মহালয়ার সাথে দুর্গাপুজোর কি সম্পর্ক ?


 

গতকাল ছিল মহালয়া। নিশ্চয়ই সকালে উঠে রেডিও তে শুনেছেন মহিষাসুরমর্দিনী। এখন অবশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়, বিভিন্ন চ্যানেল বিভিন্ন নামে সম্প্রচার করে। কিন্তু মহালয়া ব্যাপারটা ঠিক কি ? আর মহালয়া সাথে দুর্গা পুজো ঠিক কি সম্পর্ক! এককথায় বলতে গেলে মহালয়ার সাথে দুর্গাপুজোর কোন সম্পর্ক নেই। পন্ডিত ও গবেষকদের মতে অগ্নিপুরাণে বলা হয়েছে যে মহালায় দিনটিতে পিতৃপুরুষ বলে রাখা ভাল পিতৃপুরুষ বলতে শুধু মাত্র দাদু কে বোঝাচ্ছে না, দিদা কে ও বোঝাচ্ছে তারা স্বর্গ লোক থেকে অনেকটা নিচে নেমে আসে। তবে সারা দিনের জন্য নয়, একটা নির্দিষ্ট সময়ে। 

তর্পণ

আর বলা হয় বলা হয় সেই সময় গঙ্গা স্নান করে পিতৃপুরুষ কে জল দেওয়া হয়, আর তাদের আর্শীবাদ লাভ হয়। জলের সাথে মন্ত্র পাঠ ও করাহয়, এই মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে শুধু পূর্বপুরুষ নয় তার সাথে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সাথে অন্য দেবতাদের ও জল দান করা হয়। তার সাথে সপ্তর্ষি ও পিতামহ ভীষ্মকে জল দান হয়ে থাকে। তার নাম হলো তর্পণ‌, এবার বলি তর্পণের গল্প সেই জন্য মহালায় কে কেন্দ্র করে একটু মহাভারত যাওয়া দরকার, মহাভারতে কর্ণ মৃত্যু বরণ করে স্বর্গে গেল, কিন্তু কর্ণকে স্বর্গে খেতে দেওয়া হলো সোনা ও রত্ন। কর্ণ তো অবাক এগুলো খাবে কি করে ?জিজ্ঞেস করে কর্ণ, তখন কর্ণ কে বলা হয় তুমি ভালো কাজের জন্য স্বর্গে আসতে পেরেছো, কিন্তু তুমি তোমার পিতৃপুরুষ কে জল দান করনি কিন্তু অনেক সোনা দান করেছো সেই জন্য তোমাকে সোনা ও রত্ন খেতে দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ বলে ধর্মরাজ এইখানে আমার দোষ কোথায়, আমার জন্মের পর মা আমাকে ত্যাগ করে জলে ভাসিয়ে দেন,তারপর সূতবংশিও অধিরত ও তার স্ত্রী রাধা আমায় উদ্ধার করে লালন পালন করে। ( এই অধিরত হলো ভীষ্মের রথের সারথি ) এরপর আমার বিক্রম আর সৌর্য দেখে দুর্যোধন আমার বন্ধু হয় এবং অঙ্গরাজ্যের রাজা হিসাবে গ্রহণ করে। এরপর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগের দিন আমার আসল মা কুন্তি ও কৃষ্ণ আমাকে আমার বংশ পরিচয় জানায়। এরপর তো যুদ্ধ আরম্ভ হয়, মাত্র আর ষোলো সাতেরো দিন বেঁচে ছিলাম আমি, পিতৃপুরুষ কে জল দেওয়ার সময় তো পেলাম না ধর্মরাজ।  কর্ণ ধর্মরাজ কে প্রশ্ন করলেন উপায় কি আমি কি আর খাবার ও জল পাব না?

