লাল কেল্লার রঙ কী সত্যিই লাল ?

এখনকার লাল কেল্লার তখনকার ছবি 

আর দুদিন পরেই ভারতবর্ষ গর্বের সাথে পালন করবে 76 তম স্বাধীনতা দিবস। 15 আগস্ট 1947 সালে‌ 200 বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীন হয়েছিল ভারতবর্ষ। দুইশ বছর ধরে ভারত ছিল ইংরেজ শাসনাধীন। এই দুইশ বছর মধ্যে ভারত দেখেছে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, দেখেছে বলা ভুল হবে ব্রিটিশ সরকার হয়ে অংশগ্রহণ করেছে। এই দুইশ বছরে ভারত সহ্য করেছে ব্রিটিশদের অত্যাচার, ভারতকে স্বাধীন করতে কত বিপ্লবীদের যে প্রাণ চলে গেছে সেইটা গুনে শেষ করা যাবে না। ক্ষুদিরাম বসু প্রফুল্ল চাকী,ভগৎ সিংহ, লালা লাজপত রাই, চন্দ্র শেখর আজাদ, বাঘা যতিন, এখন কলকাতার বিবাদি বাগ মানে বিনয় বাদল দিনেশ আর কত নাম বলবো! এই নাম গুলো আমার জানি, আর যাদের নাম জানিনা তাদের কথা ইতিহাস ও ভুলে গেছে। 


প্রতিবছর 15 আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লীর লাল কেল্লা থেকেই জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এবার যদি বলি এই কেল্লার রঙ আসলে ছিল ধবধবে সাদা ! চকবে উঠবেন নিশ্চই, হ্যাঁ চমকে ওঠারই কথা, আর প্রত্নতত্ত্ববিদ এই কথাই বলছেন। কী কিরে কেল্লা লাল হলো সেইকথা পরে বলছি, তার আগে কেল্লার তৈরির কথা জানা যাক। ভারতে তখন মোঘল আমল চলছে, মসনদে তখন সম্রাট আকবরের নাতি, জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহান। 

সম্রাট শাহজাহান 

সম্রাটরা মাঝে মাঝেই  নিজের এলাকা বদলান, তো শাহজাহান ঠিক করলেন অনেকদিন আগ্রা তে থাকা হয়েছে এবার দিল্লি তে থাকবো আর মোঘলদের রাজধানী ও দিল্লি হবে। হলোও তাই কিন্তু যখন দিল্লি যাচ্ছি, তবে তো নতুন কেল্লা বানাতে হবে যেমন ভাবা তেমন কাজ, দিল্লি তে নতুন কেল্লা বানানোর জন্য ডাক পড়লো সেই সময়ের দুই শ্রেষ্ঠ শিল্পীর আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে স্থাপত্য শিল্পীদের। সেই সময় দুই বিখ্যাত দুই শিল্পী হলেন ওস্তাদ আহমেদ এবং ওস্তাদ হামিদ। তারা জিজ্ঞেস করলো সম্রাটকে নতুন কেল্লায় তার বিশেষ কিছু চাহিদা আছে কী ? সম্রাট শাহজাহান বলেন দেখ আমি ঐ কেল্লায় থাকবো, আর ঐ কেল্লায় দুটো প্রবেশ পথ থাকবে একটি প্রবেশ পথে মুখ থাকবে দিল্লির দিক করে আর অন্য প্রবেশ পথটির মুখ থাকবে লাহোরের ( লাহোর বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত ) দিকে। হয়েছিল তাই সম্রাটের নির্দেশ না মানলে গর্দান যাবে। দশ বছর সময় লাগে লালকেল্লা তৈরি করতে, অবশেষে 1648 খ্রিষ্টাব্দে যমুনা নদীর তীরে তৈরি হয়। আবার অনেকের মতে লাল কেল্লা তৈরির শুরু হয় 1648 খ্রিষ্টাব্দে। সম্রাট শাহজাহানের লাল কেল্লা। মোঘল সম্রাট শাহজাহান কিন্তু এই কেল্লার নাম লাল কেল্লা দেয়নি, সম্রাট শাহজাহান তার এই কেল্লার নাম দিয়েছিল,

