গ্রেট ইস্টার্ন থেকে নানকিং কলকাতার ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ !

গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল 

 সেকালের কলকাতায় প্রথম রেস্তোরাঁ কিন্তু ছিলো, স্পেন্সারস হোটেল তারপর হলো গ্রেট ইস্টার্ন । বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে হারিয়ে যখন, 1757 সালে বাংলা ক্ষমতা দখল করল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । কলকাতা হলো বাংলার রাজধানী, 1772 সালে। যেহেতু কলকাতা নতুন রাজধানী, সেই জন্য মানুষজন কলকাতায় এসে বসবাস শুরু হলো, ইংল্যান্ড থেকে অনেক মানুষ আসছিল জাহাজ ভর্তি করে । সরকারি অথবা বেসরকারি অফিস তৈরি হচ্ছিল। আর তৈরি হয়ে ছিল বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও সরাইখানা । তার মধ্যে প্রথম ছিল স্পেন্সারস হোটেল, 1830 সালে তৈরি হয়েছিল । স্পেন্সারস হোটেল কিন্তু রেস্টুরেন্ট ও ছিল । 

কলকাতার প্রথম রেস্তোরাঁ স্পেন্সারস হোটেল 
 


এরপর তৈরি হয় গ্রেট ইস্টার্ন 1840 সালে । প্রায় একই সময় তৈরি হয়েছিল এই দুটি হোটেল, দশবছরের এদিক ওদিক। আর দুটোরই খাবার আর পানীয় ওরফে মদ ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত । 

ইউরোপীয়রা তো আসতোই আর সেই সময় কলকাতার "বাবু" সমাজের বাবুদের, এই দুই রেস্তোরাঁয় ভালোই যাতায়াত ছিল । কিন্তু শেষমেশ স্পেন্সারস হোটেল বন্ধ হয়ে যায়, আর থেকে যায় গ্রেট ইস্টার্ন ।

এই গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল মালিক ছিলেন ডেভিড উইলসন অ্যান্ড কোম্পানি। এই ডেভিড উইলসন নাম পাওয়া যায় The Bengal Hurkaru নামাক খবরে কাগজে । 

The Bengal Hurkaru খবরে কাগজ

একটি বিজ্ঞাপন ছিল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র যাত্রার, আর মধ্যেই ছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল বিজ্ঞাপন। সাল ছিল 1857 । 

খবরের কাগজে গ্রেট ইস্টার্নের বিজ্ঞাপন 


গ্রেট ইস্টার্নের পাউরুটিও বিখ্যাত ছিলো । ডেভিড উইলসন সাহেব আবার একটি বেকারি খোলেন কসাইটোলা এখনকার বেন্টিক স্ট্রিটে, পরবর্তী সময়ে উইলসন সাহেব রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন তার নাম হোটেল অকলন্ড্য ।

অকলন্ড্য হোটেল 


 জানা যায় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল সঙ্গে মহাবিদ্রোহের এক ভয়াবহ সম্পর্ক আছে । Sir Henry Cotton তার বই Calcutta Old and New: A Historical And Descriptive Hand Book To The City লিখেছেন পুরো ব্যারাকপুর ব্রিগেড কলকাতায় ও তার শহরতলীতে মার্চ করেছিল । ওয়াজেদ আলী শাহ তার সহযোগী নিয়ে গার্ডেন রীচে লুটপাট চালাচ্ছিলেন । ব্রিটিশ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা প্রথম অ্যার্লাম বাজিয়ে ছিলেন, তাদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছিল, কেউ নিজের পিস্তলে গুলি বলছিলেন, কেউ বা আবার দরজায় পাহারা দিচ্ছিল । শহরের বাড়ি গুলো খালি হয়ে গেছিল, ইউরোপীয় পরিবারের গুলি আশ্রয় নিয়েছিল নদী তে ভাষা জাহাজে, আবার অনেক নিজেদের জিনিসপত্র সহ আশ্রয় নিয়েছিল কেল্লায় । এই সবকিছুর সাক্ষী হয়ে এখনো দাড়িয়ে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল । উইলসন সাহেব চেষ্টায় ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে আসে টু স্টোরিড বেকিং ওভেন গ্রেট ইস্টার্নে। অবশ্য উইলসন সাহেবকে সাহায্য করতে পিছপা হয়নি ধনী বাবুরা । সেখানে থেকে জন্ম হয় গ্রেট ইস্টার্ন লোফ বা ব্রেডের । প্রথমে তো ধারণা ছিল পাদিয়ে এই রুটি তৈরি হয় তাই নাম পাউরুটি, পরে অবশ্য এই ধারণা কে ধীল দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে । এরপর বাঙালির ঘরের পাউরুটি পৌঁছে গেছে । শুধু কি গ্রেট ইস্টার্নের পাউরুটি ! তার মধ্যে রকমফের ছিল , যেমন ব্রাউন ব্রেড কিংবা মিল্ক ব্রেড ।