কর্ণ

ধর্মরাজ এবার বললেন উপায় অবশ্য একটা আছে, তোমাকে আবার মত্য লোকে ফিরে যেতে হবে, আর সেখানে গিয়ে পিতৃপুরুষ কে জল দান করতে হবে তবেই তুমি স্বর্গ লোকে তুমি খাবার পাবে। অনেক মনে করেন এই ধর্মরাজ ইন্দ্র অথবা যমরাজ, তার নির্দেশে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপ্রতিপদ তিথি তে কর্ণ মত্য লোকে ফিরে আসেন এবং একপক্ষকাল থেকে পিতৃপুরুষকে তিল জল দান করেন। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে শেষ জলদান করে স্বর্গে ফিরে যান। এই বিশেষ সময়টিকে পিতৃপক্ষ বলা হয়েছে, পিতৃপক্ষের শেষ দিন কে বলা হয়। আর জলদান বলা হয় তর্পণ। আবার আরো একটা দিক থেকে দেখতে গেলে, বেদের বিভাজন অনুযায়ী, তর্পণ কে বেদ অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে। যেমন ঋকবেদি তর্পণ, সামবেদি তর্পণ, যজুবেদি তর্পণ। পিতৃপক্ষ শেষ হলে শুরু হয় দেবীপক্ষ, ধারণা করা যায় সূর্যের এই সময়ের গতিপথ কে নাকি বলা হয় দক্ষিণায়ন। এই সময় হলো দেবতাদের ঘুমানোর সময়, কিন্তু রামচন্দ্র এই সময় দেবী দুর্গার আরাধনা করেন যাকে বলা হয় অকাল বোধন।

অকাল বোধনের রামচন্দ্র এবং দেবী দুর্গা


 এখন সেই রীতি অনুযায়ী ষষ্ঠীর দিন দেবী দুর্গার বোধন বা ঘুম ভাঙানো হয়। বাঙালিদের কাছে দেবী দুর্গা হলো বাড়ি মেয়ে, এই সময় তিনি তার চার ছেলে মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন ঘুরতে। 

আবার দেখুন একদিকে আমার বলছি মা দুর্গা  আবার অন্যদিকে বলছি মহিষাসুরমর্দিনী।মহিষাসুরমর্দিনী একটু ব্যাখাটি দিয়ে নেওয়া দরকার, মহিষাসুর নামে একজন অসুর অনেক দিন ধরে দেবতাদের বিরক্ত করছিলেন কিন্তু কোনো দেবতা তাকে ধংস করতে পারছিলনা কারণ ব্রক্ষার আশির্বাদ ছিল যে কোনো দেবতা কিংবা মানুষ তাকে ধংস করতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে সব দেবতরা গেল ব্রক্ষার কাছে, আর ব্রক্ষা সব দেবতাদের নিয়ে গেল শিব ও বিষ্ণুর কাছে। সব কিছু শুনে তার ঠিক করল একজন নারী একমাত্র মহিষাসুর কে বধ করতে পারে, তাই জন্য শিব তৃতীয় নয়ন থেকে সৃষ্টি হলো এক নারী, সব দেবতরা তাকে বিভিন্ন অস্ত্রে সুসজ্জিত করে যুদ্ধে পাঠালো সেই যুদ্ধ নয় দিন আর শেষ বধ হলো মহিষাসুর। আবার দেবী দুর্গার আরো একটা ব্যাখা পাওয়া যায় পুরাণে, বলা হয়েছে রুরু অসুরের ছেলে হলো দুর্গম। এই দুর্গম খুব মহাপরাক্রমী, দুর্গম হিমাচলে তপস্যা করতে শুরু করে, উদ্দেশ্য একটা দেবলোকে কে ধ্বংস করা। তপস্যা শেষে ব্রক্ষা তাকে দেখা দিল, দুর্গম বর চাইলেন দেবকুল কে ধ্বংস করার ব্রক্ষা বর দিলেন ব্যাস দেবলোক শুন্য  হয়ে গেল মর্ত্যলোকে আশ্রয় নিল দেব কুল শুরু অনাবৃষ্টি অনেক মানুষ ও মারা গেল দেবতা ও মানুষের প্রার্থনায় সৃষ্টি হলো দেবী দুর্গার, তার চোখে জলে শেষ পর্যন্ত শুরু হলো বৃষ্টি। সেই দেখে দেবী দুর্গার বিরুদ্ধে যুদ্ধা ঘোষণা করলো দুর্গম অসুর। এখানে দেবীর নাম হলো শতাক্ষী। অবশেষে দুর্গম কে পরাস্থ করে দুর্গম অসুর কে ধ্বংস করে দেবী হলেন দুর্গা। মহিষাসুরমর্দিনী ও দুর্গা পুজো তে কিন্তু চন্ডি পাঠা অতপ্রতো ভাবে জড়িতো। এবার বলি কিভাবে মহালায় দিনটি আসলেই মনে হয় দুর্গা পুজো শুরু হয় গেছে, আসলে এইদিনে ভোরবেলায় রেডিও অনুষ্ঠিত হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের "মহিষাসুরমর্দিনী"। 1977 সালে আকাশবাণী কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় রেডিও অনুষ্ঠান, যা কিনা এখনো অব্দি সম্প্রচার করা হয়। তবে শুরুটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিলো না‌। 

