ডন ব্র্যাডম্যানকে আউট করে প্রথম বাঙালি ক্রিকেটর !

প্রবীর সেন ওরফে খোকন সেন 

 আবার হারের সম্মুখ হোতে হলো ভারতীয় ক্রিকেট দলকে ।

ভারতের ক্রিকেট দল ICC World Test Championship হেরে গেল, 2013 সালে World Test Championship জিতেছিল ভারত, তখন ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন MS Dhoni .

এই কদিন এই সবকিছু কিছু আলোচনা চলছে, চায়ের দোকানে কিংবা টিফিন টাইমে বা রাতে খাওয়ার টেবিলে, বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে । তবে ভাবনেনা এই বিষয়ে নিয়ে লিখতে বা পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা বা গল্প করতে আসেনি । তবে গল্প বলবো, ক্রিকেট নিয়েই বলবো । প্রথম বাঙালি কে যিনি ভারতের ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, তিনি হলেন প্রবীর সেন আর দ্বিতীয় বাঙালি হলেন সরবিন্দু বন্দোপাধ্যায় । ওরফে সুঁটে ব্যানার্জি আর প্রবীর সেন ছিলেন খোকন সেন নামে পরিচিত । 

সরবিন্দু বন্দোপাধ্যায়


বাংলায় ফুটবল খেলা তো সবসময় ছিল আছে থাকবে, কিন্তু সেই সময় ক্রিকেট খেলাও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহিত করেছিল । প্রথম থেকেই ক্রিকেট ছিল সাহেবদের খেলা কিন্তু মহারাজা রনজি সিংজি সাহেবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাহেবদের খেলাতেই সাহেবদের এমনি নাকানিচুবানি হয়েছিল সেই কথা পড়লে বারবার অবাক হতে হয় । 

Ranjitsinhji


ভারত 1932 সালে প্রথম টেস্ট ক্রিকেট খেলার যগ্যতা পেয়েছিল । প্রবীর সেন জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় 1926 সালের মে মাসের 31 তারিখে । তারা মোট চার ভাইবোন ছিল, তিন ভাই এক বোন । প্রবীর সেনের ভাই রণবীর সেন ও বাংলার হয়ে রনজি ট্রফিতে খেলেছিলেন । জানা যায় প্রবীর লেখা পড়ায় বেশ ভালোই ছিলেন, লা মার্টিনেয়ার কলেজ পড়েছিলেন তিনি, আর গ্রেজুয়েশন করেছিলেন ক্যামব্রিজ থেকে । বলাই বাহুল্য যে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলাতেও তার বেশ আগ্রহ ছিল । জানা যায় রনজি ট্রফির খেলায় তার হাতে খড়ি হয়, সেই খেলাটা হয়েছিল ইডেনে, অবশ্যই বাংলার হয়ে খেলেছিলেন তিনি । সেই দিনে বাংলার বিপক্ষ ছিল বিহার । ওই ম্যাচটিতে দুটো ইনিংসে প্রবীর সেন 13 এবং 2 রান করেন আর তিনি ভালো উইকেট কিপিং করতেন, তাই উইকেট কিপার হিসেবে তার তিনটি ডিসমিসাল ছিল ।

