ডালহৌসি স্কোয়ার ও অন্যান্য

 

শিল্পীর চোখে ডালহৌসি স্কোয়ার 

ডালহৌসি স্কোয়ার, কলকাতার অফিস পাড়া । এই চত্বরে অনেক সরাসরি বেসরকারি অফিস আছে এখানেই । কিন্তু জানেন কি ব্রিটিশরা আরো ভালো ভাবে বললে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, প্রথম নিজের দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম বানিয়ে ছিল । এখন যেই দুর্গ টা আমরা দেখতে পাই সেটা হলো দ্বিতীয় ফোর্ট উইলিয়াম । কিন্তু কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করলো, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে এখন দেখলে বোঝা যায় না এখানে কোনো সময় এমনও হয়েছিল ।

কতটা যায়গায় তৈরি হয়েছিল ডালহৌসি স্কোয়ার ? জানা যায় ফেয়ারলি প্লেস, কালীঘাট স্ট্রিট, জিপিও, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সদর দপ্তর, পূর্ব রেলের অফিস, কলকাতার কালেক্টর অফিস এখন যেখানে, সেখানে একসময় ছিল পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম, ডালহৌসি স্কোয়ার অংশ । 

 

পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম 

বলা হয়ে থাকে কেল্লার আস পাশেই , ব্রিটিশরা তাদের বসতি গড়ে তুলেছিল । কেল্লার উত্তর পূর্ব দিকে থেকে দেখা যেত, আজকের রাইর্টাস বিল্ডিং এর রোটুন্ডা, আবার কেল্লার সামান্য দুরত্বে ছিল একটা এভিনিউ, কেল্লার কাছেই ছিল কলকাতার শহরের প্রথম অ্যাংলিকান চার্চ, সেন্ট অ্যানস চার্চ । 

বর্তমান সময়ে 


কেল্লার পূর্ব দিকে একটা পুকুর ছিল, ঐ পুকুরটির নাম লাল দীঘি, তার সাথে ছিল একটা পার্ক ছিল, কিন্তু এই কী বর্তমানের পার্ক স্ট্রিট অঞ্চল, সেই জানা যায় নি । 

পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম ঘাট

বলা হয় ঐ পার্কে নাকি ব্রিটিশরা বিকেলে হাঁটতেন বা বলা ভালো সন্ধ্যা ভ্রমণ করতেন । বলে রাখা ভালো কেল্লার উত্তরে একটা রাস্তা, ঐ রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটলেই ছিল একটা ঘাট, সেই ঘাটের নাম ছিল Old Fort Ghat তাই রাস্তার নামও তাই ছিল, এখন আমার যেই রাস্তা, ফেয়ারলি প্লেস চিনি, শোনা যায় সওদাগর উইলিয়াম ফেয়ারলির নামে রাস্তা নাম হয়েছে।

কিন্তু 1696 থেকে 1706 সালের মধ্যে, প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ তৈরি হয়েছিল । কিন্তু 20 জুলাই 1756 সালের গরমকালে, বাংলা বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ কে চারিপাশ থেকে ঘিরে ফেলে । তখন সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী দাঁড়াতে পারেনি, সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনীর সামনে । বাইরের যুদ্ধ আগেই জিতেছিল নবাব, কলকাতা অবরোধ করেছিল । অনেক আগেই খবর পেয়েছিলেন, নবাব যে আজকে কলকাতার সব ইংরেজরা এই কেল্লায় থাকবেন ।

সিরাজউদ্দৌলা
              ‌‌             

আক্রমনে আগেই হিসেবে খাতাপত্র উঠে গেছিল জাহাজ এ, পালিয়েছিল বড় অফিসারের সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়াম গর্ভনর উইলিয়াম রজার ড্রেরক, ঐ যে ঘাটের কথা বললাম, ওখান থেকে পালিয়েছিল ড্রেরক সহ অন্যান্যরা তার ঐদ্ধত্যের কারণে যুদ্ধটি হয়েছিল ।

উইলিয়াম রজার ড্রেরক

 তখন কেল্লায় ছিল কয়েক হাজার অ্যাংলও ইন্ডিয়ান, পর্তুগিজ, কিছু আর্মেনিয়ান মহিলা কিছু বাচ্চারা আর মোটামুটি পাঁচশ মত ব্রিটিশ সৈন্য, তখন তো সবাই ভয়ে তটস্থ । পর পর হচ্ছে কেল্লার উপর নবাবের গোলা বর্ষন । বিকেলে ধোঁয়া বেরল কেল্লা থেকে, সেই ধোঁয়ায় আরো কালো লাগলো সন্ধ্যের আকাশ।