আকাশবাণী ভবন

1930 সালে ভারতের বেতার সরকারিকরণ করা হয়, তার পর 1932 সালে বাণী কুমার মার্কন্ডেয় চণ্ডীর অবলম্বনে "বসন্তেশ্বরী" নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন এবং সেখানে কয়েকটি শ্লোক পাঠ করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং বাণী কুমার। আর সেই অষ্টমীর সেইটা রেডিও তে বাজানো হয়েছিল। আবার 1936 সালে মহিষাসুর বধ কে কেন্দ্র একটি গান বাজনা সহযোগে গল্প শোনানো হয়েছিল কিন্তু এই অনুষ্ঠানের কোনো নামকরণ হয়েছিল না, ঐ অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়েছিল ষষ্ঠীর দিনে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চন্ডী পাঠ অনুষ্ঠানটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

মহিষাসুরমর্দিনীর তিন স্তম্ভ


আর অনেক গুনি মানুষ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী‌ প্রমূখ। 1936 সালের পর মহিষাসুরমর্দিনী লাইভ সম্প্রচার করা হতো ভোর রাতে স্নান সেরে গরদের জোড় আর কপালে চন্দনের ফোঁটা থাকতো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। জানা যায় তিনি নাকি ঘোর নাস্তিক ছিলেন। এই অনুষ্ঠানের রিয়াসাল খুব নিয়ম অনুযায়ী হতো পঙ্কজ মল্লিক হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন আর তার পাশে গোল করে বসতো শিল্পীরা, কারণ একটাই কোরাসে যাতে গন্ডোগোল না হয় আর তাই সব শিল্পী কে রিয়াসালে আসতে হতোই। 

রিয়াসালের সময় 


হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন মহিষাসুরমর্দিনীর সাথে অতপ্রতো ভাবে জড়িতো ছিলো, তার গলায় হতো "জাগো দুর্গা" গানটি কিন্তু 1950 সালে সেনিমায় ব্যাস্ত থাকার কারণে রিয়াসালে আসতে পারছেন না, তাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অনুরোধ করছিলো যে তাকে রিয়াসাল থেকে বাদ দেয়া জন্য, কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে কয়েক দিন রিয়াসাল করে গানটি করে দেবেন। কিন্তু বাণী কুমার এই অনুরোধ রাখন নি, বাণী কুমার স্পষ্ট বক্তব্য ছিলো যে যত বড় শিল্পী হও না তুমি, সবার সঙ্গে নিয়ম মেনে রিয়াসাল করতেই হবে, নইলে সেইটা বাকিদের প্রতি অবিচার হবে। বাণী কুমার পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাদ দিতে হবে। ঠিক হলো সচিন গুপ্ত কে দিয়ে গান গাওয়ানো হবে, কিন্তু তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে, অবশেষে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় গান গায়। এর আগে তিনি কোরাসে ছিলেন। তিন দশক ধরে লাইভ সম্প্রচার হতো মহিষাসুরমর্দিনী। এরপর 1962 সালের শেষ দিকে ঠিক হয় মহিষাসুরমর্দিনী রেকর্ড করে বাজানো হবে। এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ হলো ভারত চীন যুদ্ধ।  


এইভাবেই প্রতিবার মহালায় বাঙালি রেডিওতে শোনে মহিষাসুরমর্দিনী আর তাই মহালায় থেকেই শুরু হয় যায় পুজোর দিন গোনা।


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://www.anandabazar.com/editorial/mahalaya-has-no-connection-with-durga-puja-1.1052347#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16967013222891&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Fwww.anandabazar.com%2Feditorial%2Fmahalaya-has-no-connection-with-durga-puja-1.1052347


https://media.banglabhumi.in/mahalaya/


https://www.anandabazar.com/editorial/a-short-history-of-birendra-krishna-bhadra-s-mahisasura-mardini-in-all-india-radio-kolkata-1.1052232#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16971030857027&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Fwww.anandabazar.com%2Feditorial%2Fa-short-history-of-birendra-krishna-bhadra-s-mahisasura-mardini-in-all-india-radio-kolkata-1.1052232


https://www.prohor.in/mahishasur-mardini-rediscovered-mahalaya-and-made-the-day-special

Comments