কলকাতার এই রাস্তা ছিল জলের তলায় !

শিল্পীর আঁকায় ক্রিক রো

 কলকাতার শহর জুড়ে রয়েছে অনেক রাস্তা, আর তার মধ্যে রয়েছে অনেক গলি, আর গলির ভিতর তস্য গলি। কলকাতার অনেক রাস্তার অনেক নাম আছে। এখন আবার অনেক রাস্তার নতুন নাম করন রয়েছে, কিন্তু আবার অনেক রাস্তার আগের নামই রয়ে গেছে। সেরকম এক রাস্তা হলো ক্রিক রো‌ Creek Row. এই রাস্তাটি পড়ছে বৌবাজার এলাকার মধ্যে। এই রাস্তাটি কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে সার্কুল রোড পর্যন্ত গিয়েছে। কিন্তু আগের এরোকম কোনো রাস্তাই ছিল না। আসলে creek কথা মানে হলো সরু খাল, এখানে বলে রাখা দরকার “The fish follows the water and the fisherman follows the fish” মানে জল যেদিকে যায় মাছ ও সেদিকে যায় আর সাথে সাথে জেলেরা সেই দিকে যায়। অনেকে বলে থাকে এইখানে জেলেপাড়া ছিলো। জেলেরা জানবাজার এবং ফেনরিক বাজারে মাছও বিক্রি করতেন।

কিন্তু এই সরু খাল কি করে একটি রাস্তা পরিনত হলো‌ ? কোনো জবর দখল হয়েছিল নাকি ? বর্তমান সময়ে এই প্রশ্ন আসা খুবই স্বাভাবিক।

 

আজকের ক্রিক রো

কিন্তু না এই রকম কোন ঘটনা ঘটেনি। অনেকে বলেন যে এই সরু খালটি বর্ষার সময় ফুলে ফেঁপে উঠতো আর নৌকা চলাচল করতো এই খালে। কলকাতার শহরে বুকে একটা ছোট খাল। কিন্তু 1737 সালের আগে  এই খাল দিয়ে বড় নৌকা ও বার্জ জাতীয় জাহাজ চলাচল করতো। কলকাতার শহর তো আর আগে এইরকম শহর ছিলো না, সেই জঙ্গলে ভরা, আর তার মাঝখানে বয়ে গেছে এই ছোট খালটি।

 মনে করা হয় এই খালটির যাত্রা শুরু হয় চাঁদপাল ঘাট থেকে বিদ্যাধরি নদী পর্যন্ত। এখানে বলে রাখা দরকার যে এখন কিন্তু বিদ্যাধরি আর আগের মতো নেই, অনেকটাই বুজে গিয়েছে।

মাঝখানে কতগুলো জায়গা হয়ে গেছিলো এই খালটি সেই জায়গায় গুলি এখন আছে। সেগুলো হলো ওয়াটারলু স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, হেস্টিংস স্ট্রিট। এই খাল যখন ছিলো,  তখন ব্রিটিশরা পুরোপুরি ভাবে কলকাতায় বসবাস করতো না। বলা হয় এই খাল দিয়ে নাকি ক্রীতদাস দের পাচার করা হতো, গঙ্গা কে ব্যাবহার করা হতো না কারণ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। এই খালে আবার মগ আর পুর্তগিজ জলদস্যুরা যাওয়া আসা করতো। কিন্তু আবার একই প্রশ্ন কি করে খাল একটা রাস্তায় পরিনত হলো‌ ? প্রধানত প্রাকৃতিক কারনে। জানা যায় 1737 সালে 30 সেপ্টেম্বর বঙ্গাপসাগর একটি ঘুর্নিঝড় সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ঝড় আছড়ে পড়েছিল কলকাতায়। ঝড় থেমে যাওয়ার পর সার রাত ধরে চলে মুষলধারে বৃষ্টি, এবং ভূমিকম্প। সেই সময় কলকাতা ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়েছিল। কাঁচা বাড়ি দূরে থাক, যে কটি পাঁকা বাড়ি ছিলো সেই গুলো ভেঙ্গে পড়েছিল। কয়েকটি জাহাজ গঙ্গায় নোঙরে করা ছিল সেই গুলো উল্টে যায়। লন্ডনের সংবাদ পত্রে এই খবর ছাপা হয়েছিলো।