গ্রেট ইস্টার্নের পাউরুটি 

অকলন্ড্য হোটেলের বিজ্ঞাপন 
গ্রেট ইস্টার্নের বিজ্ঞাপন 


শুধু ব্রেড নয় গ্রেট ইস্টার্নের কেক পেস্ট্রি ও জনপ্রিয় ছিল‌ । তবে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল বড়দিন এবং New year Eve এ খুব হইচই হতো এই হোটেলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বড় কর্তা থেকে শুরু করে সব সামরিক  এবং বেসামরিক কর্তা ব্যক্তিরা খানা পিনা করতো মহা সমারোহে, এমনকি দেশীয় রাজা এবং বাবুরা এই উৎসবে সামিল হতেন । 

ফিরপোজ রেস্তোরাঁ 


আমাদের কলকাতায় সব ধরনের খাবারের পাওয়া যায়, তা বাঙালি খাবার থেকে শুরু ইতালির খাবার ! সবাই পাওয়া যায় এই তিলোত্তমা শহরে । ইতালির খাবার কথাই যখন উঠলো, তখন ফিরপোজ কথা না বলে তো চলবে না । এই রেস্তোরাঁটির মালিক ছিলেন একজন ইতালিয়ন নাম ছিল তার এঞ্জেলো ফিরপো । ইনি প্রথমে জেনোয়া, সেখান থেকে লন্ডন ও লন্ডন থেকে আমাদের কলকাতায় আসেন । এঞ্জেলো ফিরপো যখন কলকাতায় এসেছিলেন তখন তিনি, একজন সেফ বা রাঁধুনির সহকারী ছিলেন । এই সেফ আবার ভাইসরয় আর্ল অফ মেয়োর ব্যাক্তিগত সেফ ছিলেন, এই ইতালিয়ন সেফ নাম ছিল,ফ্রেদেরিকো পেলেত্তি । ফ্রেদেরিকো পেলেত্তি আবার 1890 সালে নিজেই রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন, বেশ নামডাক হয়ে ছিল। পেলেত্তি অ্যাসিসটেন্ট ছিল ফিরপো । অনেক‌ কিছু শিখেছেন ও ইউরোপীয় খাবার আর ইতালির খাবার সম্পর্কে । আর এই দুটি কিভাবে তৈরি করতে হয় সেই গোপন টোটকা ও শিখেছেন গুরুর কাছ থেকে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন চলছিল, সেই সময় 1917 সালে কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা চৌরঙ্গী তে ফিরপো নিজের রেস্তরাঁ খুলে বসেন, আর নিজের নামেই নাম রাখলেন ফিরপোজ।

এঞ্জেলো ফিরপো

এখানে পেস্ট্রির পাশাপাশি খাবারের ব্যবস্থা ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো এই রেস্তোরাঁ। বলা হয় যে নিজের গুরু পেলেত্তির রেস্টুরেন্ট কে কয়েক গুণ পিছনে ফেলে দিয়েছিলো ফিরপোজ। জানা যায় ফিরপোজ কেক পেস্ট্রির বিদেশেও নাকি খুব চাহিদা ছিল আর সেই জন্য বিদেশে বহু বেকারির মালিক ভালো চোখে দেখতেন ফিরপোজ কে । ফিরপোজের ব্রেডলোফের খুব নাম ডাক ছিল, আর এখানে খাবারের মেনু কে বলা হয় "তেবল দি হতে" । 

