রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন গুপ্ত সমিতির সদস্য !


 

আচ্ছা যদি বলি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গুপ্ত সমিতি সদস্য ছিলেন ! 

প্রথম দুটো লাইক পড়লে স্বাভাবিকভাবেই চমকাতে হবে, বিশ্বকবি তাও আবার, গুপ্ত সমিতির সদস্য ? প্রথমে এই কথাটি তো বিশ্বাস হওয়ার কথাই না, কিন্তু তিনি তার আত্মজীবনী 'জীবনস্মৃতি'তে এর উল্লেখ করে গেছেন । হ্যাঁ তবে তিনি  পরাধীন ভারতে এক গুপ্ত সমিতি সদস্য ছিলেন তাও অনেক ছোট বয়সে । এই গুপ্ত সমিতি ছিল খাস কলকাতা গত বছর, এই পেজে গল্প বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্ল্যানচেটের গল্প, এবার বলবো, রবীন্দ্রনাথ যেই গুপ্ত সমিতি সদস্য ছিলেন সেই গল্প । সামনেই রবীন্দ্রজয়ন্তী, তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অজানা গল্প থাকবেই । 


যে সময়ের কথা বলছি তখন ভারত পরাধীন, ব্রিটিশ ভারত দখলে করে রেখেছে । মহাবিদ্রোহ হয়ে গেছে, ছোট ছোট সমিতি গড়ে উঠেছে । সেই সময় ইতালির বিপ্লবী নেতা মাৎসিনির বক্তব্য ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । এই বক্তব্যটি ছিলো 'কার্বোনারি' মত গুপ্ত সমিতি তৈরি করে দেশ কে স্বাধীন করা । কার্বোনারি মানে হলো The Charcoal Burners.

মাৎসীনি



কার্বোনারি সভার প্রতীক 

সেই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রেরণাতি হয় ঠাকুর পরিবারের ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তৈরি করেন কে গুপ্ত সমিতি ।  

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি এই গুপ্ত সমিতির নামও ছিল অন্যরকম, এমনিতে এই সভার নাম, সঞ্জীবনী সভা কিন্তু সংকেতিক নাম ছিল, হামচুপামুহাফ । 

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর 

এই গুপ্ত সমিতির সভাপতি ছিলেন বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু ইনিও ছিলেন স্বদেশ প্রেমিক। আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই সমিতির সদস্য, তখন গুরুদেবে কিশোর, আরো একজন ছিলেন এই সমিতির সদস্য, তিনি ছিলেন হিন্দুমেলার প্রধান উদ্যোক্তা নবগোপাল মিত্র । যারা এই গুপ্ত সভা বা সমিতির সদস্য ছিলেন, নিয়ম অনুযায়ী তাদের আয়ের কিছুটা এই সভায় দিতে হতো বলে জানা যায় । রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'  তে লিখেছেন  ‘জ্যোতিদাদা এক গুপ্ত সভা স্থাপন করেছেন একটি পোড়ো বাড়িতে তার অধিবেশন, ঋগবেদের পুঁথি, মড়ার খুলি আর খোলা তলোয়ার নিয়ে তার অনুষ্ঠান, রাজনারায়ণ বসু তার পুরোহিত। ' এখানে প্রশ্ন ওঠে এইরকম ব্যবস্থা কেন, বলছি একটা ভাঙা টেবিলের দুইপাশে থাকতো মড়া খুলি, সেই খুলির চোখের কোটরে থাকতো দুটি জ্বলন্ত মোমবাতি, আর থাকতো, আদি ব্রাহ্ম সমাজের লাইব্রেরী থেকে আনা লাল রেশমে জড়ানো বেদ মন্ত্রের একটা পুঁথি । এই সভার সদস্যরা মনে করতেন খুলি মৃত ভারতের প্রতীক, আর জ্বলন্ত মোমবাতি মানে হচ্ছে মৃত ভারতের প্রাণ সঞ্চার করে, জ্ঞান চক্ষু ফুটিয়ে তুলতে হবে । 

