আমূল গার্ল ও আমূলের কাহিনী

Amul Girl 

 

দুধ না খেলে হবে না ভালো ছেলে ! চন্দ্রবিন্দু র বিখ্যাত গান । এখন গরমকাল তাই আইসক্রিম বা কুলফির খাওয়ার প্রচন্ড চাহিদা, স্কুল শেষে কিংবা কলেজ ফিরতি পড়ুয়াদের হাতে কখনো না কখনো থাকবেই । না না আজকে আইসক্রিম অথবা কুলফির কাহিনী বলবো না, আমূলের কাহিনী । আমূল বলতেই মনে পড়ে সেই ছোট্ট মেয়েটি, যিনি পরিচিত Amul Girl হিসাবে ‌। তবে এই Amul Girl এর কথা জানতে গেলে অবশ্যই জানতে Amul এর গল্প । আর Amul গল্প জানতে গেলে অনেকটা পেছনে যেতে হবে, যতে হবে ব্রিটিশ সরকার আমলের  ভারতে ! 

ব্রিটিশ ভারতে 1940 এর দশকে অন্য একটি মাখন খুব জনপ্রিয় ছিল, সাধারণ মানুষ তো আর তখন মাখন খেতে পারতো না, মাখন দেখা যেত ভারতে বসবাসকারী ইংরেজদের বাড়ি আর বড়লোক বাবুদের বড়িতে, সেই মাখনের নাম ছিল POLSON । এই POLSON মাখনের মালিক ছিলেন Pestonji Eduji . ইনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনা বাহিনীকে মাখন বিক্রি করে অনেক পয়সা করেছিলেন।

সেই সংস্থা 


ইনি গুজরাটের খেড়া গ্রামে একটা ডেয়ারি তৈরি করেছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীদের কাছ থেকে বেশী পরিমানে শুল্ক আদায় করতো, আর যারা শুল্ক না দিতে পারতো তাদের সম্পতি বাজেয়াপ্ত করতো ‌। সেই সময় কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়েছিল, একদিকে প্লেগ অন্যদিকে বাড়ি ঘর ব্রিটিশ বাজেয়াপ্ত করছিল। এই সময় গান্ধীজি সর্দার বল্লবভাই পাটেল কে নিয়ে খেড়া সত্যাগ্রহ শুরু করেছিল 1918 সালের মার্চ মাসে । তিন মাস চলেছিল এই সত্যাগ্রহ, অবশেষে ব্রিটিশ সরকার দুবছর জন্য বছরের জন্য শুল্ক বাতিল করে এবং বাজেয়াপ্ত করা সম্পতি ফেরত দিয়ে দিয়েছিল । আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময় ও ব্রিটিশ সেনা বাহিনীকে POLSON মাখন বিক্রি করা হয়েছিল, সেই সময় মানুষের মুখে এই মাখন খুব জনপ্রিয় হয়ে ছিল । সেই সময় 1945 সালে বম্বে গর্ভামেন্ট একটা নতুন নিয়ম চালু করেছিল, এখানে বলে রাখা দরকার যে সেই সময় বম্বে ও গুজরাটের একসাথে ছিল, মানে এখনকার মতো আলাদা রাজ্য ছিল না । সেই নিয়মের নাম হলো বোম্বে মিল্ক স্কিম । 

সেই সময়ের map


বিভিন্ন দুধের ব্যবসায়ীরা এই বোম্বে মিল্ক স্কিমে অংশ নিল কিন্তু জিতলো সেই POLSON কোম্পানি, খেড়া গ্রাম থেকে বম্বের দুরত্ব ছিল 400 কিলোমিটার POLSON কোম্পানি সেই দায়িত্ব নিয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল দুগ্ধ চাষিদের কোন লাভই হচ্ছিল না । তাদের কে বাধ্য হয়ে সেই একই দামে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছিল । দাদনের মতোই হয়তো । এইরকম পরিস্থিতিতে কৃষকদের পাশে দাঁড়ালেন তৃভুবনদাস পাটেল, ইনি গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং অনেক সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন, এবং যখন ডান্ডি আন্দোলন হয়েছিল মানে 1930 সালে সেখানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে জেলবন্দী করেছিল। বলাহয় তৃভুবনদাস পাটেলের পরামর্শে কৃষকদরা একজোট হয়ে সর্দার বল্লবভাই পাটেল কাছে যান এবং এইসব সমস্যার কথা তুলে ধরেন । 