এর পরের ম্যাচটিও ছিল ঘরের মাঠে ব্যাটিং ওরডারে প্রমশন পেয়ে ব্যাট করতে নামেন তিনি, বিবি নিমবালকার, হীরালাল, মুশতাক আলি সিকে নায়ুডুর মত বোলারদের মত বাঘা বাঘা বোলাদের সামনে ক্রিজ কামড়ে পড়ে থাকেন প্রবীর, জানা যায় ঐ ম্যাচটিতে 225 মিনিট ক্রিজে ছিলেন তিনি ইনিংস খেলেন 142 রানের । এইখানে একটা কথা না বললে শান্তি পাবো না মতি নন্দীর বুড়ো ঘোড়া গল্পে, বুড়ো ঘোড়া অর্থাৎ জহর পালের আইডল ছিল সিকে নায়ুডু, যিনি 61 বছর পর্যন্ত রনজি ট্রফি খেলেছিলেন । পড়ে কিংবা youtube শুনতে পারেন মতি নন্দীর 'বুড়ো় ঘোড়া' । হ্যাঁ ঐ ম্যাচের পরিনতি হয়েছিলো, হোলকার হেরে যাায় বাংলার ক্রিকেট দলে কাছে । এরপর খানিকটা বরতি ইচ্ছে করে নয় কারণ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । এরপর যখন 1946 সালে ভারতের ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডে যায় টেষ্ট খেলতে, সেই দলে ডাক পায়নি প্রবীর সেন । অবশ্য এতদিনে বাংলা ক্রিকেট নাম ডাক হয়েছে প্রবীরের । তিন বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে ।  অস্ট্রেলিয়া সফরে তার ডাক এসেছিল কিন্তু, প্রবীরের মনে হয়েছিল জাতীয় দলে তাকে না খেলাতে পারে আবার এও মনে হয়েছিল জেনি ইরানির মতো উইকেটকিপার দলে রয়েছে, হয়তো কয়েকটি ম্যাচ তাকে বিশ্রাম দিয়ে প্রবীর কে মাঠে নামাবে । প্রবীর মাঠে নেমেছিল আর একটা দারুন ঘটনা ঘটিয়ে ছিল, সেটা একটু পরে বলছি ঐ অস্ট্রেলিয়া সফরে ভারতের ক্রিকেট দলের শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল । প্রথম ম্যাচে ভারতের পরাজয় ঘটে, দ্বিতীয় ম্যাচ কোনো ভাবে ড্র হয়, সেই ম্যাচটা হয় সিডনি তে আবার তৃতীয় ম্যাচ হয়, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আর সেই ম্যাচে নেমেছিল প্রবীর । কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়া সফরে প্রবীর হৈচৈ ফেলে দিয়ে ছিল বলা হয় যে তখনো তার জাতীয় দলে অভিষেক হয় নি, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সাথে একটা ম্যাচ হয়েছিল অ্যাডিলেড ওভাল স্টেডিয়ামে, বল করেছিলেন ভিনু মানকাড়ে আর ব্যাট করছিলেন জগতের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার স্যার ডন ব্র্যাডম্যান আর উইকেট কিপিং করছিলেন প্রবীর সেন, প্রবীর  ব্র্যাডম্যান কে স্টাম্পড করেছিলেন প্রবীর সেন । প্রবীরকে নিয়ে তো অস্ট্রেলিয়া গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়ে গেল । 

Adelaide Oval


সেই সময় যদি এখনকার মত সোশ্যাল মিডিয়া থাকতো তাহলে তো আর কথাই ছিল না ।


Sir Donald George Bradman


 সে যাই হোক আবার গল্পে ফেরা যাক এবার তো জাতীয় দলে খেলল প্রবীর, কিন্তু ঐ টেষ্ট এ ভাল ফল করেনি ভারত , এমনকি প্রবীর ও না । তবে রন হ্যামেন্সকে স্টাম্পড করে প্রবীর । কিন্তু ব্র্যাডম্যানের শতক এবং অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে তোলে 394 , দ্বিতীয় ইনিংসেও শতক হাঁকান ব্র্যাডম্যান জয়ী হয় অস্ট্রেলিয়া । প্রবীর ভাল ফল করতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া সফরে, সফরের শেষ ম্যাচ হয়েছিল মেলর্বন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পাঁচটি ম্যাচ সিরিজে ফলাফল হয় 0 - 4 . কিন্তু উইকেট কিপার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সমালোচকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিল প্রবীর । জানা যায় উইকেট কিপিং পরামর্শ নিয়েছিলেন ডন ট্যালনের কাছে । সেই সময় ভারতীয় দলে প্রবীরের প্রতিযোগি অনেকেই ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো মাধব মন্ত্রী । ইনি ছিলেন বম্বে টিমের অধিনায়ক , ইনিও প্রবীরের মতো ব্যাটস ম্যান এবং উইকেট কিপার । 