ফিরপোজের মেনু কার্ড

এই তেবল দি হতের কোনদিন তিন টি বা পাঁচটি খাবার নির্দিষ্ট থাকবে গ্রাহকদের জন্য, আর এই তিনটি বা পাঁচটি খাবার কি কি হবে সেটা রেস্টুরেন্টর কর্তৃপক্ষ ঠিক করতো । 

ফিরপোজের বিজ্ঞাপন 

সেই সময়ের গর্ভনর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড আরউইন প্রশংসা করাছিল ফিরপোজের, এমনকি বলা হয় যে গর্ভনর জেনারেল তার কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রতি রবিবার দুপুরে খাবার খেতেন এই ফিরপোজে। জানা যায় নেপালের রাজা ও রাণী ফিরপোজের খাবার খেতে ভালো বাসতেন। 

নানকিং 

কলকাতার রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁ কথা যখন বলছি, তখন চীনে খাবার কথা না বলাটা ঠিক হবে না। এখন তো অলি গলির মুখে দেখা যায় মোমো কিংবা চাউমিনের দোকান। তবে ভারতের প্রথম চীনে রেস্টুরেন্ট ছিল আমাদের এই কলকাতায় । সেই ব্রিটিশ আমলে 1925 সালে তৈরি হয় নানকিং রেস্তোরাঁ। ২২ ব্ল্যাকবার্ন রোড ছিল নানকিং এর ঠিকানা। এই যায়গাটা অবশ্য টেরিটিবাজার এলাকায়, কলকাতা চীনা এলাকা এখানেই গড়ে উঠেছিল। নানকিং বাড়ি টা দোতলা, মন্দির ছিল দোতালায়।

নানকিং এর ভেতরে ঢোকার দরজা 

একটা সময় এই বাড়িটি ছিল চীনা মন্দির, ঐ জন্য যেই দরজা দিয়ে ঢুকতে হতো সেই, দরজার দেওয়ালে মোটা সাদা অক্ষরে লেখা থাকতো  ‘তুং-অন চার্চ’। আউ পরিবার এই রেস্তোরাঁটির মালিক ছিলেন। শোন যায় অতিথি আপ্যায়নের জন্য ভায়লীন বাজানো হতো। এখানে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ডা: বিধান চন্দ্র রায়, উত্তম কুমার সুপ্রিয়া নার্গিস, রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার এই নানকিং রেস্তোরাঁ খাবার খেয়েছেন। এখানে কিন্তু সাধারণ চিলি চিকেন আর চাউমিন বা ফ্রায়েভরাইস পাওয়া যেত না, পাওয়া যেত হরেক রকম চীনা খাবার। আনন্দবাজার একটি খবর থেকে জানতে পারছি সুপ্রিয়া দেবী বলছেন, নানকিং উত্তম কুমার সুপ্রিয়া দেবী দেখা করতেন গোপনে । আরো বলছেন রুপোর কাজ করা তাদের বাসন পত্র এমনকি চায়ের কাপ ও নুনদানিতে ছিল কারুকার্য। নানকিং খাবার সম্পর্কে বলেছিলেন ভারতবিখ্যাত প্রন বল্স, পর্ক রোস্ট বা মাছের স্প্রিংরোল উয়ু ছুঁ কি অসাধারণ সব খাবার। কিন্তু 1962 সালে যুদ্ধের বেশীরভাগ চীনাপরিবার ভারত ছেড়ে চলে যায়। নানকিং রেস্তোরাঁ অবক্ষয় শুরু হয় আউ পরিবার নানকিং রেস্তোরাঁ বিক্রি করে দেয়। তবে এখন লালা বাড়িটি আছে, আর সঙ্গে আছে অজস্র ইতিহাস। 


অনেকে ইতিহাস জড়িয়ে আছে কলকাতার বিভিন্ন রেস্তোরাঁর সঙ্গে অনেক রেস্তোরাঁ এখন চলছে যেমন গ্রেট ইস্টার্ন কিংবা ফিরপোজ আবার কালের নিয়মে থেমে গেছে যেমন নানকিং । কিন্তু রয়েছে বিভিন্ন গল্প.......


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://www.tutorialathome.in/history/firpos-restaurant-calcutta


https://www.tutorialathome.in/history/auckland-hotel-calcutta



https://www.peepultree.world/livehistoryindia/story/trails/great-eastern-hotel


https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/nanking-restaurant-nostalgia-1.657280

Comments