আত্মসমর্পণ করলো 146 জন নারী - পুরুষ সহ জন যেফানিয়াহ হলওয়েল ( John Zephaniah Holwell ) ।  ব্রিটিশদের সাধের কেল্লা তখন ধ্বংশ স্তুপ, উত্তরের প্রবেশ পথ দিয়ে সগৌরবে ধ্বংশস্তুপে পরিনত হওয়া কেল্লায়, সগৌরবে প্রবেশ করলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা । তবে বেশিদিন ছিলেন না তারপর তো, 1757 সালের  পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়, বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা । 

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ঠিক করলেন  রাতটা তিনি কেল্লাতেই থাকবেন, কিন্তু যারা আত্মসমর্পণ করলেন তাদের নিয়ে কী করা যায়, তারা তো এখন যুদ্ধ বন্দী । কেল্লা যখন বানানো হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই জেল ও থাকবে নিশ্চয়ই । ছিল একটি জেল কেল্লায়, জেলর বা ঘরটির নাম ছিল Black Hole, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন নাম ছিল Black Hole Tragedy. তবে এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখা দরকার যে এই ঘটনাকে নিয়ে ঐতিহাসিকদের অনেক বিতর্ক আছে, তার মধ্যে যাচ্ছি না যেটুকু জেনেছি সেটুকুই বলছি, ঐ ঘর বা জেলটি ছিল 14 ফুট বাই 18 ফুট ঘরে ছিল মাত্র দুটো ছোট ছোট জানলা, সেখানেই বন্ধ করে দেওয়া হলো 146 জন নারী পুরুষ সহ শিশু দের । একই জুন মাসের গরম, তারউপর যুদ্ধের ক্লান্তি তার সাথে রয়েছে আগুন ধুয়ো, একবার দুর্বিসহ অবস্থা । পরের দিন সকালে ব্ল্যাক হোলের দরজা খুলে দেখা গেল 146 জনের মধ্যে মাত্র 23 জন জীবিত । এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুরোনো ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ছিলেন, জন যেফানিয়াহ হলওয়েল নিজের খরচায় একটি মনুমেন্ট তৈরি করেন, সেই মনুমেন্ট টা ছিল এখনকার বি.বা.দী বাগ ও এন.এস রোডের মোড়ে । বছর যেতে না যেতেই মনুমেন্টের অবস্থা শোচনীয় হলো, সরকার বাহাদুর বলল ভেঙে ফেল, তাই হল । কিন্তু লর্ড কার্জন ( George Nathaniel Curzon ) বাংলার গভর্নর জেনারেল হয়ে এসে আবার মনুমেন্ট তৈরি করলেন।

হলওয়েল মনুমেন্ট 

কিন্তু এখন আর ঐ মনুমেন্টা বি.বা.দী বাগের মোড়ে নেই, কিন্তু আছে সেন্ট জোনস্ চার্চের কম্পাউন্ডে, এর মধ্যে একটা গল্প আছে, সেই গল্প বলবো অন্য একদিন, তবে এইটুকু বলি 1940 সালে কলকাতার বুকে এক গণ আন্দোলন শুরু হয় , তাদের দাবি ঐ হলওয়েল মনুমেন্টকে সরিয়ে ফেলতে হবে । শহরের বিভিন্ন যায়গা মিছিল করে, মানুষ হলওয়েল মনুমেন্টের সামনে জড়ো হলো, অনেকের হাতে হাতুড়ি আর বাটালী । ওদিকে ব্রিটিশ পুলিশ ও মনুমেন্ট কে ঘিরে রেখেছে, পাঁচ গজের মধ্যে আসলেই গ্রেফতার, অনেকে আন্দোলনকারী তো হলওয়েল মনুমেন্ট ওঠে হাতুড়ি বাড়ি মেরে গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু এই আন্দোলন দেখে অবশেষে ব্রিটিশ সরকার হলওয়েল মনুমেন্ট সরানো হলো । 

বর্তমান সময়ে হলয়েল মনুমেন্ট 

আগেই বলেছিলাম না এই অন্ধ খুব হত্যা নিয়ে, ভারতীয় ঐতিহাসিক ও ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের মতে কেল্লায় ওরকম কোন ঘর ছিলই না এটা সম্পূর্ণভাবে হলওয়েলর ইচ্ছাকৃত ছিল যদি ধরেও না হয় ওরকম কোনো ঘর ছিল কেল্লায় তবে সেখানে ৬০ জনের বেশি কোনোভাবেই ঢোকা সম্ভব ছিল না তার উপর রমেশচন্দ্র মজুমদার সহ অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন হলওয়েলর বক্তব্যের কোন প্রমাণ নেই, আসলে এটা ছিল ইংরেজদের নবাবের সঙ্গে যুদ্ধ করার একটা অজুহাত মাত্র।