তৃভুবনদাস পাটেল 


বল্লবভাই পাটেল কৃষকদের বলে তোমরা একজোট হয়ে একটি দুগ্ধজাত সমবায় সমিতি তৈরি করো, তিনি আরো বলেন নিজেদের পাস্তুরাইজেশন প্ল্যান্ট থাকা উচিত । তিনি এই কথাও বলেন যে মধ্যস্বত্বভোগিদের কাছে কৃষকদের দুধের বিক্রি বন্ধ করে দেয়া উচিত এবং ব্রিটিশ সরকার কে বাধ্য করতে হবে, যে দুধের কিনতে হলে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকেই কিনতে হবে ।

বল্লবভাই পাটেল এর দায়িত্ব দেয় মুরারজী দেশাইয়ের উপর । বল্লবভাই পাটেল এই কথা বলে দিয়েছিল, ব্রিটিশ সরকার যদি কৃষকদের কাছ সরাসরি দুধ কিনতে অস্বীকার করে, তাহলে ধর্মঘট করবে । হয়ে ছিল ও তাই

ব্রিটিশ সরকার কৃষকদের কাছ থেকে দুধ কিনতে অস্বীকার করে এবং খেড়া জেলা  বা কয়রা জেলা নামে ও পরিচিত ছিলো আর এভাই সৃষ্টি হয়েছিল KAIRA DISTRICT CO - OPERATIVE MILK PRODUCERS UNION LTD. পনেরো দিন ধরে চলেছিল এই ধর্মঘট। তার জন্য কৃষকদের ক্ষতি হয়েছিল অবশ্যই এই ক্ষতির কথা আগেই জানতো খেড়া বা কয়রা জেলার কৃষকরা, কারণ এই কথা আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন বল্লবভাই পাটেল । এই ধর্মঘটের জন্য বোম্বে মিল্ক স্কিম ধসে পড়েছিল, শেষ পর্যন্ত বোম্বের মিল্ক কমিশনার কয়রা গিয়ে কৃষকদের দাবি মেনে নেয় । সত্যি গেছিল কিনা জানিনা হয়তো অতিউক্তি হতে পারে । এরপর তৃভুবনদাস পাটেল ঠিক করেন এই সমবায় সমিতি গুলি তে কৃষকদের কোনো ধর্ম বর্ণ জাতি কোনো কিছু দেখা হবেনা, সবাইকে সমান চোখে দেখতে হবে । তৃভুবনদাস পাটেল 1946 সালে মাত্র দুটি গ্রামে এইরকম সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছিলেন।এরপর 1946 সালে ডিসেম্বর কয়রা জেলা সমবায় সমিতি কে নথিভুক্ত করা হয়।

খেয়া গ্রামের সেই সমবায় সমিতি 


 শুধু কি দুধ বিক্রি করে এই কৃষকদের লাভ হচ্ছিল তা কিন্তু নয়, বোম্বে মিল্ক স্কিমের ও লাভ হচ্ছিল, দেখা যায় মধ্যস্বত্বভোদিরে কাছ থেকে যে টাকায় দুধ কিনছিল, তার অনেক কম দামে এই সমিতির কাছ দুধ কিনতে পারছিল । 1948 এই সমিতি গুলি পাস্তুরাইজেশন প্ল্যান্ট তৈরি করতে শুরু করেছিল, এই পদ্ধতির মাধ্যমে দুধ মধ্যে জীবাণু থাকলে সেগুলি মরে যাবে । আর এই সময় এইরকম সমবায় সমিতি গুলি সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল 432 আর প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হত পাঁচ হাজার লিটারের বেশি। এইরকমই একসময় তৃভুবনদাস পাটেলের সঙ্গে দেখা হয় ডা: ভার্গিস কুরিয়ানের । ডা: ভার্গিস কুরিয়ান ছিলেন মেধাবী একমানুষ, ইনি মাত্র 28 বছর বয়সে জামশেদের পুরের Tata steel institute চাকরি করতেন । তিনি স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করেছিলেন আর দেশে ফিরে 1949 সালের মে মাসে নিযুক্ত হন Dairy Division এর এক কর্তা হিসাবে, 350 টাকা ছিল তার বেতন আর তার অফিস ছিল গুজরাটের আনন্দ শহরে । যেই বাড়িতে ডা: ভার্গিস কুরিয়ানের অফিস সেখানেই কয়রা সমবায় সমিতির অফিস, আর এখানেই দেখা হয়েছিল ডা: কুরিয়ানের সঙ্গে তৃভুবনদাস পাটেলের । 

