কলকাতা শহরে বাঘ পড়েছিল !

লোকালয়ে বাঘের উৎপাত



 কথা আছে বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে তাঁর দ্বিগুণ। বাঘ, আমাদের জাতীয় পশু। আর এই বাঘের দিন অর্থাৎ Tiger Day পালন করা হয় 29 জুলাই । বাঘ আমাদের বিভিন্ন গল্পে জড়িয়ে আছে । ফেলুদার দুটো গল্প অন্যতম হলো বাঘ । আগে তো সার্কসে প্রধান আকর্ষণ ছিল বাঘের খেলা। সুশীল দেবী তো খালি হাতে বাঘের খেলা দেখাতেন, সেই কথা আগেই বলেছি। জিম করবেট তো একটা পোশা বাঘ ছিল। কান পাতলে শোনা যায় কলকাতা নাকি বাঘের দুধ ও পাওয়া যায়। জানা যায় আমাদের এই কলকাতায় একসময়ে খুব বাঘের উপদ্রব ছিল, আসলে জোব চার্নক আসার আগে কলকাতা ছিলো বন আর জঙ্গলে ভরা। আর স্বাভাবিক ভাবেই বাঘের তো জঙ্গলে থাকবে, আর তাদের আস্তানায় যদি, অন্য সবাই এসে বসবাস করেলে তাদের তো অসুবিধা হবেই । শোনা যায় কলকাতা একসময় বাঘ বিক্রি হতো ! হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক পড়ছেন, বাঘ বিক্রি হতো কলকাতায়। বলা হয় লালবাজারে এক সাহেবের দোকান ছিল, সেই সাহেবের নাম মিস্টার স্মিথ, আর ওনার লালবাজারে দোকানের নম্বর ছিল 230. আর এই মিস্টার স্মিথ বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন বাঘ বিক্রির, 1799 সালে। কলকাতা তো তখন ব্রিটিশ রাজ, হয়তো কোনো খদ্দের ছিলো সেই জন্য হয়তো এই বিজ্ঞাপন।
পুরনো লালবাজার 


শুধু একটা বাঘ ছিল না, ছিল দুটি একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর অন্যটি চিতা বাঘ। আবার রয়েল বেঙ্গল টাইগার দুটো শাবক ছিল আর তাদের বয়স ছিল চারমাস। এইরকম বিজ্ঞাপন দেখে তো কেউ এই জিনিসটা নিজের চোখে দেখবেনা সেইটা হবে না, এই ভাবনাটি আগেই ভেবে রেখেছিল স্মিথ সাহেব। আর সেই জন্য যে সমস্ত মানুষ, এই বাঘ গুলি দেখতে আসতো তাদের দিতে হতো আট আনা। কিন্তু সেই বাঘ কে বা কোনো সংস্থা কিনেছিলো কি না ? সেই কথা জানা যায় নি। আগেই বলেছিলাম কলকাতা আগে জঙ্গল ছিল, 1706 সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমি জরিপ করেছিল, সেই জরিপ অনুযায়ী সুটানুটি গ্রামের আশি শতাংশ ছিল জঙ্গলে ভরা আর গোবিন্দোপুরের পঁচানব্বই শতাংশ ছিল বন জঙ্গলে ভরা। বলা হয় এখন সুন্দরবন অঞ্চলে যেই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দেখা যায়, সেই ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছিল এই কলকাতায়। এখন যেই চৌরঙ্গি অঞ্চল দেখতে পাই, তখন সেখানে ছিল বন জঙ্গলে ভরা আর সেই সব অঞ্চলে ছিল বাঘ।

চৌরঙ্গী 


 কলকাতার বিভিন্ন খবর কাগজে, খবর বেরত সেই সব খবর। যেমন সমাচার দর্পণ পত্রিকায় 1825 সালের জুলাই মাসের নয় তারিখের খবর লিখছে "অল্পকালেতে যে কোন নগর এমত বর্ধিষ্ণু হইয়াছে ইহা আমরা প্রায় শুনি নাই। চিতপুরের যে ব্যাঘ্র-ভীতি তাহা অদ্যাপি লোকেরা কহে এবং যাহারা চৌরঙ্গীর বন দর্শন করিয়াছে এমত লোকও অদ্যাপি আছে।"  

সমাচর দর্পণ 

তবে সমাচর দর্পণ এও জানাচ্ছে যে সকল মানুষ এই সব বলছে তারা কিন্তু নিজের চোখে বাঘ দেখনি শুধু মাত্র চৌরঙ্গির জঙ্গল দেখেছেন আর বাঘ কথা শুনেছেন। তবে কি শুধু মাত্র শোনা কথাই লিখেছিল, সমাচার দর্পণ ? 

