কিভাবে তৈরি হলো আলিপুর চিড়িয়াখানা

ভারতের প্রথম চিড়িয়াখানা 

 

শীত ঠিক ভাবে এখনো পড়েনি, কিন্তু ক্যালেন্ডার বলছে ডিসেম্বর। ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে বাঙালির বেড়ানোর অনত্যম ঠিকানা গুলির মধ্যে অন্যতম হলো আলিপুর চিড়িয়াখানা। আমাদের আলিপুর চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠার আলাদা একটা ইতিহাস রয়েছে, আজকে সেই গল্পটা বলবো। জানা যায় ভারতের প্রথম চিড়িয়াখানা হলো আমাদের আলিপুর চিড়িয়াখানায়।


আসলে আগেকার দিনে রাজা মহারাজা কিংবা নবাবরা নিজেদের মহলে শিকার করে জানোয়ার রাখতেন। অনেক সময় সাহেবরা জানোয়ার রাখতেন। বলা হয় 1802 কিংবা 1803 সালে গঙ্গার পাড়ে সাহেবদের মিলিটারি শিবির ছিলো যাকে বলা হতো ব্যারাক। ওখানে লর্ড ওয়েলসলি একটি বাগান বাড়ি তৈরি করেন, সেখানেই ছিলো পশু সংগ্রহশালা। সেই বাড়িটি বা পশুশালাটি ছিল ভারতের প্রথম চিড়িয়াখানা। আর যদি বলতে হয় আলিপুর চিড়িয়াখানার কথা, সেক্ষেত্রে জানা যায় ফর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য গার্ডেনরিচ অঞ্চলের পশু সংগ্রহশালাটি তুলে নিয়ে আশা হয় ব্যারাকপুরে। 

আলিপুর চিড়িয়াখানা
ছবি ঋণ - পুরানো কলকাতার চালচিত্র 


এই কাজটি করেছিলেন বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলি। এই চিড়িয়াখান বা পশুশালাটি তখনকার আধুনিকরুপ ছিলো। ওয়েলেসলি তার চিড়িয়াখানার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, ডাক্তার ফ্রান্সিস বুকানের উপর। ওয়েলেসলি চেয়েছিলেন তাঁর চিড়িয়াখানার কথা সবাইযেন মনে রাখে তাই তিনি তাঁর চিড়িয়াখানার ছবি আঁকা ও তার চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের বর্ননা করার জন্য আলাদা এক কর্মকর্তা নিয়োগ করেছিলেন।

লর্ড ওয়েলসলি 

আসলে ওয়েলেসলি চেয়েছিলেন ভারতের ইতিহাসে তার নাম যেন লেখা থাকে। ওয়েলেসলির চিড়িয়াখানার ঠিক কোথায় ছিলো ? বলা হয়, আজকের ব্যারাকপুরের চিড়িয়া মোড় যেখানে সেখানেই ছিলো ওয়েলেসলি বাগানবাড়ি বা চিড়িয়াখানা। এরপর বড়লাট হয়ে আসেন লর্ড আমর্হাস্ট। ইনি অবশ্য পশুসগ্রহশালার জন্য আলাদা কোনো উদ্যোগ নেয়নি, তবে আমর্হাস্ট সাহেবের চিঠি থেকে জানা যায় ব্যারাকপুরের সেই সংগ্রহশালা তে ছিল, আফ্রিকার সিংহ , তিব্বতের বাইসন। ক্রিকেটের মক্কা মানে ইডেন গার্ডেনে যার নামে অর্থাৎ জর্জ ইডেন যাকে সবাই চেনে লর্ড অকল্যআন্ডের বোন এমিলি ইডেন ব্যারাকাপুরের থাকার সময় পশু সংগ্রহশালা কথা বলেছেন, এমিলি ইডেন সেই সংগ্রহশালায় জিরাফ, গন্ডার, বেবুন দেখার কথা বলেছেন।

শুধু ব্রিটিশরা পশু সংগ্রহশালা বা চিড়িয়াখানার জন্য উদ্যোগ নেয়নি, সেই সময় কলকাতার বাবু সমাজ বা জমিদারেরা উদ্যোগ নিয়েছিলো। এই ক্ষেত্রে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন, কলকাতার জোড়াসাঁকোর অন্যতম জমিদার, রাজেন্দ্র মল্লিক।