জন যেফানিয়াহ হলওয়েল 

 তবে 1899 সালে লর্ড কার্জন, বাংলার গভর্নর হয়ে এসে পুরনো কেল্লার ম্যাপ তৈরি করান এবং চেষ্টা করেন ওরকম কোন ঘর ছিল কিনা সেটা খুঁজে বেরর করার এখন যেখানে জিপিও আছে, সেইখানটা ছিল কেল্লার দক্ষিণ দিক, জিপিও সিঁড়িতে খেয়াল করে দেখবেন, কার্জনের নির্দেশে নির্দেশে পুরনো কেল্লার দেয়াল মাপার জন্য নানা ক্ষেত্রে বসে পিতলের লাইন সেটা আজও দেখা যায় জিপিও সিঁড়িতে, যদি ত্বকের খাতিরে ধরেই নিতে হয় ওই ব্ল্যাক হোলটা ছিল এখন সেটা কোথায় শুনেছি, তোর দিকে জিপিওর উত্তর দিকে কালেক্টরেট অফিসের মাঝখানে একটা সরু গলি, মুখে সরু লোহার গেট, আর ফুটপাত থেকে উঁকি মারছে একটি কামান, যা কিনা 1756 সালের যুদ্ধ ব্যাবহার হয়েছিল । জানিনা সে কামনটা আছে কিনা ! 

সিঁড়িতে পেতলের লাইন  

যেই ঘরের নাম Black Hole তখন আর এখন 

কার্জনের নির্দেশে তৈরি
 পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের map

কিন্তু এখন ডালহৌসি স্কোয়ার আছে ঠিকই, কিন্তু আমারা চিনি বি.বা.দী বাগ নামে । বি.বা.দী বাগ কেন ?  ওমা বিবাদী বাগ কেন,  স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়, বাদল, দীনেশ এই তিন স্বাধীনতা সংগ্রামী নামে নামকরণ হয় ডালহৌসি স্কোয়ারের । তৎকালীন ব্রিটিশ কলকাতায় মহাকানে তুঙ্গে মহাকরণে ঢুকে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য দুঃসাহসী অভিযান চালিয়েছিল, এবং শহীদ হয়েছিল এই তিন তরুণ । 

বিনয় বাদল দীনেশ 

বি.বা.দী বাগের নামের কারণ জানা গেল, লর্ড ডালহৌসির নামে নামকরণ হয়েছিল, কিন্তু স্কোয়ার কেন, এই স্কোয়ার কী জ্যামিতির স্কোয়ার। একেবারেই না, এই স্কোয়ারের মানে হলো শহরের মধ্যে খোলামেলা যায়গা। 

বলা হয় ইউরোপের রেনেসাঁ যুগে শহরে কে নতুন ভাবে পরিকল্পনা করা হয় । সেই দেখে লন্ডনে ও স্কোয়ার তৈরি হলো, ব্রিটিশ যখন কলকাতাকে রাজধানী তৈরি করে, তখন লন্ডনের মতো কলকাতায় ও স্কোয়ার তৈরি করা হলো, কিন্তু কলকাতায় বেশিরভাগ স্কোয়ারেই পুকুর থাকতো, যেমন ডালহৌসির স্কোয়ারের লালদিঘী ।

লাল দীঘি 

এই ভাবেই খুঁজলে পাওয়া যায় তিলোত্তমার ইতিহাসের গল্প, তাই তো বলি ঘুরে দেখ কলকাতা !


ছবি সূত্র - Internet

তথ্য সূত্র - দীপের চোখে কলকাতা, wikipedia, এবং internet


https://voboghure.home.blog/2019/05/10/%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%B9%E0%A7%8C%E0%A6%B8%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A7%80-%E0%A6%AC/#:~:text=%E0%A7%A7%E0%A7%AE%E0%A7%AA%E0%A7%AD%20%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87%20%E0%A7%A7%E0%A7%AE%E0%A7%AB%E0%A7%AD%20%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E2%80%8D%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%20%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%B6,%E0%A6%B8%E0%A6%AB%E0%A6%B2%20%E0%A6%B9%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87%20%E0%A6%A4%E0%A6%BE%20%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%BE%20%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A5%A4


https://www.getbengal.com/details/a-fierce-historic-battle-was-fought-on-dalhousie-square



Comments