কিন্তু ভারতীয় দলে উইকেট কিপার হিসেবে প্রবীরের ছিল পাকাপোক্ত । কিন্তু তা সত্বেও জাতীয় দল থেকে ছিটকে গেছিল প্রবীর, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ঘরোয়া ম্যাচের পর । কিন্তু হেরে গেলে কী করে চলবে আবার তো ফিরতে হবে জাতীয় দলে । 

জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার ব্যাট হাতে কামাল দেখাতে থাকেন প্রবীর, বাংলার টিমে তিনি ছিলেন, একটা ম্যাচে বিহারের বিরুদ্ধে তিনি ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস খেলেন রান করেন 168 . জ্যোতিষ মিত্র সাথে পার্টানারসিপে রান করেন 231 সেইটা ছিল বেঙ্গল ক্রিকেটে অন্যতম । তবে হ্যাঁ এই সময় কিন্তু জাতীয় দলে তার যাওয়া আসা চলছিল, জানা যায় ইডেন গার্ডেনে একটি ম্যাচে তিন খেলেন, আবার পরের ছিল কানপুরে সেখান থেকে তিনি বাদ পরেন । কিন্তু তার কেরিয়ারের সেরা ইনিংস মানে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার কথা বলছি, সেই টেষ্ট ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মাদ্রাজের চিপক স্টেডিয়ামে, ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড । সালটা ছিল 1952 উইকেট পিছনে থেকে, একেরপর এক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানকে স্টাম্পড করেন প্রবীর ।

প্রবীর সেন 


টম গ্র্যাভেনে, ডোলান্ড কার, ম্যালকম হিল্টন ও ব্র্যায়ান স্ট্যাথামকে স্টাম্পড করেন প্রবীর সেন আর বল করেছিলেন মানকড় । এক ইনিংসে চারটি স্টাম্পড করার জন্য প্রবীর সেন হয়ে যান ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয় উইকেটে কিপার । আর ক্রিকেট ইতিহাসে, প্রথম ইনিংসে পাঁচটি স্টাম্পড করার উইকেট কিপার ছিলেন কিরণ মোরে । আর দ্বিতীয় ইনিংসেও প্রবীর পাঁচটি স্টাম্পড করেছিলেন। প্রবীরের এইরকম অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য 1952 সালে প্রবীর পেয়েছিল  ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার । 

দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করছেন প্রবীর সেন  


প্রবীর সেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর নেন, কিন্তু কলকাতার ক্রিকেট ক্লাব গুলিতে গোটা ষাটের দশকে মাতিয়ে রাখেন তিনি । মাত্র 44 বছর বয়সে ইহলোকে ত্যাগ করেন প্রবীর সেন । তাকে উদ্দেশ্য করে বাংলার ক্রিকেট সংস্থা চালু করেন পি সেন মেমোরিয়াল ট্রফি । 1948 থেকে 1952 সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন তিনি । মোট 14 টি ম্যাচে তিনি 165 রান করেছিলেন তিনি । তবে আবার  পি সেন মেমোরিয়াল ট্রফি চালু হবে 18 জুন থেকে । 


আসলে ICC World Test Championship নিয়ে কদিন ধরে লেখা লেখি, তাই বাংলার প্রথম ক্রিকেটার যিনি ভারতের হয়ে খেলেছিলেন তার কথা খালি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি ।  

 ছবি সূত্র - internet      

তথ্য সূত্র - https://roar.media/bangla/main/biography/probir-sen-first-bengal-cricketer


https://bangla.hindustantimes.com/sports/p-sen-trophy-is-returning-after-6-years-starting-from-18th-june-31686159513404.html

Comments