রাজেন্দ্র মল্লিকের মার্বেল প্যালেস 

রাজেন্দ্র মল্লিক ছিলেন শিক্ষা অনুরাগী এবং পশুপ্রেমিক। কলকাতায় তিনি একটি মার্বেলের প্রাসদ তৈরি করেন। সেই প্রাসদের গল্প অন্য একদিন বলবো, সেই প্রাসাদের সামনের বাগানে মল্লিক বাবু পশু সংগ্রহশালা এবং পাখিরালয় তৈরি করেন। এই সংগ্রহশালা এবং পাখিরালয় শুধু শখের জন্য তৈরি করেননি মল্লিক বাবু। রীতিমত পড়াশুনা করেন মল্লিক বাবু, তার বাড়ির পশু সংগ্রহশালাটির খাঁচা গুলো যঠেষ্ট আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক ছিল। পশু সংগ্রহশালা কথা বলতে গেলে ওয়াজিদ আলি শাহ এর কথা বলতে হবেই। ব্রিটিশরা নবাব ওয়াজিদ আলি শা কে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত করে, নবাব মেটিয়াবুরুজকেই মিনি লক্ষনৌ তে পরিণত করে। নবাবের বলে অনেক রকম শখ ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো পশু সংগ্রহশালা।

ওয়াজিদ আলি শা 


 ওয়াজিদ আলি শা এর সংগ্রহে ছিলো চিতা, হরিণ, বাঘ, বাঁদর, জিরাফ, উট, গাধা আর তার সঙ্গে সারস, সাদা ময়ূর, বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, নানা প্রজাতির পাখি। শ্বেতপাথরের বাঁধানো পুকুরে ছিল রঙিন মাছ ও কচ্ছপ। জলাশয়ে কৃত্রিম পাহাড় তৈরি করে তাতে অজস্র সাপ পোষা হতো। তাছাড়া বাদশাহের ছিল প্রায় কুড়ি হাজার বিভিন্ন জাতের পায়রা।

জানা যায় ওয়াজিদ আলি শা রাজেন্দ্র মল্লিকে সাদা ময়ূর উপহার দিয়েছিলেন, সেই সাদা ময়ূর দেখা যেত মল্লিক বাবু মার্বেল প্যালেসে। নবাবের এই শখের কথা আমরা জানতে পারি আব্দুল হালিম শবরের

'বাদশাহী মেটিয়াবুরুজ' গ্রন্থ থেকে।

রাজেন্দ্র মল্লিক এবং ওয়াজিদ আলি শা মিলে ঠিক করেছিলেন কলকাতায় চিড়িয়াখানা তৈরি করবেন। ফেলুদার প্রথম উপন্যাস বাদশাহী আংটি তে এই তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলো কোনোটাই ব্রিটিশ সরকার গঠন করেনি, সবই ছিল শখের সে ওয়েলসলি থেকে শুরু করে ওয়াজিদ আলি শা পর্যন্ত।

ব্রিটিশ সরকার ঠিক করেছিল তাদের ঔপনিবেশিক গুলি তে চিড়িয়াখান তৈরি করার। কিন্তু তার বহু আগেই কলকাতায় পশু সংগ্রহশালা তৈরি হয়েগেছে, 1841 বা 1842 সালে ডাক্তার জন ম্যাকলেন্ড একটি প্রস্তাব পাস করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে, এই ম্যাকলেন্ড সাহেব ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির কিউরেটর, আর এই প্রস্তাবটির নাম ছিলো "Proposal to from a Zoological garden in Calcutta" কিন্তু তখন এই প্রস্তাবটিকে কেউ পাত্তা দেয়নি।

এরপর অনেক বছর কেটে গেল, 1873 সালে বাংলার গর্ভনর পদে যোগদেন রিচার্ড টেম্পল। উনি ঠিক করেন কলকাতায় একটা চিড়িয়াখানা দরকার, তাই ঠিক হলো কলকাতা চিড়িয়াখানা তৈরি হবে। গর্ভনর রিচার্ড টেম্পল এর আগে অবশ্য চিড়িয়াখানা তৈরি কথা বলেছিলেন 1867 সালে জোসেফ বার্ট, কিন্তু সেইটা বাতিল হয়ে যায়, কারণ হিসাবে বলা হয় জায়গার অভাব। সে যাই হোক টেম্পল সাহেব চিড়িয়াখানা তৈরি কাজ শুরু করান, অবশ্য প্রথমে অনেক যায়গা দেখা হয়েছিল কিন্তু শেষমেশ এখন যেখানে চিড়িয়াখানা দেখি সেখানে তৈরি হয় চিড়িয়াখানা। জানেন চিড়িয়াখানা তৈরির বাজেট কত ছিলো পাঁচ হাজার টাকা, এখন এই টাকার অঙ্ক অনেকের কাছে খুবই সাধারণ মনে হবে, কিন্তু তখন এই টাকা ছিলো অনেক বেশি। শেষমেশ চিড়িয়াখানা তৈরির কাজ শেষ হলো,কলকাতা চিড়িয়াখানা উদ্বোধন করতে এসেছিলেন সয়ং ইংল্যান্ডের রাজা প্রিন্স অফ ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড। 