কিলা - ই - মুবারক। এখন আমরা যাকে দিল্লি বলে চিনি সেই দিল্লির আগের নাম ছিল শেহজাহানাবাদ, বলা হয় এই কেল্লার সামনেই শেহজাহানাবাদ শহর তৈরি হয়েছিল। আরো বলা হয় শাহজাহান তখন কাবুলে ছিল যখন এই কেল্লা তৈরি হয়েছিল। জানা যায় কেল্লার পেছন দিকে যমুনা নদীর একটা অংশ কেল্লার মধ্যেই ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ আমলে আর সেটা দেখা যায়নি। এখন আমরা লাল কেল্লার সামনে যেই প্রাচীরটি দেখতে পাই সেইটা করেছিলেন ঔরংজেব, এই কথা শুনে শাহজাহান আগ্রা থেকে চিঠি লিখে ঔরংজেব কে জানিয়ে ছিলেন "এই প্রাচীর দিয়ে কেল্লার শোভা তুমি নষ্ট করে দিয়েছো, মনে হয় মনে নতুন বৌ এর মুখের মুখোস তুলে দেওয়া হয়েছে" । বলা হয়ে থাকে এই কেল্লাতেই ছিল Mountain of light - Kohinoor. এই কোহিনূর কে নাকি শাহজাহান নাদির শাহ্ এর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছিলেন। আবার মতানৈক্য আছে এঘটনা নিয়ে অনেক মনে করেন মোহাম্মদ শাহের কাছ থেকে নাদির শাহ কোহিনূর হীরে চুরি করে নেয় পাগড়ি বদলানোর সময়। 

নাদির শাহ্ 

কেল্লায় তিনটি দরজা ছিল, প্রথম দুটির কথা আগেই বলেছি লোহোর আর দিল্লি দরজার কথা। আরো একটি দরজা ছিল যমুনার তীরে তাই এই দরজা ওয়াটার গেট হিসাবে পরিচিত। এবার কেল্লার ভিতরে ঢোকা যাক, ভেতরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে নহবত খানা, এই নহবত খানাতেই গান বাজনা আয়োজন করা হতো, মানে এখনকার DJ. জানা যায় প্রতিদিন এখানে পাঁচ বার গান বাজনা আয়োজন করা হতো, আর যেদিন সম্রাটের জন্মদিন থাকতো সেদিন তো সারাদিন গান বাজনা হতো। 

নহবত খানা

আরো জানা যায় এই নহবত খানাতেই জাহান্দার শাহ আর ফররুখসিয়ার হত্যা করা হয়। কেল্লর ভিতরে দুটি প্রধান মহল ছিল একটি হলো দিওয়ান-ই-আম আর একটি দিওয়ান-ই-খাস। দিওয়ান-ই-আম সম্রাটের সিংহাসন থাকতো, সেখানে সম্রাটের সভাবসত আর এই মহলে সম্রাট আম জনতা কথা শুনতেন,  সম্রাট শাহজাহান এই সিংহাসনটি ছিল সোন দিয়ে তৈরি তার উপর বিভিন্ন চুনি পান্না বসানো থাকতো।

দিওয়ান-ই-আম

 দিওয়ান-ই-খাস ছিল আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মহল এখানে ছিলো, সেই বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন যেখানে ছিলো কোহিনুর। তবে এই মহলে সুধু মাত্র সম্রাট আর সভাসদরের আসার অধিকার ছিল আর কারুর না। এই মহলটি ও অপরুপ সুন্দর ভাস্কর্যে ভরা। এই মহলে ছাদটি রুপোর ছিল। 

দিওয়ান-ই-খাস 


এই মহল অর্থাৎ দিওয়ান-ই-খাস লেখা আছে "Agar firdaus bar ru-ye zamin ast 

Hamin ast-o hamin ast-o hamin ast" মানে এই বিশ্বে যদি কথাও স্বর্গ থেকে তো এখানেই এখানেই এখানেই !

