সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী যিনি বাঙালিকে ক্রিকেট খেলা শিখিয়েছিলেন

সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী 

 কদিন আগে এশিয়া কাপ হয়ে গেল, ভারতের ক্রিকেট দল এবার এশিয়া কাপ জিতেছে। এই নিয়ে আটবার ভারত জিতলো এশিয়া কাপ। আর এবার লক্ষ্য বিশ্বকাপ জিতে নেওয়া। আর কয়েকদিন বাদেই তো Icc Cricket World Cup. আমাদের বাংলায় ফুটবল ও ক্রিকেট নিয়ে অনেক উন্মাদনা। আজকে সেইরকম একটা গল্প বলবো এক বাঙালি ক্রিকেটারের, ইনি হলেন শ্রী সারদা রঞ্জন রায়, তাকে বলা হতো বাংলার ডব্লু জি গ্রেস। ইনি ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড়দা। শুরু থেকে আরম্ভ করাযাক, 1861 সালে শীতের সময় কিশোরগঞ্জের কাটিয়াদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সারদারঞ্জন বিখ্যাত রায় পরিবারের। সারদারঞ্জনের বাবা ছিলেন জমিদার কালীনাথ রায়। সারদারঞ্জন ছিলেন সবার বড় ভাই। বাকিরা হলেন কামদারঞ্জন মানে উপেন্দ্রকিশোর, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমোদারঞ্জন, আর তিন বোন হলো গিরিবালা, ষোড়শীবালা এবং মৃণালিনী। এই পাঁচ ভাই কিন্তু ভালো ক্রিকেট খেলতেন। শোনা যায় এই কাটিয়াদি গ্রামের মানুষের একটা চেনা ছবি ছিল ধান খেতে কাঁদা মাখা অবস্থায় এক কিশোর, যার একহাতে ব্যাট আর অন্য হাতে বই। সারদারঞ্জন পড়াশুনাতে খুব ভালো ছিলেন। তখন কিশোরগঞ্জ ছিলো ময়মনসিংহের একটি অংশ। জানা যায় সেই সময় বাংলাদেশের অন্যতম বিত্তবান অংশ ছিল এই ময়মনসিংহ। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন সারদারঞ্জন। মাইনর স্কুলে থেকে ময়মনসিংহের জেলা স্কুলে ভর্তি হন সারদারঞ্জন। সেখান থেকে এডমিশন টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করে ঢাকা কলেজে পড়াশুনা করেন এবং বিএ পরীক্ষায় ফার্স্ট হন সারদারঞ্জন, পুরো ঢাকা অঞ্চলে। তিনি কলকাতায় সংস্কিত পড়তে এসেছিলেন একটি বৃত্তি নিয়ে, সেই বৃত্তি নাম ছিলো 'প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ'। কিন্তু কলকাতার পড়া না শেষ করে তিনি অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সারদারঞ্জনের ক্রিকেট প্রেম কিন্তু একটু কমেনি। ঢাকা কলেজে চারভাই পড়তো, আর  চারভাই আর সারদারঞ্জন মিলে গড়েতোলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। 