ডা: কুরিয়ান


1950 সালে ডা: কুরিয়ান কে এই সমিতির উচ্চ পদে নিয়োগ করা হয়। ডা: কুরিয়ানের আত্মজীবনী "I TOO HAD A DREAM" কি ভাবে কেন তিনি এ সমবায় সমিতি ছিলেন এই সবকিছু তাঁর আত্মজীবনী উল্লেখ করেছেন । 

ডা: কুরিয়ানের আত্মজীবনী 


আবার মূল গল্পে ফিরে আসা যাক 1953 সাল নাগাদ এত দুধ উৎপাদন হচ্ছিলো যে বোম্বে মিল্ক স্কিমের মধ্যে আর রাখা যাচ্ছিল না। কি করা যায় এই অতিরিক্ত দুধ দিয়ে, ঠিক করা দুধের গুঁড়ো বানানো হবে কিন্তু আবার একটা অসুবিধা এসে উপস্থিত, মোষের দুধ কে অত সহজ গুঁড়ো দুধ বানানো যাবে না, তার জন্য দরকার উন্নত তথ্য প্রযুক্তি ‌। এই সময় ডা: কুরিয়ানের বন্ধু ডা: হরিচন্দ্র দালায়া উনার সাহায্য তৈরি হয়ে মোষের দুধ থেকে দুধের গুঁড়ো বানানো মেশিন, যাকে বলা হয় SPRAY DRYER FOR BUFFALO MILK . একটি কারখানা খোলা হয় গুঁড়ো দুধ বানানো জন্য । 

হরিচন্দ্র দালায়া


ঐ কারখানায় দিনে এক লক্ষ্য লিটার দুধকে প্রোসেসিং করা হতো আর ঐ কারাখানাই ছিল এশিয়ার প্রথম মোষের দুধের গুঁড়ো দুধ বানানো কারখানা । প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও ঐ কারখানার উদঘাটন করে 1955 সালের 31 অক্টোবর যেদিন সর্দার বল্লবভাই পাটেল জন্মদিন । 

এই তিনজন না থাকলে হয়তো আজকে আমূল হতো না 


এই সমবায় সমিতি গুঁড়ো দুধ, মাখন বা অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি এবং বিক্রি করবে । 

সবই তো হলো, কিন্তু এই ব্র্যান্ডের কি নাম দেওয়া যায়, ওখানকার এক কর্মচারী বলেন 'আমূল' এই শব্দের সংস্কৃত ভাষায় মানে অমূল্য বা মূল্যবান । আবার অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে Anand Milk Union Limited নামের প্রথম অক্ষর গুলি নিলে AMUL . আমূল কিন্তু তখন বাজারে একা ছিল না তার সবসময় প্রতিপক্ষ ছিল সেই প্রথম দিকে বলেছিলাম যে মাখন কথা অর্থাৎ POLSON মাখন । কিন্তু POLSON মাখনকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে আমূল মাখন ।   POLSON মাখনকের বাক্সে একটা বাচ্চা মেয়ে ছবি থাকতো , আমূল কে ও তো কিছু একটা করতে হবে এই সময়ে 1966 সালে সিলভেস্টার ডা কুনা Sylvester Da Kuna তৈরি করেন আমূল গার্ল কে ।

Sylvester Da Kuna


 আমূল গার্লের নামে গিনিস বুক ওয়ার্ল্ড রেকর্ড রয়েছে । এই গুজরাট সেই সময় অনেক ছোট ছোট দুধ তৈরি ছোট ছোট সমিতি গড়ে ওঠে তবে তারা সবাই কয়রা ইউনিয়ন সাথে যুক্ত হয় । আমূল এমনি এক সমস্থা যার কোনো আছে CEO নেই আছে ম্যানেজার মানে আমূলের মালিক হচ্ছে কৃষকরা । একসময় ভারত বিদেশ থেকে গুঁড়ো দুধ আমদানি করতো, এখন আমূল বিদেশ দুধ রপ্তানি করে আমেরিকাসহ । আর আমূল কোনো কর্পোরেট সংস্থা নয় আর সেই জন্য স্টক এক্সচেঞ্জ আমূল নেই । এইরকম সংস্থা খুব কম দেখা যায়।


ছবি সূত্র - Internet

তথ্য সূত্র - Internet এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র 

Comments