পরেরদিন মানে 14 April আবার ঐ বাঘ আক্রমন করে একটি দেড় বছরে ছেলেকে, সেই ছেলে আবার ছিল রাজপরিবারে। এই ঘটনাপর চার কেটে গেলে প্রশাসনের নো নড়ন-চরণ। 19 April সংবাদ প্রভাকর জানাচ্ছে যে বা কার্যত নির্দেশ দিচ্ছে "এইক্ষণে পুলিসাধ্যক্ষ মহাশয়েরা ও পল্লীস্থ লোকেরা কথিত ভয়ানক জন্তুর নিপাত বিহিত মনোযোগ করুন।"

সংবাদ প্রভাকর 

আগে বলেছি কলকাতা বাঘ দৌরাত্ম্যের কথা আর বলেছি যে স্মিথ সাহেবর বাঘ বিক্রির কথা। কিন্তু জানেন কি একসময় এক বাঙালি বাঘ পুষে ছিল, তাও আবার আমাদের কলকাতাতেই। যিনি খাস কলকাতায় নিজের বাড়িতে বাঘ পুষে ছিলেন তিনি হলেন সৌরিশচন্দ্র রায়, নদীয়া তিনি আবার রাজা সাহেব নামে পরিচিত। এই সৌরিশচন্দ্র রায় মহাশয় একবার মধ্যপ্রদেশ গেছিলেন, কারণ সেইখানে নাকি এক নরখাদক বাঘের দৌরাত্ম্য চলছিল, তিনি ঐ বাঘটিকে মারতে গুলি ছোঁড়েন কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলি লাগলো এক বাঘিনীর গায়ে, নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি সেই বাঘিনীর দুই ব্যাঘ্র শাবকে দত্তক নেন এই ঘটনা ঘটে 1958 সালে। বাঘের দুই বাচ্চাকে নিয়ে আসলেন নিজের বাড়িতে, ঐ বাড়িটির নাম ছিল নদীয়া হাউস। এই নদীয়া হাউস গল্প বলবো অন্য একদিন। বাঘের ভয়ে এই বাড়িতে কেউ আসতো না, আর লোকো মুখে এই বাড়ির নাম হয়ে গেছিল বাঘবাড়ি। 

নদীয়া হাউস 

1972 সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ঐ দুটি বাঘকে বা বাঘের বাচ্চা দুটিকে চিড়িয়াখানা পাঠানো হয়।হরিপদ ভৌমিক তার বই 'কলির শহর কলকাতা' বই তে বলেছেন যে কীভাবে সুন্দর বন অঞ্চলে জঙ্গল কেটে কলকাতা শহরতলি তৈরি করা হয়েছিল। এর প্রমাণও পাওয়া যায়, শিলাদহ তে একটি পুকুর খননের সময় অনেক সুন্দরী গাছের গুঁড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত যে কলকাতায় একসময় সুন্দরবন অঞ্চলে মধ্যেই ছিল। 


এতক্ষনে বিভিন্ন বাঘের কথা বললাম সব ঘটনাই প্রাচীন কলকাতায় ঘটেছিল। আগের সরকারি বাস গুলোতে বাঘের মুখ আঁকা থাকতো। আবার শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেবের ঠাকুর দালান কে লোকে বলতো বাঘওয়ালা বাড়ি, কিন্তু তাদের বাড়ির মূল ফটকের সামনে ছিল সিংহ মুর্তি। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে, বাঘের কিন্তু খুব দরকার সেই জন্যেই প্রতিবছর 29 জুলাই পালন করা হয় আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস। এপ্রিল মাসের একটি তথ্য জানাচ্ছে 2023 সারা ভারতবর্ষে বাঘের সংখ্যা 3167. আর সেই জন্য সারা বিশ্বে একটি বিশেষ যায়গা করে নিয়েছে ভারত। বিশ্বের 75% বাঘ ভারতেই আছে । আমাদের সুন্দরবনে কিন্তু অনেক পর্যটক বাঘ দেখেছেন আবার তাদের ছবি ক্যামেরা বন্দিও করেছে ।আর কদিন আগে তো হয়ে গেল করবেট সাহাবে জন্মদিন। করবেট একটি উক্তি দিয়ে শেষ করলাম 


During my childhood... the... years I spent at school, and again while I was working in Bengal... the time I spent in the jungles held unalloyed happiness for me... My happiness.... resulted from the fact that all wildlife is happy in its natural surroundings. In nature, there is no sorrow and no repining.

Jim Corbett 

ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/kolkata-karcha-200-years-back-tiger-could-have-been-found-in-dumdum-area/cid/1359616


https://www.prohor.in/old-kolkata-tiger-chitpur


https://inscript.me/robibarer-royak-bagh-history-of-kolkatas-tigers


https://inscript.me/tiger-entered-in-kokkata-a-true-story-from-18th-century

Comments