ব্যাট হাতে সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী 

যেই সময় কথা বলছি তখন ক্রিকেটের ছিল শুধু সাহেবি খেলার মধ্যে আবদ্ধ, আর  মধ্য ও পশ্চিম ভারতীয়দের মধ্যে মিথ ছিলো যে বাঙালিদের গায়ের জোর কম অন্যদের থেকে, এই ধারণা কে ভেঙে ফেলার জন্য ঢাকা কলেজে ক্রিকেটের পাশাপাশি আলাদা ভাবে শরীর চর্চার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী। আলিগড়ের ছাত্রদের ক্রিকেট শিখিয়েছিলেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী। আলিগড় থেকে আবার বদলি হয়ে তিনি চলে আসেন, ঢাকা কলেজে। সেই ক্রিকেট খেলা হতো ব্রিটিশদের আর বাবু বা অভিজাত ভারতীয়দের মধ্যে। সারদারঞ্জন এই ব্যাবধান ভাঙতে উদ্যত হয়েছিলেন, তিনি ও তার চার ভাইয়ের তৈরি ক্রিকেট ক্লাব, যে কথা আগেই বলেছি এই ক্লাবটি তৈরি হয়েছিল 1880 তে, আস্তে আস্তে ক্রিকেট প্রসার ঘটতে থাকে, এইরকম অবস্থায় 1884 সালে ঢাকা কলেজ কলকাতায় খেলতে আসে প্রেসিডেন্সি কলেজ সাথে আর হ্যাঁ ঢাকা কলেজে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সয়ং সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী। এই খেলাটি হয়েছিলো ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামে। প্রেসিডেন্সি কলেজ বনাম ঢাকা কলেজের এই খেলায় হেরে গেছিলো প্রেসিডেন্সি কলেজ। কিন্তু সাহেবদের খেলায় সাহেবরা হরে যাওয়ায় তাদের খুব গায় লেগেছিলো। 

ক্রিকেট খেলার সময় সারদারঞ্জন 


তাই প্রেসিডেন্সি কলেজ বির্তক করলো, কেন অধ্যাপকরা খেলবে ? ঢাকা কলেজের অধ্যাপকরা সারদারঞ্জন ও তার ভাইরা অর্থাৎ প্রমদা ও কুলুদা। কিন্তু এইকথার তীব্র প্রতিবাদ জানায় সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী। সারদারঞ্জনের এই প্রতিবাদ কোনো ভাবেই সমর্থন পেল না, প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজ অধ্যাপকরা এবং ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের যৌথ পিটিশন জানায়। এই পিটিশনের ফলে ঢাকা কলেজের ক্রিকেট দল থেকে বাধ্য হয়ে নাম বাদ যায় বাকি অধ্যাপকদের সাথে সারদারঞ্জন ও তার দুই ভাইয়ের যারা কিনা প্রতিষ্ঠা করেছিল ক্রিকেট ক্লাব। রাগে সেই দিনই ঢাকা কলেজ থেকে ইস্তফা দেয় সারদারঞ্জন। তবে জানা যায় এই গন্ডগোলের জন্য বাংলার গ্রামে গঞ্জে ক্রিকেট খেলার জনপ্রিয়তা বাড়ে।

মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউসন

 এইসময়ে কলকাতায় এখনকার বিধাননগরে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউসন প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অনেকে বলে থাকেন এই কলেজটি ভারতের প্রথম প্রাইভেট কলেজ। বর্তমানে আমরা বিদ্যাসাগর কলেজ নামে চিনি। আবার এও জানা যায় সেই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী কে অনুরোধ করলেন মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউসনে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করতে, সারদারঞ্জন ও যোগদিলেন মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের। কিন্তু সেই সময় মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে অর্থসংকট চলছিল, তাই সারদারঞ্জন ঠিক করলেন নিজেই কলকাতারয় ক্রিকেট সরঞ্জাম ও ক্রিকেট সংক্রান্ত বইয়ের দোকান খুলে বসলেন, আর সেই সময় কলকাতায় ক্রিকেট খুব চাহিদা ও বেড়েছিল। বলা হয় সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী প্রথম যিনি কলকাতার বুকে ক্রিকেট সরঞ্জাম দোকান খোলেন যার নাম ছিলো  'S Ray and Company'. এই দোকানটি তৈরি হয়েছিল 1895 এ। জানা যায় শিয়ালকোট থেকে সারদারঞ্জন ক্রিকেট ব্যাট বানানোর জন্য কাঠ আমদানি করতেন, আর স্থানীয় কাঠের কারিগরদের ক্রিকেট ব্যাট বানানোর প্রশিক্ষন দেন। কারণ মধ্যবিত্তদের পক্ষে আমদানি করা ব্যাট কেনার ক্ষমতা ছিল না। যোশর রোডের কারখানায় তৈরি হতো ব্যাট যারফলে মধ্যবিত্ত মানুষ ও কিনতে পারতেন, এবং সেইটাই চেয়েছিলেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাড়িতে ধুকতে শুরু করে ব্যাট। 1906  সালে সারদারঞ্জন তৈরি করেন ব্যালেন্সড ব্যাট। 