রিচার্ড টেম্পল 

চিড়িয়াখানা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে মাধ্যমে 1876 সালে জানুয়ারি মাসে এক তারিখে উদ্বোধন করা হয়। একটা কথা বলা হয়নি, চিড়িয়াখানা 156 বিঘে জমির উপর তৈরি। চিড়িয়াখানা তো তৈরি হলো, এবার শুরু হলো চিড়িয়াখানার জন্য পশু পাখি সংগ্রহের কাজ। কার্ল লুই সোয়েন্ডলার ছিলেন পশু বিশেষজ্ঞ এবং এবং ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন তার বেক্তিগত সংগ্রহ শালা থেকে পশু চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয়। কলকাতা জমিদার রাজেন্দ্র মল্লিক চিড়িয়াখানায় নিজের মার্বেল প্যালেস থেকে বেশ কিছু দুর্লভ পাখি চিড়িখানায় উপহার দেয়, আর সেই জন্য চিড়িখানার প্রথম পাখিরালয়ের নাম মল্লিক হাউস। 

চিড়িখানার পাখিরালয়

বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ বাহাদুর চিড়িয়াখানেকে সেই সময়ে পয়ত্রিরিশ হাজার টাকা দান করেছিলেন, সেই টাকা দিয়ে বাঘ সিংহের খাঁচা তৈরি হয়। আর তাই খাঁচাটিকে বলা হয় বর্ধমান হাউস। 1876 সালের মে মাসের ছয় তারিখে সাধারণ মানুষের জন্য চিড়িখানার দরজা খুলে দেওয়া হয়, তখন চিড়িখানার পশুপাখিদের সংখ্যা ছিল একত্রিশ।

তবে একজনের কথা না বললে চিড়িখানার কথা শেষ হবে না, তিনি হলেন রামব্রহ্ম সান্যাল। তিনি চিড়িয়াখানার প্রথম ভারতীয় অধিকর্তা। রামব্রহ্ম বাবুর জন্ম লালগোলায়, 1851 সালের 15 ফেব্রুয়ারি। প্রশ্ন উঠতে পারে যে প্রথমেই তিনি অধিকর্তা পদে যোগ দিলেন ? না সেরকম মোটেই হয়নি।

রামব্রহ্ম সান্যাল


বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন 1869 সালে ভর্তি হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে, কিন্তু তাঁর চোখের সমস্যার জন্য তার ডাক্তারি পড়া সম্পূর্ণ হয়নি। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডাক্তার জর্জ কিং এবং ডাক্তার জন অ্যান্ডারসন তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। ডাক্তার জর্জ কিং ছিলেন বোটানির অধ্যাপক আর জন অ্যান্ডারসন ছিলেন অ্যানাটমির অধ্যাপক। রামব্রহ্ম বাবু চিড়িয়াখানায় যোগ দেয় অস্থায়ী কুলির সর্দার হিসাবে 1876 সালের 24 জানুয়ারি। চিড়িখানার কতৃপক্ষ খুঁজছিলেন এমন একজনকে যিনি জীবজন্তুর বিষয়ে আগ্রহী হবেন এবং চিড়িখানার কাজ করতে পারবেন। চিড়িখানায় রামব্রহ্ম সান্যাল বাবুকে জর্জ কিং সাহেব নিযুক্ত করেছিলেন। রামব্রহ্ম বাবু চিড়িখানার হেডবাবুর দায়িত্ব পান 1877, তিনি পশুশালাটির নাম দেন "আলিপুর জীবনিবাস" তার উদ্যোগে চিড়িখানার পশুপাখিদের বিজ্ঞানসম্মত নামের উল্লেখ করা হয়। রামব্রহ্ম বাবু সাধারণ কর্মচারী হিসাবে যোগদান করেন ঠিকই কিন্তু তার কর্মদক্ষতা দেখে কিং সাহেব ও অ্যান্ডারসেন সাহেবের সুপারিশে 1879 সালে রামব্রহ্ম বাবুকে চিড়িয়াখানার সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত করে। 


তাই একবার অবশ্যই আলিপুর চিড়িয়াখানায় ঘুরে আসবেন।

 ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://inscript.me/christmas-2022-history-of-alipore-zoo-first-zoo-of-west-bengal-in-barrackpore


 https://www.anandabazar.com/rabibashoriyo/ram-brahma-sanyal-the-first-superintendent-of-the-alipore-zoological-gardens-in-kolkata-1.1100381#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=17019326346739&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Fwww.anandabazar.com%2Frabibashoriyo%2Fram-brahma-sanyal-the-first-superintendent-of-the-alipore-zoological-gardens-in-kolkata-1.1100381


https://thebengalstory.com/%e0%a6%95%e0%a6%b2%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%9a%e0%a6%bf%e0%a6%a1%e0%a6%bc%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be/

Comments