মুছে ফেলা গোরস্থান ( North Park Street Cemetery )

নর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি 

 

গোরস্থানে সাবধান গল্পটি পড়েছেন নিশ্চয় , যেখানে লালমোহন বাবু ওরফে জটায়ু, ফেলুদা কে নতুন কেনা সবুজ অ্যাম্বাসডর গাড়ি দেখাতে এনেছিলেন । এখান থেকেই গল্প শুরু হয়েছিল । না না ফেলুদার গল্প বলছি না, কিন্তু একটা গোরস্থানের গল্প বলবো । সবাই চিনি Park Street Cemetery কে, কিন্তু পুরো নাম Park Street Cemetery না, South Park Street Cemetery হলো পুরো নাম । আচ্ছা এখানে প্রশ্ন ওঠে South কেন ? শুধু পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি নয় কেন ? উত্তর এখানেই কারণ দুটি সেমিট্রি ছিল

একটি South Park Street Cemetery আর অন্যটা

North Park Street Cemetery. 

এখন যেখানে মার্সি হাসপাতাল আর অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ স্কুল সেখানেই ছিলেন নর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি । নর্থ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির কথা বলার আগেই পার্ক স্ট্রিট জায়গাটির কথা বলে রাখি ।

The Assembly of God Church School, Mercy Hospital

পলাশীর যুদ্ধের পর গোবিন্দপুর গ্রাম এলাকায় ইংরেজরা নতুন কেল্লা বানানোর জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের নানান জায়গায় পুনর্বাসন দেয় । ওই সময় চৌরঙ্গী থেকে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রাস্তা তৈরি করে অনেকে  পুনর্বাসন দেওয়া হয়,  কয়েকদিন পরে ওই রাস্তা আর এলাকা নিয়ে তৈরি হয় সাহেবপাড়া । 1762 খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় পার্কস্ট্রিট তখন অবশ্য  নাম ছিল বাদামতলা। রাস্তায় প্রচুর কবরখানা ছিল সেই জন্য না হয়ে গেছিল গোরস্থান কা রাস্তা সাহেবরা বলতো বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড । সেই সময় তো সবাই এই রাস্তায় আসতেই ভয় পেত । কিন্তু এখন তো এই রাস্তা অন্যতম, 25 ডিসেম্বর আর 31 ডিসেম্বর তো কলকাতার এই রাস্তাটি দাঁড়ানোর যায়গা থাকে না । 

যা বলছিলাম ব্রিটিশ এই রাস্তাটির নাম ইচ্ছে করেই বেরিয়াল গ্রাউন্ড রেখেছিল, কারণ এই নাম মাধ্যমে চারটি কবরের স্থান থেকে এসেছে । তবে চারটি মধ্যে একটি তো চেনা বাকি তিনটি হল নর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি, মিশন সেমেট্রি আর ফ্রেন্চ সেমেট্রি । আগেই বলেছিনর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি জায়গায় এখন কি আছে, আর মিশন সেমিট্রি আর ফ্রেন্চ সেমিট্রি জায়গায় এখন আছে এ.পি.জে স্কুল । কিন্তু এতো গুলো কবর স্থানে কি দরকার ছিল, আসলে ব্রিটিশ, ইউরোপীয়রা যখন কলকাতা এসেছিল তখন, এখান আবহাওয়া তাদের সহযোগী ছিল না, ইংল্যান্ডের ঠান্ডা স্যাতসেত্যে আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা সাহেবদের কি আর আমাদের আবহাওয়া সহ্য হয় ! তার উপর কলেরা ম্যালেরিয়া তো ছিলই । 

বলা হয় যে ঘন্টা একজন ইউরোপীয়র মারা যেতই । তখন মল্লিক বাজার এলাকা কলকাতা মধ্যে ছিল না, তাই তখন রাতের অন্ধকারে ইউরোপীয়দের কবর দেওয়া হতো । আসলে যদি কোনো ব্রিটিশ আধিকারিক জানতে পারেন এই সব, তাহলে তো আর কোন অফিসার ইংল্যান্ড থেকে এখানে আসবে না । 

