যখন রুটিকে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশরা !

রুটি বা চাপাটি 

 

রুটি সকালে জল খাবারে কিংবা রাত্তিরে অনেকেই রুটি খেতে পছন্দ করে রুটি আর মাংস তো অনেক মানুষেরই পছন্দ ‌। রুটি অনেক প্রাচীন খাবার, বলা হয়ে থাকে যে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ রুটি খেয়ে চলেছে । গমে ভাঙাতে হয়, মানে গমেকে শুকুয়ি তারপর গুড়ো করতে হয়, সেই গুড়ো কে বলে আটা । আটাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জলের সঙ্গে মিশিয়ে, সেইটা মেখে গরম করলে রুটি তৈরি হয় । কিন্তু এত কঠিন পদ্ধতি প্রাচীন মানুষ জানতো না, তারা গমের দানাই তাদের খাবার ছিল ‌। কিন্তু নব্যপস্তর যুগ থেকে রুটির প্রচলন শুরু হয় । আরো একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে যীশু খ্রিষ্টের জন্মের আগেও রুটি ছিল । যদি বলা হয় কোন দেশে প্রথম রুটির চল শুরু হয় তাহলে বলতেই হবে মিশরে । মিশরে আট হাজার খ্রিষ্টাপূর্বে রুটির প্রচলন শুরু হয় । মিশরেই প্রথম পাথেরের তৈরি গমের মতো শস্য ভাঙার জন্য যন্ত্র আবিষ্কার ও হয়ে গেছিল ‌। শুধু তো গম থেকে আটা পাওয়া যায় তা তো না, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা থেকে ও আটা পাওয়া যায় । এখন যে রেস্তোরাঁয় ম্যাক্সিকান খাবার খাই তারমধ্যে,  উল্লেখযোগ্য হলো  'নাচোস' ( মানে নৃত্য নয় ) সেইটা ভুট্টার আটার রুটি । আমাদের ভারতে রুটি কে চাপাটি বলা হয়ে থাকে । 

শ্রী কৌশিক মজুমদার প্রণীত নোলা বইটি থেকে জানতে পারি থাপ্পড় কে ফরাসিরা 'চাপাট' বলতো আর তার থেকেই চাপাটি ।

 এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে রুটি বা চাপাটির কথা হচ্ছে কেন ? হচ্ছে কারণ আজকের গল্পেটাই রুটি কে নিয়ে, তবে একটু অন্যরকমের । 


যেই ঘটনার কথা এখন বলবো, সেই ঘটনাটি হয়েছিল আমাদের ভারতেই 1857 সালে । হ্যাঁ সবার 1857 সালে মহাবিপ্লবের কথা মনে আছে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতার প্রথম আন্দোলন । তবে এখানে মহাবিপ্লবের কথা বলবা না । বলবো এক অন্য ঘটনার কথা, যেই ঘটনার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভাবনায় ফেলে দিয়ে ছিল ।  

এই ঘটনা ঘটে 1857 সালে ফেব্রুয়ারি মাসে । আগ্রার মথুরা শহরের ম্যাজিস্ট্রেট দেখলেন তার টেবিলে অনেক রুটি পড়ে আছে , কি ব্যাপার জিঞ্জেস করলেন সাহেব তার কর্মচারী কে ? তার কর্মচারী জানায় যে এই গ্রামের পুলিশ চৌকিদারের কাছ থেকে জানা গেছে, কেউ বা কারা চারটে করে রুটি একটি গ্রাম পৌঁছিয়েদেয় আর সেই গ্রামকেও বলে অন্য গ্রামে রুটি পৌঁছে দিতে আর এই কাজ গুলো গ্রামের পুলিশ চৌকিদারই করতো । খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেল মথুরার প্রায় সব জেলা তেই এই রুটি চালাচালি চলছে ‌। 



দেখা যায় নব্বই হাজারের বেশি পুলিশ চৌকিদার মাধ্যমে এই রুটি গ্রামে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে গেছে । এমনকি থানা গুলিতে রুটি পাওয়া গেছিল, হঠাৎ এমন কী হয়েছিল যে এতো রুটি সব যায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে, এই ঘটনা ব্রিটিশ সরকার কে ভাবতে বাধ্য করেছিল । তৎকালীন মথুরার ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থর্নহিল এই ঘটনার তদন্ত করবে বলে ঠিক করেন । 


এই তদন্তের ফলে জানা যায়, এই রুটি চালাচালি শুধু মাত্র মথুরা মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, নর্মদা নদীর দক্ষিণ তীর থেকে শুরু করে উত্তরে নেপালের সীমান্ত পৌঁছে গেছিল এই আন্দোলন । ব্রিটিশরা রুটি চালাচালি কে একটি গাল ভরা নাম দিয়েছিল Chapati Movement বা রুটি আন্দোলন । এই আন্দোলন প্রায় তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশরা তদন্ত করে জানতে পেরেছিলো লখনৌ, ইন্দোর, বাংলা, ফারুখবাদ, গুড়গাঁও, অবধ, রোহিলখণ্ড, দিল্লি মানে পুরো উত্তর ভারতের এই আন্দোলন চলেছিল । বলা হয়ে থাকে যে, সেই সময় ব্রিটিশ মেল সবচেয়ে বেশি দ্রুত ছিল, কিন্তু তার থেকে আরো বেশি দ্রুত ছিল এই আন্দোলন, যার জন্য ব্রিটিশরা আরো বেশি ভয় পেয়েছিল । 

