পার্সি ও কলকাতা

Parsi 

 কয়েক দিন আগেই ছিল Parsi New year. কলকাতায় কিভাবে পার্সিরা এসেছিল, বা কবে এসেছিল সেই বিষয়ে একটু পরে আসছি তার আগে বলি পার্সি সম্প্রদায় কি ভাবে ভারতবর্ষে এসেছিল। জানা যায় 3,500 বছর আগে পার্সিয়ান সাম্রায্য ছিলো সবচেয়ে বড় সাম্রায্যের একটা। সাম্রায্যের শাসকদের মধ্যে অন্যতম ছিল, জারক্সেস দ্য গ্রেট  আর সাইরাস দ্য গ্রেট। জারক্সেস দ্য গ্রেট এর রাজত্ব কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব 486 আর সাইরাস দ্য গ্রেটের রাজত্ব কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব 600. এইরকম এক রাজত্বের সময় ইরানের রাজা রাশিদুন খিলাফত পার্সায়া আক্রমন করে, দখল নেয় পার্সিয়ান সাম্রায্যর। 600 খ্রিষ্টাপূর্বে ধর্মপ্রবক্তা জরথুস্ত্র দিব্যজ্ঞান পান এবং বলেন ভালো আর খারাপের পিছনে একটা পজেটিফ আর নেগেটিভ এর্নাজি কাজ করে আর ঈশ্বর 

জরথুস্ত্র

একজন তার নাম 'Ahura Mazda' পরে এই ধর্মের নাম হয় zorabin, পার্সিরা  zorabin এ বিশ্বাস করতো, এই আক্রমনের ফলে অনেকেই জোর করে ধর্ম পাল্টানো হচ্ছিল, এই কিছু পার্সি মানুষজন সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে এসেছিল। এই ঘটনাটি পার্সিদের গ্রন্থ 'কিসসা এ সনঞ্জন' ( Qissa - E - Sanjan ) এ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। 

ভারতের ডিউ মানে দমন আর ডিউ, সেই ডিউ দ্বীপে তারা এসেছিল। বলা হয় ঐ দ্বীপে তার উনিশ বছর ছিল, তারপর তারা ঠিক করলো এবার ভারতের মূল ভূখণ্ডে যাওয়া দরকার, তা নাহলে ব্যবসা বাণিজ্য করা যাবে না। তবে হ্যাঁ এই বিষয়ে কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারা গুজরাটের সনঞ্জন শহরে যায়, তারা ঠিক করল রাজার সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু রাজা জেদী রানা সেই সব পার্সিদের বললেন, দেখো আমি তো আর তোমাদের থাকার যায়গা দিতে পারবো না, আর জায়গা নেই আমার রাজ্যে‌। রাজা জেদী রানা তখন একটা ভরা দুধের গ্লাস নিয়ে দেখিয়ে ছিল এই দেখ আমার রাজ্য পুরো ভর্তি, কি করে হবে তাহলে ? পার্সিদের মধ্যে একজন একটু চিনি চাইলেন আর সেই টা দুধের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন রাজা মশাই এইভাবে আমরা মিলে মিশে থাকবো। রাজা খুশি হয়ে তাদের নিজের রাজ্যে থাকতে দেয়, আর বলে তোমাদের আমার কয়েকটা শর্ত মানতে হবে যেমন রাজ্যের স্থানীয় ভাষা শিখতে হবে, অস্ত্র রাখা যাবে না, পার্সি নারীদের ভারতীয় পোশাক পড়তে হবে, পার্সি সেই ভাষা ছিল গুজরাটি। এই ভাবেই পার্সি জনগোষ্টি ভারতের এসেছিল।

sanjan stambh গুজরাটের সনঞ্জন শহরে 

এবার বলি কলকাতায় পার্সি জনগষ্টির কথা, জানা যায় কলকাতার সাথে পার্সি জনগোষ্টির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ অনেক পুরনো, যদি হিসাব করা হয়, তাহলে দেখা যাবে 240 বছরের সময়ের ও বেশি পুরনো কলকাতার সঙ্গে পার্সিদের সম্পর্ক। জানা যায় 1767 সালে দাদাভাই বেহরামজি প্রথম পার্সি, যিনি কলকাতায় প্রথম বসতি স্থাপন করে। আবার এও জানা যায়, জন কার্টিয়ার যিনি তখন বাংলার গর্ভনর ছিলেন তার বন্ধু ছিল দাদাভাই বেহরামজি। অন্য দিকে কাওয়াসজি বানাজি ছিলেন, দাদাভাই বেহরামজি ভাগ্নে, ইনি কলকাতার আধুনিকিকরনে সাহায্যে করেন বলে Prochy N Mehta

