পারফিউমের অজানা গল্প

পিরামিডে সুগন্ধি বা Perfume ব্যবহার ছবি

 

" ফেলুদা পরে বলেছিল, মহাদেব ভার্মার সেন্ট হচ্ছে ডেনিম, আর রায়নারটা হল ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার " দার্জিলিং জমজমাট গল্পে একটা অংশ । অনেক নইশ্চ বুঝে ফেলেছেন আজকে গল্প সুগন্ধি, সেন্ট বা পারফিউমের । 


গরম কিংবা শীত, তবে এখন যা গরম পড়েছে, পারফিউমের ব্যবহার বেশি হচ্ছে । নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পারফিউম ব্যবহার করে । Perfume শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ "per fume" থেকে যার অর্থ 

" ধোঁয়ার মাধ্যমে " । পারফিউমের ইতিহাস কিন্তু খুবই পুরনো, জানা যায় মিশর, মেসোপটেমিয়া, চীন, আরব, গ্রীক, রোম এবং ভারতেও পারফিউমে ব্যবহার ছিল । তবে এই তালিকায় প্রথম কিন্তু মিশরই । মিশরেই প্রথম পারফিউমের ব্যবহার পাওয়া যায় । আরো একটা তথ্য থেকে জানা যায় সাইপ্রাসে প্রথম পারফিউমে তৈরি হয় ।

কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে জানা গেছে তিন হাজার বছর বেশি বছর পুরনো । Tapputi নামক এক মহিলার কথা জানা যায়, তিনি পারফিউম তৈরি করতেন । মিশরে সুগন্ধি বা পারফিউমের জন্য কাঁচের তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারের কথা জানা যায় ।

মিশরীয়রা ধর্মীয় উৎসব কিংবা রোজকার জীবনে পারফিউম ব্যবহার করতো বলে জানা যায় ‌। আরো একটা তথ্য থেকে জানা গেছে যে সমাজের সামাজিক স্থান বোঝানোর জন্য সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করা হতো‌ । উদাহরণ আছে প্রাচীন মিশরের অভিজাত শ্রেণী লিলি ফুলের সুগন্ধি ব্যবহার করতো, এমনকি প্রাচীন মিশরের রাজনীতিতে সুগন্ধির বড় ভূমিকা ছিল, রাজনীতির যেমন আলাদা রঙ আছে তেমনি, প্রাচীন মিশরে রাজনীতির আলাদা সুগন্ধি ছিল । সুগন্ধি কিন্তু প্রথমে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার হতো, মেসোপটেমিয়া ধুপ এর মাধ্যমে চারহাজার বছর আগে, এরপর ধীরে ধীরে মানুষের রোজকার জীবনে ধুকে পরে সুগন্ধি বা পারফিউম । সাধারণ মানুষের জীবনে প্রাচীন গ্রীকদের মাধ্যমেই সুগন্ধি ধুকে পড়ে । তবে সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি প্রচলিত ছিল মিশরেই, জানা যায় তুতানখামেনের মমির শরীরের এক সুতীব্র সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়েছিল । সেই সুগন্ধি গন্ধ তিনহাজার বছর পর  তুতানখামেনের মমির আবিষ্কার সময় 1922 সালে ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক হাওর্য়াড কার্টর পেয়েছিলেন । অবাক করার বিষয় তো এখানেই তিন হাজার বছর পরেও সেই গন্ধের সুবাস ছিল ।

তুতানখামেনের মমি


এখানে তুতানখামেনের জন্ম এবং মৃত্যু সাল টা বলে রাখা দরকার, তুতানখামেন জন্মেছিলেন 1323 খ্রিষ্টাপূর্বে আর তার মৃত্যু হয় 1341 খ্রিষ্টাপূর্বে । এমনকি তুতানখামেনের সমাধিস্থলে সোনা রুপো আরো অন্যান্য মূল্যবান বস্তুর সঙ্গে অনেক সুগন্ধি পাওয়া যায় । এখন তো সবাই বিভিন্ন ব্রেন্ডর সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে, প্রথমেই দুটো ব্রেন্ডর কথা বলেছি তাহলে প্রথমে সুগন্ধি ব্রেন্ড কি ছিল ? এর উত্তর পাওয়ার জন্য আবার বালির দেশে ফিরতে হবে। মিশরের  বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর রাণী মানে ক্লিওপেট্রা, ওনাকে মিশরের চাণক্য বলা হতো, উনি প্রথম রাণী যিনি মিশরে রাজত্ব করেছিলেন । বলা হয়ে থাকে ক্লিওপেট্রা পঞ্চাস বছর মিশরে রাজত্ব করে ছিলেন, ওনি আট ভাষা জানতেন । ওনার বাবার মৃত্যু পর ক্লিওপেট্রা যখন রাজত্বভার গ্রহণ করে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র আঠারো, কিন্তু তার রাজনৈতিক বুদ্ধি ছিল অনেক বেশি, ওনার মৃত্যু ছিল রহস্যময় মাত্র 39 বছর । 