এরপরে হচ্ছে রঙমহল এই মহলটি ছিল বেগমদের এখানে সম্রাট ছাড়া আর কারোর ঢোকার অনুমতি ছিল না। এখানে একটা কক্ষের নাম ছিল মুমতাজ মহল, এখন এটি সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই রঙ মহলের ছাদ ও সোনা আর রুপায় মোড়া ছিল, আর এই মহল সহ অন্যান্য মহলের মেঝে ছিলো মার্বেল মোড়া, এমনকি একটা ঝর্ণা ছিলো রঙ মহলে সেইটাও ছিল মার্বেল মড়া। ঝর্ণা বা জলধারা নাম ছিলো নহর-ই-বেহেস্ত এই জলধারা তে যমুনা নদীর জল দিয়ে বহমান রাখা হতো। 

মুমতাজ মহল

এগুলো ছাড়াও আরো অনেক মহল আছে এই কেল্লায়। এই কেল্লায় লাহোর দরজার সামনে দুটি হাতির মুর্তি আছে, এই মুর্তি গুলো কিন্তু মোঘলদের তৈরি নয় 1903 সালে লর্ড কার্জন হাতির মুর্তি গুলি লাহোর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে করিয়েছিল। 

লাল কেল্লার লাহোর দরজা

এই কেল্লার বিভিন্ন মহলের কারুকার্যের সোনা রুপো সহ বিভিন্ন রত্নের পাথর ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলি আর দেখা যায় বেশিরভাগ সবাই চুরি করে নিয়েছে ব্রিটিশরা। 1911 সালে ব্রিটিশ সরকার যখন কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করে তখন এই কেল্লাকে তারা ব্যারাক হিসাবে ব্যবহার করতো, বলা হয়ে থাকে যে এই অনেক মহল ব্রিটিশরা ভেঙে দিয়েছিল। 1857 সালে মহাবিদ্রোহের সময় মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এই কেল্লাতেই ছিলেন, এবং তাকে মহাবিদ্রোহের নেতা ঘোষণা করা হয়‌। আবার যখন ব্রিটিশরা এই মহাবিদ্রোহে দমন করে, তখন এই কেল্লার দেওয়ান-ই-খাস এ শেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের বিচার করা হয়। তাকে নির্বাসিত করা হয় বর্মা এখনকার মায়ানমারে। সম্রাট উপাধি ও তার মুকুট কেড়ে নেওয়া হয়। 

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ 

আবার সেই কথায় ফিরে আসি এই কেল্লা অর্থাৎ লাল কেল্লা সত্যি লাল ছিল ? জানা যায় ব্রিটিশ সরকারের সময় এই কেল্লার চুনাপাথর ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে, তখন ব্রিটিশরা এই কেল্লার মেরামতের কাজ শুরু করে, আর কেল্লার রঙ পাল্টে লাল করে দেয়, আগে কেল্লার রঙ ছিলো সাদা, কেল্লা তৈরি হয়েছিল সাদা চুনাপাথর দিয়েই। এই কেল্লাটি তৈরি হয়েছিল, 256 একর জায়গা জুড়ে, যদি উপর থেকে কেল্লা টি দেখা যায়, ড্রোন ক্যামেরার মাধ্যমে এখন দেখা যায় তাহলেই কেল্লার জ্যামিতিক নকশা ধরা পড়বে। 2007 সালে এই কেল্লাটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়। কেল্লার ভিতরে মুমতাজ মহল আছে, মোঘল আমলে অন্যতম মহল ছিল, কিন্তু 1857 সালের পর ব্রিটিশরা এই মহলটিকে জেলখানা বা কয়েদখানা পরিনত করে আর বর্তমান এই মহলটি সংগ্রহশালায় পরিনত হয়েছে। 1940 সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ডাক দিয়েছিল চলো দিল্লি! আর এই লালকেল্লা তে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচার করা হয়। 1947 সালে জহর লাল নেহেরু লাল কেল্লার  উপর ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন, আর তারপর থেকেই লালকেল্লা উপর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

 লাল কেল্লা দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস দলিল হিসাবে।


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://eisamay.com/lifestyle/news-on-travel/how-much-fo-you-know-about-these-facts-of-red-fort-delhi/articleshow/91632844.cms#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16914023499404&csi=1&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Feisamay.com%2Flifestyle%2Fnews-on-travel%2Fhow-much-fo-you-know-about-these-facts-of-red-fort-delhi%2Farticleshow%2F91632844.cms
 

https://roar.media/bangla/main/history/lal-qila-glorious-history-of-delhi#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16914023499404&csi=1&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&ampshare=https%3A%2F%2Froar.media%2Fbangla%2Fmain%2Fhistory%2Flal-qila-glorious-history-of-delhi


https://www.hindustantimes.com/cities/delhi-news/delhiwale-the-pale-white-red-fort-101633135716100.html


https://m.timesofindia.com/city/delhi/one-wall-inside-red-fort-to-turn-white/articleshow/8448477.cms

Comments