সেই বই

তার বইতে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ইনি প্রথম ভারতীয় জিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথের ঠাকুরের সঙ্গে ওনার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। কিন্তু কলকাতায় সেই সময় পার্সিদের জন্য কোনো টেম্পল অথবা প্রার্থনা ঘর ছিল না। রুস্তমজি কাওয়াসজি এজরা স্ট্রিটে প্রার্থনা ঘর তৈরি করেন। তবে এখন সেই মন্দির দেখাই যাবে না। খালি মার্বেল ফলকের উপর নাম দেখা যাচ্ছে। তবে এখন ওখানে ইলেকট্রনিক মার্কেট বসে, ঐ মার্কেটের জন্য টেম্পলটি প্রায় দেখাই যায়না। ঝরে পরেছে সেই সময়ের মার্ভেল কুরুকার্জ থেকে শুরু করে নানা রকম ঝাড়বাতি। শুধু রয়েছে বাড়িটির কাঠামো। 2001 সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এই ভবনটি কে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে ঘোষণা করে। 

সেই মন্দিরে একটা ফলক

সেই আরো একটা ফলক 

সেই মন্দিরের অবশিষ্ট অংশ 

উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যেই অংশটি 

তাহলে কি পার্সি টেম্পল আর নেই ? নিশ্চয়ই আছে 1912 এরভাদ ধুঞ্জীভয় বাইরামজি মেহতা ( Ervad Dhunjeebhoy Byramjee Mehta ) পার্সি টেম্পল তৈরি করেন যার নাম Anjuman Atash Adran Temple. এই মন্দিরটি দোতলা, প্রথম তলায় মার্বেল পাথরের তৈরি বড় একটা ঘর, আরো একটা ঘরে রয়েছে দ্বিতীয় তলায়  ভেতরে রয়েছে জরথুষ্ট্রিয়ানদের পবিত্র অগ্নির বেদি জরথুষ্ট্রিয়ানরা অগ্নির উপাসক তাই, এই চিহ্ন দেখা যায় মন্দিরের বাইরেও।আর মন্দিরটির প্রথমতলায় খুবই শান্তিপূর্ণ। এই প্রথম তলায় রয়েছে একটি বহুপুরনো grandfather ঘড়ি। 

Ervad Dhunjeebhoy Byramjee Mehta Temple 

সাধারণত এই মন্দিরটির প্রথমতলায় ব্যবহার করা হয় কলকাতার পার্সি জনগোষ্টির বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান, বিয়ে সহ আরো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য। 

মন্দিরের কিছু অংশ 

আগস্ট মাসে পার্সিদের নতুন বছর শুরু হয় সেই জন্য ঐ সময়ে এই মন্দিরটিতে চাঁদেরহাট বসে, ঐ সময়ে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী পার্সি মানুষজন এই Anjuman Atash Adran Temple এ আসনে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। আবার এই দিনেই জরথুষ্ট্রিয়ানদের ধর্মপ্রবক্তা নবী জরথুস্ত্রের জন্মদিন। 

মন্দিরের কিছু অংশ 

The Telegraph থেকে জানতে পারছি যে ধুঞ্জীভয় বাইরামজি মেহতা কলকাতায় এসেছিলেন 1846 সালে এবং শ্রীরামপুরে কটন মিল চালু করেছিলেন, যার নাম ছিল Empress of India cotton mills. চীনের সঙ্গে এই ব্যবসা শুরু করেন ধুঞ্জীভয় বাইরামজি মেহতা। 

ধুঞ্জীভয় বাইরামজি মেহতা

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার জানা যায় সাতেরো ও আঠারো শতকে পার্সি ব্যবসায়ীরা চীনের সাথে আফিম এবং তুলোর ব্যবসা করতো। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পার্সিদের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি গুলি তে, শাড়ি গুলির কাজে চীনা এবং ভারতের embroidery খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করা যায়, এই শাড়ি গুলিকে GARA শাড়ি বলা হয়। 

সেই শাড়ি

হ্যাঁ আবার কলকাতায় ফিরি, The Telegraph আরো জানতে পারছি এই ফায়ার টেম্পলটি যার নাম আগেই উল্লেখ করেছি 900 sq yards নিয়ে তৈরি হয়েছে। এই মন্দিরটি এগারোটি কাঁচ যুক্ত জানালা রয়েছে, কাঁচ যুক্ত কথাটা বলেছি কারণ জানলা গুলো প্রতিটি কাঁচে জরথুষ্ট্রিয়ান থীম ও মোটিফ খুব সুন্দর স্পষ্ট। 

জানালার কাঁচে জরথুষ্ট্রিয়ান থীম

টেম্পলে একটা grandfather ঘড়ির কথা বলেছিলাম, সেই ঘড়িটির গায়ে লেখা রয়েছে "Specially made for RD Mehta Esq by J&T Foster, 12 Mayes St, Manchester 1908, January." 