সেই ঝড়ে তছনছ হয়ে যাওয়া কলকাতা 

এই তথ্যটি জানা যায় শ্রী কৌশিক মজুমদার প্রণীত ধন্য কলকেতা সহর বইটির মাধ্যমে। এই ক্রিক রো এর আগে নাম ছিলো ডিঙাভাঙা, এই নামের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় সেই ঝড় হয়েছিল, সেই ঝড় এতোটাই তীব্র ছিলো যে গঙ্গার একটি বজরা নাকি এখানে এসে আটকে যায় তাই এই রাস্তা টিকে বলা হতো ডিঙাভাঙা লেন। আঠেরো শতকে ব্রিটিশদের তৈরি কলকাতার মানচিত্রে এই ক্রীক রো কে দেখানো হয়েছে ডিঙাভাঙা লেন হিসাবে। এই ঝড় কিন্তু সেই সময়ের কলকাতাকে তছনছ করে দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে আজকে যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তখন ছিলো সেন্ট অ্যানের গির্জা।

শিল্পীর আঁকায় পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম

সেন্ট অ্যানের গির্জা 

রাইর্টস বিল্ডিং 


 বলা হয় এই গির্জা ছিল কলকাতা ব্রিটিশদের পুরোনো উপসনা স্থল। সেই গির্জা সম্পুর্ন চুরমার হয়ে গেছিলো এই ঝড়ের ফলে। শুধু কিন্তু গির্জা ধ্বংস হয়েছিল না, ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিলো গোবিন্দরাম মিত্রের নবরত্ন মন্দিরের মূল চূড়া, যার নামছিল পঞ্চরত্ন চূড়া। সেই সময়ের অন্যতম জমিদার ছিলেন কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র, তার প্রভাব কিন্তু ব্রিটিশরা এড়াতে পারেনি। এই মন্দিরটি ছিল গঙ্গার তীরে আর এই মন্দিরটি বিদেশি কাছে "ব্ল্যাক প্যাগোডা" নামে পরিচিত ছিল। মন্দিরটির চূড়া গুলো এতটাই উঁচু ছিল অনেক দূর থেকে দেখা যেত। 

নবরত্ন মন্দির বা ব্ল্যাক প্যাগোডা

বলা হয় আজকের শহীদ মিনার থেকেও আরো লম্বা ছিল এই মন্দিরটি। কিন্তু সেই ঝড়ের পর চূড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে হ্যাঁ এখনো কিন্তু সেই মন্দির আছে কলকাতায়। আবার এই খালের মধ্যে দিয়ে জলদস্যুদের চোখ এড়িয়ে সোজা হুগলি নদীর তে পৌঁছেযেত ব্যাবসাইদের জাহাজ। খাল যখন ছিলো নিশ্চয়ই পায় হাঁটা মানুষের জন্য ব্রিজ ও ছিল বলে দাবি করা হয়, বলা হয় এখন যেখানে হেস্টিংস স্ট্রিট সেখানেই ছিলো এই ব্রিজ, আর এই ব্রিজের মাধ্যমেই নাকি জনের গির্জা থেকে গোবিন্দপুর অবধি চলাফেরা করা হতো আর এই খাল ছিল সাবেকি কলকাতার বর্ডার আর এই ব্রিজের দক্ষিণে ছিল, গোবিন্দপুর। এখানে বলে রাখা দরকার যে তখন চলেছে 1698 সাল, কিন্তু তখনো কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা হয়নি তখনো এই খালটি কালিকাটা গ্রামের বর্ডার ছিলো। 1700 শতকে মনে করা হতো কলকাতা নামটি এসেছে, খালা কাটা থেকে, মনে করা হতো খাল মানে ইংরাজি তে Khal বা creek আর কাটা মানে cut, আর তাই Khal + Kutta = Calcutta. অবশ্য নায়ার বলেছেন কালীঘাটা বা কালিঘাট থেকে কলকাতার নাম হয়নি। 