ক্লিওপেট্রা



কিন্তু ক্লিওপেট্রার কথা কেন বলছি, এই রাণী ক্লিওপেট্রার জন্য মিশরের সুগন্ধি প্রস্তুতকারী দের বলেন বিভিন্ন সুগন্ধি তৈরি করতে, যারা সুগন্ধি তৈরি করেছিল তারা ছিল 'কিফি' । তাহলে প্রথমে সুগন্ধি বা পারফিউম ব্রেন্ডের হলো 'কিফি' । আরো জানা যায় ক্লিওপেট্রা নাকি সুগন্ধি তৈরির কারখানাও তৈরি করেছিলেন । প্রাচীন গ্রীকরা বিশ্বাস করতেন সুগন্ধি হলো দেবতাদের দান, এমনকি অনেক গ্রীক দেবীদের নাম বিভিন্ন সুগন্ধি নামে রাখা হয়েছিল । 

এখন অ্যারোমাথেরাপি খুবই জনপ্রিয়, এই অ্যারোমাথেরাপি কিন্তু গ্রীকদের মাধ্যমেই জানতে পারি, পিরামিড দেশ মিশর জয় করার পর গ্রীকরা বুঝেছিল কোন সুগন্ধি ব্যবহার করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, মেজাজ উন্নত হয় প্রভৃতি । বলা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রাচীন গ্রীকরা সুগন্ধি ব্যবহার করতো, বিয়ে সময় তারা একটি বিশেষ সুগন্ধি ব্যবহার করা হতো । এমনকি অতিথি আপ্যায়নে সময় ও সুগন্ধি ব্যবহার চলছিল । এই গ্রীকরা সুগন্ধি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতো, যেমন বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি, বিভিন্ন ভেষজ ( Herbs ) সিদ্ধ করতো, তারপর সেটিকে কেরিয়ার নামক তেলে রেখে দিত ।

বিভিন্ন ভেষজ ( Herbs )


 সাধারণত তারা স্থানীয় ফুলের পাঁপড়ি যেমন লিলি, পার্সেল, আইরিস, ভায়োলেট ইত্যাদি । তারা কি করে বানাতো  বিভিন্ন সুগন্ধি, সেকথা লিপিবদ্ধ করে গেছে ভ্যবিষতের জন্য । বলা হয়ে থাকে প্রাচীন গ্রীকরা সুগন্ধিকে তরল হিসাবে ব্যবহার করতো, তারা তরল গুলি কে বিভিন্ন কাঁচের বোতলে রাখাতো আর এই বোতল গুলি বিভিন্ন প্রাণী এবং পাখির মতো আকারে তৈরি হতো ।

গ্রীক পোড়ামাটির পারফিউম-বোতল, প্রায় 570 খ্রিস্টপূর্বাব্দ


অনেক সেগুলো আবার সংগ্রহ করতো বলে জানা যায় তবে ধাতুর কোনো প্রাত্রে রাখা হতো বলে জানা যায় নি । প্রথমেই বলেছিলাম প্রাচীন ভারতে ও পারফিউম সুগন্ধির ব্যবহার ছিল । চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতায় সুগন্ধি বা পারফিউম কে ইত্তর বা আতর বলে উল্লেখ করা হয়েছে । আবার ইহুদী ধর্মে সুগন্ধি বা পারফিউম কে পবিত্র নৈবেদ্য হিসাবে বলা হয়েছে । চীনা সংস্কৃতি তে সুগন্ধি উল্লেখ রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে প্যাচৌলি বা চাইনিজ ভায়োলেট মত সুগন্ধির খুব প্রশংসা করা হয়েছে, বলাহয় এই সব সুগন্ধি তীব্র গন্ধ বেশ আরামদায়ক ছিল । 

গ্রীকদের সুগন্ধি রাখার পাত্র 

A solidified Roman-era perfume found in Carmona, in the Spanish province of Seville


জাপানের ধুপ তো সুগন্ধি হিসাবে বিখ্যাত ছিলই তাছাড়া ক্যামেলিয়া অথবা চেরী ফুলের সুগন্ধি বিখ্যাত ছিলো । 