সেই ঘড়ি

আর বোঝাই যাচ্ছে 100 বছরের ও বেশি বয়স হয়ে গেছে এই অত্যন্ত সুন্দর এই Anjuman Atash Adran Temple এর। পার্সিদের কলকাতায় অনেক অবদান আছে, যেমন ধরুন প্রথমেই কাওয়াসজি বানাজি কথা বলেছিলাম, উনি তারসঙ্গে আরো এক সাহেব, নাম ছিল টার্নার। এই দুজন মিলে একটি আমদানি ও রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন, একটি কোম্পানিও ছিল তাদের সেই কোম্পানির নাম ছিল ‘‌‌রুস্তমজি টার্নার অ্যান্ড কোম্পানি’। আগেই বলেছি সেই চীনের সঙ্গে আমদানি রপ্তানির ব্যবসা ছিল বিভিন্ন পার্সি মানুষের। জানা যায় খিদিরপুর ডকটি নাকি একপ্রকার কিনেই নিয়েছিলেন ‘‌‌রুস্তমজি টার্নার অ্যান্ড কোম্পানি’। এই রুস্তমজির নিজের সাতাশ টা জাহাজ ছিল, তারউপর বিমার ব্যবসা, তুলোর কারখানা ছিল রুস্তমজির।

 গরিবেদের জন্য দুহাত খুলে খরচা করতেন রুস্তমজি কাওয়াসজি। আমার সিনেমা দেখি হলে গিয়ে, এখন অবশ্য মাল্টিপ্লেক্স হয়ে গেছে, কিন্তু কলকাতায় প্রথম বায়োস্কোপ দেখিয়ে ছিলেন একজন পার্সি। তখন গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বায়োস্কোপ দেখানো হতো, সেই বায়োস্কোপ দেখিয়ে ছিলেন জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান। 

জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান

উনি চালু করেছিলেন 'করিন্থিয়ান থিয়েটার’‌ সেখানে সিনেমার পাশাপাশি নাটক করতেন পার্সিরা। পার্সি মহিলারা নাটক করতেন, অবশ্যই সবাই না, বেশ বড়লোক ঘরের মহিলারা নাটক করতেন তার জন্য 1907 সালে তৈরি হয় পার্সি অ্যামেচার ড্রামাটিক্‌স ক্লাব। ওখানে নাকি বিনা টিকিটে নাটক দেখা যেত আর ইন্টারভ্যালে পাওয়া যেত ‘‌‌ভিমটো’‌ আইসক্রিম-সোডা বিলি করে এডুলজি শাপুরজি ওলপাডওয়ালা–র ‘‌বায়রন’‌ কোল্ড ড্রিংক কোম্পানি‌।

সেই আইসক্রিম 

 তবে এখন পার্সি মানুষের সংখ্যা খুব কমেই যাচ্ছে , উনিশ শতকে কলকাতায় পার্সি মানুষের সংখ্যা ছিল একলাখ এখন সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে চারশোর একটু বেশি। কলকাতা শহরে সবাই আছে কমবেশি, তাই বলা বাহুল্য NOTHING LIKE KOLKATA. 


ছবি সূত্র - Wikipedia commons এবং internet 

তথ্য সূত্র - https://www.indiatimes.com/news/india/the-lost-parsi-fire-temple-of-kolkatas-ezra-street-596349.html


https://rangandatta.wordpress.com/2012/01/25/parsi-zoroastrian-fire-temple-calcutta-kolkata/


https://www.anirbansaha.com/parsi-fire-temple-kolkata-india/


https://www.telegraphindia.com/west-bengal/100-years-of-city-s-only-parsi-fire-temple/cid/1274148


https://www.anandabazar.com/rabibashoriyo/navroz-parsi-community-celebrates-new-year-with-food-and-festivities-in-kolkata-1.660749#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16923704659215&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Fwww.anandabazar.com%2Frabibashoriyo%2Fnavroz-parsi-community-celebrates-new-year-with-food-and-festivities-in-kolkata-1.660749


Comments