নাবিকদের কথা তুলে ধরেছেন যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন।  

হ্যাঁ ঠিক ধরছেন এই জেমস হলো উইলিয়াম ইনগ্রাম কিয়ার সাহেব এর ছেলে। 

বর্তমানের Lascar War Memorial


লাস্কার মেমোরিয়াল এখন কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আছে। এখন লাক্সার ওয়ার মেমোরিয়াল দায়িত্ব রয়েছে স্বয়ং ভারতের নৌ বাহিনী। প্রতিবছর নৌ বাহিনী দিবস এখানে পালন করা হয়। চাইলে দেখে আসতে পারেন এই প্রাচীন সৌধটি যে বহন করে রেখেছে অনেক ইতিহাস ।


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://www.telegraphindia.com/my-kolkata/places/on-national-navy-day-a-look-back-at-lascar-memorial-and-its-significance/cid/1841848


https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/forgotten-war-memorial-gets-its-place-in-history/articleshow/17082206.cms


https://www.tutorialathome.in/history/lascar-war-memorial-monument


https://www.huffingtonpost.co.uk/shahida-rahman/the-lascar-memorial-90-ye_b_4756565.html

Comments