এই খালের মতো কলকাতার আরো একটি উল্লেখযোগ্য সেই খালের নাম ছিলো। বৌরানি খাল আবার এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে অনেক বলেন ডিঙাভাঙা বা ক্রীক রো আসলে বৌরানি খাল, যা কিনা ব্রিটিশরা সংস্কার করেছিল। আবার অনেকে বলেন এই খাল আসলে গাঙুর, গাঙুর হলো একটা নদী এখন অবশ্য বেহুলা নদী নামে পরিচিত। অনেকে বলেন ঐ খাল, মানে গাঙুর উপর দিয়ে বয়ে গেছিলো মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র বেহুলা ও মৃত লখিন্দরের ডিঙি। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। রাধারমন মিত্রের কলিকাতা দর্পণের ডিঙাভাঙার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ঐ খাল থেকে কিভাবে সৃষ্টি একটি রাস্তার? এর জন্য দায়ী কিন্তু সেই ঝড়। সেই ঝড়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ঐ ঝড়ের ফলে কলকাতার দুটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, এক ঐ খালটি আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের মতে পলিমাটির স্তর বেড়ে যায় যার খালটি আর দেখা যায় না। আর দ্বিতীয় পরিবর্তন হলো খাল তো বুজে গেল পড়ে রইলো রাস্তা যার নাম হলো ডিঙাভাঙা বা ক্রীক রো।

হ্যাঁ এখানে মানুষের অবদান রয়েছে, 1804 সালে ব্রিটিশদের তৈরি লটারি কমিটির কলকাতা কতগুলি রাস্তা তৈরি করার কথা জানিয়েছিল, এবং সেই সঙ্গে তহবিল গঠন করা হয়েছিল। সেই রাস্তা গুলির মধ্যে ছোট গলি মানে ক্রিক রো‌ ছিলো। 1825 সালের মধ্যে এই খালটিকে সম্পুর্ন বুঝিয়ে ফেলা হয়। রিতিমতো এই গলিটিতে মানুষের চলাচল শুরু হয় আর সেই জন্য 1825 সেই লটারি কমিটির map এই রাস্তাটি দেখা যায়। 

Map এ Creek Row 

যেহেতু রাস্তা হয়ে গেছে, তাই আশেপাশের গজিয়ে উঠলো বাড়ি অবশ্যই সেই সময়ের বড়লোকদের বাড়ি ছিলো, তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজা সুবোধ বসুমল্লিকের প্রাসাদ প্রমাণ বাড়ি, আরো সব বাড়ি ও ছিলো। "ছিলো" বলছি কারণ এখনো সেই বাড়িটি আছে। ক্রিক রো‌ এর এই বাড়িটি আবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বিশেষ ভুমিকা পালন করে ছিলো।

সেই সময়ে রাজা সুবোধ বসুমল্লিকের বাড়ি

আর এখন সেই বাড়ি


 এই মল্লিক বাড়ি বঙ্গভঙ্গের সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সদর দফতরে হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাল গঙ্গাধর তিলক সহ বহু মানুষের আনাগোনা ছিল এই বাড়িতে সেই সময়। ক্রিক রো স্ট্রিটে রাজা সুবোধ মল্লিক আরো একটি বাড়ি ছিলো বলে জানা যায়, এই বাড়ির ঠিকানা ছিলো 2/1 ক্রিক রো। 


সেই পত্রিকা


এই বাড়িটা রাজা মশাই অরবিন্দ ঘোষ দিয়েছিলেন,তার জাতীয়তাবাদী পত্রিকা 'বন্দে মাতরম' এর প্রকাশের স্থায়ী অফিসের জন্য। আর এখানেই ব্রিটিশ শাসন বিরুদ্ধে ইংরাজি ভাষায় অরবিন্দ ঘোষের সম্পাদিত 'বন্দে মাতরম' পত্রিকা ও প্রকাশ পেয়েছিল। 

আর এই ভাবে জলের তলা থেকে উঠে এল এই কলকাতার অন্যতম ব্যাস্ত রাস্তা ক্রীক রো। তাই এই শহরে ইতিহাস আর বর্তমান মিলেমিশে রয়েছে, সেই জন্য বলে NOTHING LIKE KOLKATA 

ঋণ-স্বীকার শ্রী কৌশিক মজুমদার 

ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - A History of Calcutta's Streets P. Thankappan Nair

https://indianexpress.com/article/research/streetwise-kolkata-creek-row-a-creek-that-could-have-lent-the-city-its-name-7305838/#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16946995415606&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Findianexpress.com%2Farticle%2Fresearch%2Fstreetwise-kolkata-creek-row-a-creek-that-could-have-lent-the-city-its-name-7305838%2F

https://risingbengal.in/history-of-india/from-the-canal-to-the-city-of-kolkata-creek-row

https://eisamay.com/west-bengal-news/kolkata-news/did-you-know-about-creek-row-in-kolkata/articleshow/48268331.cms#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16944295647750&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Feisamay.com%2Fwest-bengal-news%2Fkolkata-news%2Fdid-you-know-about-creek-row-in-kolkata%2Farticleshow%2F48268331.cms

Comments