জানা যায় যে এই নর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রিতে 450 টি সমাধি ছিল । এই দিক থেকে দেখতে গেলে সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি বড়ভাই কারণ এখানে আছে 1600 টির বেশি সমাধি, সেই সময়ের বড় বড় ব্রিটিশ আমলাদের থেকে শুরু করে একদম তথাকথিত নিচু স্তরের ব্রিটিশদের সমাধি রয়েছে এখানে । সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রির প্রধান গেটের ফলকে লেখা রয়েছে 1767 সালে এই গোরস্থানে খোলা হয় আর বন্ধ হয়ে যায় 1790 সালে । 

জানা যায় 1785 সালে খোলা হয় নর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি । 

1792 সালের কলকাতার মানচিত্রে দুটি গোরস্থান 


1792 সালের কলকাতার মানচিত্র থেকে জানা যায় পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে গোরস্থান ছিল । 

সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি 


সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি অনেক বিখ্যাত মানুষের সমাধি আছে তাদের মধ্যে অন্যতম ডিরোজিও, তাছাড়া স্যার উইলিয়াম জোনস্ এর সমাধি এখানে আছে । কিন্তু সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি থাকলেও কেন নর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি মুছে ফেলা হলো ? জানা যায় যে ভারতের স্বাধীনতার পর, ইংল্যান্ড বাইরের বেসামরিক সব গোরস্থান গুলিকে রক্ষনাবেক্ষনের জন্য সমস্ত তহবিল বন্ধ করে দেয়, ইংল্যান্ড সরকার। যার ফলে রক্ষনাবেক্ষনের অভাব হয় গোরস্থান গুলিতে, প্রথমে ভাবা হলো যে দুটি গোরস্থান কে একসাথে করে সমতল করে বাগান করে দেওয়া হবে, আর একটা স্মৃতিসৌধ করে দেওয়া হবে । 

সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, সেই সময় কলকাতার বিশপ এই বিষয়, একবাক্যে রাজি হয়েছিলেন । কিন্তু এই জিনিসটা হতে দেয়নি কলকাতার নাগরিকরা, তারা এই বিষয়ে প্রতিবাদ করে, বলা হয় ইংল্যান্ডে এই বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে ছিল । কিন্তু গোরস্থানে রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব, আর সেই জন্য খরচা কে করবে, শেষ পর্যন্ত চাঁদা তোলা হলো, কিন্তু চাঁদা তুলে যে অর্থ জমা হল, সেটা খুবই সমান্য । অন্য দিকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় চাপ দিচ্ছিলেন । আসলে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, গোরস্থানটি না আবার জনসাধারণের শৌচাগারে পরিণত হয় কিংবা কুকীর্তি ডিপো তে পরিণত হয় ।

শেষ পর্যন্ত 1953 সালে নর্থ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি কে ভাঙা হলো, মুছে গেল এক ইতিহাস, কিন্তু ইচ্ছে করলেই কী মুছে ফেলা যায় ইতিহাস ! তবে কি হলো সেই সমাধি গুলোর ? অনেক সমাধির গুলির মার্বেলের স্মৃতি ফলক সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান দেখা যায়, আবার একটি সমাধির মার্বেলের স্মৃতি ফলক এখনো দেখা যায় সেন্ট জনস্ চার্চের দেওয়ালে, সেই সমাধিটি ছিল জেমস অ্যাকলিস কার্কপ্যাট্রিক, ইনি ছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজাম এর রেসিডেন্ট, তার গল্প পাওয়া যায় উইলিয়াম ডালরিম্পলের লেখা ওয়াইট মোঘল বইতে ।