এরপর ইউরোপে বিখ্যাত হয়ে যায় সুগন্ধি বা পারফিউমের ব্যবহার, আরবের হাত ধরেই ইউরোপে জনপ্রিয় হয় সুগন্ধি বা পারফিউম । আধুনিক পারফিউম কিন্তু প্রথম হাঙ্গেরি তেই তৈরি হয় । এখন যেমন করে পারফিউম তৈরি হয় মানে সুগন্ধি তেলের সঙ্গে অ্যালকহল মিশিয়ে, একে বলা হত হাঙ্গেরি ওয়াটার । ইউরোপে রাণী এলিজাবেথ 1370 সাল হাঙ্গেরি ওয়াটার ব্যবহার নির্দেশ দেন, বলা হয় এলিজাবেথ নাকি একদম বাজে গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না তাই এইরকম নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে ধরে নেয়া যেতে পারে । তবে খুব কম সময়ে ফ্রান্স পারফিউম এর স্বর্গ হয়ে উঠলো ! সাতেরো শতকে পারফিউম বা সুগন্ধি হাতের দস্তানা ( gloves ) জুতো এই সবকিছু তে খুব ব্যবহার করা হতো পারফিউম । জানা যায় 1656 সালে সুগন্ধি দস্তানা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, আবার এই সুগন্ধি দস্তানা ব্যবহার করে ফ্রান্সের এক রাণীকে হত্যা করা হয়েছিল । গল্পটি খানিকটা এইরকম, 1500 শতকে ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথেলিকদের মধ্য যথেষ্ট মতো বিরোধ ছিল। এই সময় ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় হেনরি বিয়ে করেন ক্যাথরিন কে । এই  ক্যাথরিন ছিলেন ইতালির তাই ফ্রান্সের জনগণ কখনোই তাই নিজেকে রাণী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি । ক্যাথরিনের সঙ্গে এসেছিল বিভিন্ন জিনিসপত্র তার মধ্যে ছিল সুগন্ধি চামড়া হাতের দস্তানা, এই ফ্রান্সে খুব জনপ্রিয় হয়ে ছিল । এই সুগন্ধি দস্তানা আবার নাম ছিল Sweet Gloves. ঠিক হয় Jeanne d’Albret  ছেলে সঙ্গে রাণী ক্যাথরিনের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয় । Jeanne d’Albret প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে নিজের রাজ্যের রাজ ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিল । কিন্তু বিয়ের ঠিক দুমাস আগে হঠাৎ করে মারা যান Jeanne d’Albret বলা হয় যে ওনাকে খুন করা হয় । তাও আবার সেই সুগন্ধি দস্তানা ব্যবহার করে, প্রোটেস্ট্যান্ট মনে করতেন রাণী ক্যাথরিন হত্যা করেছিল রাণী  Jeanne d’Albret কে তবে এই ঘটনা সত্যি না বানানো সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকরা কিছু বলতে পারেনি । 

Jeanne d’Albret


তবে আমাদের কলকাতায় এক ঐতিহাসিক সুগন্ধির দোকান আছে, তখন চিৎপুর রোডে কেরোসিন বাতি বসেছে, রবীন্দ্রসরণী আর কলুটোলার কোনায় একটি দোকান আছে, ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় আসার বহু আগে 1824 সালে খুদা বক্স ও তাঁর ছেলে নবি বক্স এই সুগন্ধির দোকান খুলে বসেন, সেই তখন থেকে আজ অবধি একই যায়গায় আছে এই দোকান । এই তীব্র দাবদাহে কলকাতা খুঁজে পায় আরামের আতর, জুঁই গোলাপ, রজনীগন্ধা আরাম দেয় কলকাতার মন কে । বলা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনকে ছুঁয়ে গেছিল গোলাপ আর জুঁইয়ের সুগন্ধি । 

আর বিশ্বের দামী পারফিউম হলো এইটা 

Imperial Majesty - Clive Christian

ছবি সূত্র - Internet

তথ্য সূত্র - https://www.jugantor.com/todays-paper/jugantor-special/140649/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%97%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%BF-%E0%A6%9A%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BE

https://www.google.com/url?sa=i&url=https%3A%2F%2Fwww-thoughtco-com.translate.goog%2Fhistory-of-perfume-1991657%3F_x_tr_sl%3Den%26_x_tr_tl%3Dbn%26_x_tr_hl%3Dbn%26_x_tr_pto%3Dtc&psig=AOvVaw3Ogvv4DqDBPR8XZtnSUe_k&ust=1686488199502000&source=images&cd=vfe&cs=1&hl=en-GB


https://shono.sangbadpratidin.in/mixed-bag/who-was-responsible-for-the-creation-of-perfume/


https://www.atlasobscura.com/articles/how-catherine-de-medici-made-gloves-laced-with-poison-fashionable


https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/heritage-of-attar-perfume-still-spreading-it-s-fragrance-1.775816



Comments