হয়তো সেই ব্যাট

এই ব্যাট নাকি আধুনিক ব্যাটের পূর্ব পুরুষ। ব্যালেন্সড ব্যাট কলকাতার শিল্পপণ্য মেলায় বিশেষ পুরুষ্কার পয়েছিলো। 1884 সালে কলকাতায় ঐত্যবাহী টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী।

টাউন ক্লাব 

বলা হয় এটি ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বাঙালিকে একসাথে করে ও স্বদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উৎসাহী করে। 1792 সালে কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব যতদুর সম্ভব এখানে ব্রিটিশরাই খেলতো আর কলকাতা টাউন ক্লাব ছিল ভারতীয়দের। এইখানে একটা মজার কথা বলে রাখা দরকার, স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতা টাউন ক্লাবে ক্রিকেট খেলেছিলেন এবং 7 টি উইকেট ও নিয়েছিলেন। 

এই খেলাটি হয়েছিলো কলকাতা টাউন ক্লাব বনাম কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব। তখন স্বামী বিবেকানন্দ সন্যাসী হননি। জানা যায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের কাছে নরেন্দ্রনাথ দত্ত সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী সন্ধান পান। 

সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী ক্রিকেট কোচিং ও দিতেন, আর সেই কথা শুনে নাটরের মহারাজ সারদারঞ্জনকে তার ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত করেন। ক্রিকেট সব নিয়ম কানুন সারদারঞ্জনের নখদর্পণে ছিলো। আচ্ছা বাংলার W.G. Grace বলা হয় সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী কে, তাই W.G. Grace ব্যাপারে না বললে অন্যায় হবে।

W.G. Grace

W.G. Grace এর পুরো নাম ডা: উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস। উনি জন্মগ্রহণ করেন 1848 সালের জুলাই মাসের 18 তারিখে। ওনার তিন ভাই ছিলেন, W.G. Grace, E.M Grace G.F Grace. এই তিন ভাই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেট খেলেন 1880 সালে। ঐ বছরই W.G. Grace ক্রিকেট খেলা শুরু করেন 32 বয়সে। বর্তমান ক্রিকেট এর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন W.G. Grace. সমস্ত জীবন জুড়ে তিনি 54,896 রান করেছিলেন আর উইকেট নিয়েছেন 2876 টি। 

সুকুমার রায় 

সুকুমার রায়ের ক্রিকেট এর প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া বিদেশ থেকে তার লেখা চিঠিপত্রে। সুকুমার রায় লিখেছেন, বোম্বাগড়ের রাজা ছড়ায়  “সভায় কেন চেঁচায় রাজা ‘হুক্কা হুয়া’ ব’লে? / মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় ব’সে রাজার কোলে? / সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি? / কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি?”। 

সত্যজিৎ রায় 

সত্যজিৎ রায় ও লেগ স্পিনার ছিলেন। তার সৃষ্ট অন্যতম চরিত্র ফেলুদা ও ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলো বাদশাহী আংটি ফেলুদা বলছে " স্লো স্পিন বল দিতাম "

W.G. Grace এর মতন সাদা লম্বা দাড়ি রাখতেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী। এই বাঙালি, যিনি বাঙালিকে শিখিয়ে ছিলেন ক্রিকেট খেলতে। তাই সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী কে সবাই বলেন বাঙালির ডাব্লিউ জি গ্রেস। আর কদিন পরেই শুরু হচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ, সেই জন্য ক্রিকেট দেখতে দেখতে এবার নিশ্চয়ই মনে করাই যায় সারদারঞ্জন রায়চৌধুরীর কথা ।

ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://khela71.com/life-of-sarada-ranjan-roy-chowdhury/


https://www.prohor.in/sarada-ranjan-the-owner-of-first-cricket-equipment-shop-in-kolkata

Comments