হয়তো খানিকটা এইরকম  


এককথায় ভারত কে স্বাধীন করে তুলতে হবে । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই বিষয়ে উল্লেখ  করে গেছেন, এই সভায় অনেক নিয়মাবলী ছিল এও বলাছিল, যারা এই সভার সদস্য তাদের এই সভার কোনো কথা বাইরে বা যারা এই সভার সদস্য নন তাদের সামনে বলা যাবে না ।

এই সভার সমস্ত কাজ কর্ম গুপ্ত সংকতে লেখা হতো । তবে এই গুপ্ত সমিতি কোন বাড়িতে বসতো এই বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করেনি । তবে একটা কথা বলা হয়েছে যে বাড়িটি ছিল পোড়ো বাড়ি । হয়তো এই জন্য, কারণ তারা ছিল এই গুপ্ত সমিতির সদস্য । এখন প্রশ্ন হলো এই বাড়িটি কোথায়, মনে করা হয় 13 কর্নওয়ালিস স্ট্রিট একটি বাড়ি ছিল, সেই বাড়িতে বসতো এই গুপ্ত সভা । ধারণা করা হয় যে উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি কাছে ছিল এই বাড়িটা, রাধারমন মিত্রের কলকাতা দর্পণ এই যায়গাটিকে বলা হয়েছে ঠনঠন । এই সভার বসতো হতো ভরদুপুরে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলেছেন যে সভা শুরু হওয়ার আগে ‘সংগচ্ছধ্বম সংবদধ্বম্  বেদমন্ত্রের এই গান করে সভা শুরু হতো । 

তরুন রবীন্দ্রনাথ 

নতুন কেউ যখন এই সভার সদস্য পদ নিতেন, তখন এই সভার সভাপতি রাজনারায়ণ বসু, লাল পাটের বস্ত্র পরে নতুন সদস্য কে এই সভার সদস্য করে নিতেন । 1877 সালে এই সভার প্রতিষ্ঠা করা হয় ।  বলা হয়ে থাকে মাঝরাতে আগুনের সামনে, বটপাতার উপর লিখে দিতে হতো মন্ত্রগুপ্তির প্রতিঞ্জা, তারপর সেই বটপাতা পবিত্র হোমের আগুন পড়ানো হতো । আগেই বলেছি সদস্যদের আয়ের কিছুটা অংশ সভা দিতে হতো জানা যায় দশ শতাংশ । সভার তহবিলে দিয়ে, স্বদেশী দেশলাই,  স্বদেশী কারখানা তৈরি করতে হবে । যেই বাড়িতে এই সভা বসত, সেই বাড়ির ভেতরের অংশে উপচ নিচে পুরোটাই খালি ছিল । জানা যায় সালটা ছিল 1880 বা তার পর থেকে ঐ বাড়িতে মানুষের বসবাস শুরু হয় । প্রথমদিকে ঐ বাড়ির সামনে দিকে একটা স্কুল হতো ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি নামে, এই স্কুল ছিল 1861 - 1890 সাল পর্যন্ত, আর স্কুলের সময় ছিল, সকাল দশটা থেকে চারটে পর্যন্ত,

সালটা তখন 1872 সেই বছরের এপ্রিল মাসে নবগোপাল মিত্র, এই বাড়িতে তৈরি করেন ন্যাশল স্কুল । এই স্কুল হতো সকালে ও বিকালে, মানে এখান Night School কিংবা Night College আছে ঠিকই সেই রকম ছিল নবগোপাল মিত্র এই স্কুল । বাড়ির ভেতরের অংশের সাথে স্কুল গুলির কোনো সম্পর্ক ছিল না, তাই বাড়ির ভেতরের অংশ পুরো খালি ছিল, ফলে আদি ব্রাহ্মসমাজের মাথারা এখানে সম্পুর্ন গোপনে হামচুপামুহাফ বা সঞ্জীবনী সভার আয়োজন করতেন । এই বাড়িটির সঙ্গে আগে থেকেই বিশেষ পরিচয় ছিল নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসুর । কারণ 1872 সালের সেপ্টেম্বর মাসের 15 তারিখে এই বাড়িতেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে রাজনারায়ণ বসু একটি বক্তৃতা দেন । রাজনারায়ণ বসুই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে কে এই বাড়ির ঠিকানা দেন, এই বাড়িটি ছাড়া ঐ অঞ্চলের আর কোনো বাড়ির সঙ্গে রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্রের পরিচয় ছিল না বলে জানা যায় । ঐ বাড়িটি ছিল সঞ্জীবনী সভার হেডকোয়াটার । তবে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এই গুপ্ত সমিতি বা সভা, অনেকে বলেন ছমাস আবার কেউ কেউ মনে করেন একবছর কিংবা দুবছর ।