যেই সব যায়গায় পৌঁছেছিল এই আন্দোলন 


ব্রিটিশরা যে সত্যি ভয় পেয়েছিল এর প্রমাণও পাওয়া যায়, একজন ব্রিটিশ আর্মির ডাক্তার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হয়ে ভারতে ছিলেন, সেই ডাক্তারের নাম গিলবার্ট হ্যাডো ( Dr. Gilbert Hadow ) তিনি তার বোন কে চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠিতে এই ঘটনার উল্লেখ আছে সেই চিঠির কয়েকটি লাইন বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় যে ' কিছু একটা রহস্য জনক ঘটেছে চলছে পুরো ভারতে, কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না কি ব্যাপারটা ঘটেছে । কেউ বা কারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে, কী জন্য ঘটাচ্ছে সেইটাও জানা যায় নি, এও মনে করা হচ্ছে, এর সঙ্গে কোনো গোপন সংস্থা ও জড়িয়ে থাকতে পারে । খাতায় কলমে নাম দেওয়া হয়েছে রুটি বা চাপাটি আন্দোলন ।'  

অন্য একটি তথ্যের মাধ্যমে জানা যায় 

1857 সালের মার্চে 5 তারিখে একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র 

" The Friend of India " উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অফিসারেরা ভীষন বিভ্রান্ত যে কোথাথেকে এই রুটি গুলি আসছে ? 



বলা হয় যে সেই সময় চৌকিদারেরা নিজেদের পাগড়িতে রুটি রাখতো । যখন এই ব্রিটিশ পুলিশরা গ্রামের চৌকিদার ধরপাকড় ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো এমনকি অনেক ব্রিটিশ পুলিশ চৌকিদারই ছিল এদের মধ্যে, অবশ্যই তারা কেউ সাহেব ছিল না, নেটিভ ছিল কিন্তু কোনো ভাবেই জানা গেল না যে আসল ব্যাপারটা কি ছিল । 


তবে ব্রিটিশরা কয়েকটি ধারণা কথা উল্লেখ করেছেন । শুরুতেই যেই ধারণা কথা বলা হয় সেইটা হলো ষড়যন্ত্রের ধারণা, অনেকে বলে থাকেন রুটি গুলির মধ্যে কোনো গোপন সংকেত বা চিহ্ন ছিল । কিন্তু এইরকম কোনো সংকেত বা চিহ্ন ছিল না ফলে এই ধারণা কে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় । অনেকেই ধারণা করেন যে এই রুটি বা চাপাটি আন্দোলন ছিল মহাবিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহের প্রথমধাপ । এই আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষকে একত্রিত করেছিল, কারণ মে মাসের 10 তারিখে 1857 সালে মীরাটে মহাবিদ্রোহ শুরু হয় । ফতেপুরের কাল্কেটর ছিলেন জে ডব্লিউ শেরার 

( J W Sherar ) তার বই ‘Daily Life during the Indian Mutiny’ উল্লেখ করেছেন চাপটি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল রহস্যময় এবং অস্থিরতা পরিবেশ সৃষ্টি করা । এবং সত্যি এটি সফল হয়ে ছিল । অনেক বলে থাকেন রানী লক্ষীবাই আর তাঁতিয়া টোপি যখন, বিদ্রোহের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলেন এবং গেরিলা বাহিনীর জন্য খাবার হিসেবে দিয়েছিলেন ঘি মাখানো রুটি এবং গুড় ।   



আরো আরেকটি ধারণার উল্লেখ করতেই হবে, 1857 সালে নাকি ভারতে কলেরার প্রকোপ দেখা গেছিল, বিশেষ করে মধ্য ভারতে । আর এর জন্য দায়ী ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তারা ভারতীয়দের এই রোগ ছড়াচ্ছে, এই আন্দোলন কিছুটাও হলেও এর প্রকোপ কে ঠেকিয়ে রেখেছিল । Danish-British   colonial India and the British Empire এর ইতিহাসবিদ কিম ওয়াগানার ( Kim Wagner ) মতে এই চাপাটি বা রুটি আন্দোলন লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে প্রাথমিকভাবে কলেরা প্রকপ থেকে রেহাই দেওয়া । তিনি মহাবিদ্রোহের সাথে চাপাটি আন্দোলন একসঙ্গে বসাতে রাজি নন । 


আসল কেন বা কিসের জন্য এই আন্দোলন হয়েছিল সেইটা এখনও অজানা, মহাবিদ্রোহ প্রথমধাপ ছিল এই আন্দোলন, এই ধারণাতেই সবার বিশ্বাস । 


আসলে ইতিহাস ওলটপালট হতেই থাকে, অনেক ঘটনাই পাঠ্য বইতে স্থান পায় না আবার অনেক ঘটনাই পাঠ্য বই তুলে দেওয়া হয়, তবে ইতিহাস চলতেই থাকবে নিজের পথে, এই রকমই অনেক ইতিহাস আছে কিছুটা কিছুটা অজানা ।      

  

 কৃতজ্ঞতা স্বীকার শ্রী কৌশিক মজুমদার    

ছবি সূত্র - Internet

তথ্য সূত্র - শ্রী কৌশিক মজুমদার প্রণীত নোলা,

Time's of India 













Comments