জেমস অ্যাকলিস কার্কপ্যাট্রিক

সেন্ট জনস চার্চে কার্কপ্যাট্রিকের স্মৃতি ফলক 


 আরো হারিয়ে যাওয়া বা মুছে ফেলা সমাধির গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল, উপন্যাসিক উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারের বাবা রিচমন্ড থ্যাকার ‌। তবে একটি সমাধি এখনো রয়ে গেছে আগেই বলেছি এখন যেখানে, মার্সি হাসপাতাল আর দ্যা অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ, ওখানেই আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে মার্সি হাসপাতালে । ঐ হাসপাতালের কম্পাউন্ডে যতদুর সম্ভব একটি গম্বুজ আকৃতির জিনিস আছে, আসলে ঐটা একটি সমাধি ।

রবার্টসন মনুমেন্ট

 সমাধিটি হলো রবার্টসন মনুমেন্ট, ঐ সমাধিটির নিচে শুয়ে আছে রবার্টসন পরিবারের আট সদস্য, এরা হলেন ফ্রান্সিস এডমন্ড রবার্টসন, তার স্ত্রী এলেনোরা ক্যাথরিন রবার্টসন (11 আগস্ট 1813 - 31 আগস্ট 1834), এডমন্ড রবার্টসন (26 জুন 1850 - 29 জুলাই 1905), ন্যাথানিয়েল এবং হেলেন রবার্টসন। , তাদের দ্বিতীয় পুত্র, এডউইন রবার্টসন, তার পুত্র, বার্ট্রাম জেরাল্ড রবার্টসন (10 জানুয়ারী 1884 - 25 ফেব্রুয়ারী 1935), এবং শিশু মেরি এলেন রবার্টসন । জানা যায় এডউন রবার্টসন ছিলেন কলকাতা পুলিশের সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট, বলা হয় আরো একজন উইলিয়াম সিসিল রবার্টসন ওনার সমাধি আছে, লোয়ার সার্কুলার রোডের এক গোরস্থানে । ইনি নাকি কলকাতার পুলিশের ইন্সপেক্টর ছিলেন । এই রবার্টসনের সঙ্গে রবার্টসন মনুমেন্ট যোগাযোগ আছে বলে শোনা যায় । হয়তো এই পুলিশ যোগাযোগ জন্য তাদের সমাধিটি ভাঙা  পড়েনি । নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের আরো একটা সমাধি হলো অ্যান কিয়ারনন্ডারের সমাধি, এই সমাধি টি দেখতে পাওয়া যায় দ্যা অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চের বেসমেন্ট এ । জোহান জাকারিয়া কিয়ারনন্ডার ছিলেন কড়া ধর্ম প্রচারক, তিনি 1758 সালের সেপ্টেম্বর মাসের 29 তারিখে কলকাতায় আসেন । তার প্রথম স্ত্রী 1761 সালে মারা যান এর পর তিনি 1762 সালে আবার বিয়ে করেন। যাকে বিয়ে কররেন তিনি ছিলেন ধনী বিধবা, তিনি আর কেউ নন অ্যান কিয়ারনন্ডার আগে তার পদবি ছিল ওলি, মানে অ্যানি ওলি । কিন্তু তিনিও 1773 সালে মারা জান ।

অ্যান কিয়ারনন্ডারের সমাধির ফলক
 ছবি সূত্র দীপাঞ্জন ঘোষ


 তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি জোহান জাকারিয়া কিয়ারনন্ডার দিয়ে জান, এই জাকারিয়া তার মৃত স্ত্রী অ্যান কিয়ারনন্ডার গয়না বিক্রি করে একটা স্কুল তৈরি করেন, কিয়ারন্যান্ডার মিশন চার্চের পেছনে । তাই সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের সামনে দাড়িয়ে একবার নিশ্চয় মনে পড়বে, 

মুছে ফেলা গোরস্থানটির কথা !   


 ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - http://double-dolphin.blogspot.com/2014/07/north-park-street-cemetery-and.html?m=1 

  

https://rangandatta.wordpress.com/2013/01/23/north-park-street-cemetery-calcutta-kolkata/




Comments