সেই বাড়ি 

পরে এই বাড়ি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের ব্যারাক বড়ি হয়ে যায়, কিন্তু যতদিন এই বাড়িতে সঞ্জীবনী সভা অনুষ্ঠিত হতো ততদিন কেউ জানত না এই বাড়িটি ছিল সঞ্জীবনী সভা র বাড়ি । এই সভা থেকে স্বদেশী কাপড়ের কারখানা তৈরি উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছিল, এমনকি একটি কমবয়সী ছাত্রের কাপড়কলে এই সভা থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছিল, কিন্তু খাজনার থেকে বাজনা বেশি সেই কাপড়ের কারখানা থেকে সবেধন নীলমণি মাত্র একটি গামছা তৈরি হয়েছিল । সেই গামছা মাথায় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষক ব্রজনাথ দে র দুহাত তুলে আশ্চর্য নৃত্য করেছিলেন, তার সাথে সভার অন্যান্য সদস্যরা সেই আশ্চর্য নাচে অংশগ্রহণ করেছিল । দেশের জনসাধারণকে সাহসী করে তোলার জন্য এই সভার থেকেই শিকারের আয়োজন করা হয়েছিল, তার সাথে আয়োজন করা ইটিং ক্লাবের কিন্তু শিকার ছিল গৌন ।

আগেই বলেছিলাম না সেই দেশলাই কারাখানার কথা, পরে সেই বিষয়ে গুরুদেবে লিখেছেন, " দেশের প্রতি ওই জ্বলন্ত অনুরাগ যদি ঐ দেশলাই কাঠির জ্বলনশীলতা বাড়াতে পারত, তবে তারা বাজারে চালু থাকতো । " 

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গোপন সমিতি তে আরো একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন, সেইটা হলো যে একটি সর্বজনীন ভারতীয় পোশাক, আবার আন্তর্জাতিক ঐক্য রাখাতে হবে, সেই জন্য অনেক ভেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠিক করলেন মালকোঁচা মারা পরা কাপড় আর রোদ ঝড় বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য, শোলার টুপির উপর পাগড়ি এই পোশাক টি হবে সর্বজনীন ভারতীয় পোশাক । ব্যাস আর কী জানা যায়, পাজামার উপর কাপড় পাট করে নকল মালকোঁচা মত করে পরে নেয়, আর মাথায় শোলার টুপির উপর পাগড়ি চাপিয়ে শহর ঘুরতে বেরোলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর । সবাই তো অবাক কি পোশাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে এমন বীরপুরুষ অনেক থাকিতে পারে কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্য সর্বজনীন পোশাক পরিয়া গাড়ি করিয়া কলকাতার রাস্তা দিয়া যাইতে পারে এমন লোক নিশ্চয়ই বিরল।’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ই স্বর বর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সাহায্যে এই নামটি তৈরি করেছিলেন ঠিক যেমন 'কার্বোনারি' সভায় হতো, সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে নিজের মধ্যে কথাবার্তা বলা । 

ঠিক এই রকম 

আকার = অকার - অকার = আকার - ই = উ - ঈ = উ  

উ = ই - উ = ঈ - এ = ঐ - ঐ = এ - 

ও = ঔ - ঔ = ও 

ক খ গ ঘ = গ ঘ ক খ ~ চ ছ জ ঝ = জ ঝ চ ছ ~ ট ঠ ড ঢ = ড ঢ ট ঠ 

তথদধ= দধত থ ~ প ফ ব ভ = বভপ ফ ~ শ ষ স = হ 

হ=স - র=ল - ল=র - ম=ন - ন =ম 

সন্ জীবনী সভা = হাম্ চুপা মূহা ফ্  


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - জীবনস্মৃতি, কলিকাতা দর্পণ রাধারমন মিত্র, wikipedia 




Comments