রজনী সেন কান্ত কবি !

রজনীকান্ত সেন 

 

“বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-

কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?” 


রজনী সেন রোড, কলকাতার অন্যতম রাস্তার নাম । সব ফেলুদা প্রেমিরা একবার অন্তত গেছে, রজনী সেন রোড এ, ফেলুদার বাড়ি খুঁজতে । কিন্তু পায়নি, আসলে ফেলুদা তো কাল্পনিক চরিত্র, কিন্তু রজনী সেন কাল্পনিক নয়, বরং সত্যি তিনি ছিলেন । পুরো নাম রজনীকান্ত সেন, এনার নাতনি বাংলার মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ‌‌। ইনি বাংলার পঞ্চকবিদের একজন, পঞ্চকবি হলো যারা বাংলা কবিতার পাশাপাশি গান লিখেছিলেন । এই পঞ্চকবি হলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন ও রজনীকান্ত সেন ।



ইনি কান্তকবি নামেও পরিচিত ‌। রজনীকান্ত সেন ইংরাজি সাল অনুযায়ী, 1865 সালের 26 জুলাই আর বঙ্গাব্দ অনুযায়ী 12 ই শ্রাবণ 1272 . গুরুদেবের থেকে চার বছরের ছোট । রজনীকান্ত সেনের মা মনমোহিনী দেবী গান খুব পছন্দ করতেন, আবার রজনীকান্তের বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন উকিল, তিনি ও গান পছন্দ করতেন । এই গুরুপ্রসাদ সেন আবার 400 টি বৈষ্ণব পদাবলীর একটি সংকলন প্রকাশ করেন, নাম "পদচিন্তামণিমালা" । 


জানা যায় ছোটবেলায় তিনি খুব দুরন্ত ছিলেন, তিনি নাকি এতটাই দুরন্ত ছিলেন, যে পড়াশুনার সময় পেতেন না, কিন্তু মাথা ভালো ছিল ঐ জন্য,  পরীক্ষায় পাশ করে দিতেন । তার ডায়রিতে লেখা পাওয়া যায় 

" আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না । অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই" 

ছোটবেলায় বোয়ালিয়া জেলা স্কুল ভর্তি হন ( বর্তমান সেটি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ) কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন । কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ ও বিএল পাস করেন । রজনীও কিন্তু তার বাবার মত আইনজীবী হলেন, কিন্তু প্রথমদিকে তিনি ওকালতি করতেন না, কারণ পরিবার সচ্ছল ছিল, তার বাবা সাব জজ হয়ে সেচ্ছায় রিয়ার্টড করেন, কারণ ছিল শারীরিক অসুস্থতা ‌। যার ফলে আর্থিক অনটন শুরু হলো পরিবারে, তাই বাধ্য হয়ে রজনী ওকালতি করতেন, সুনাম হয়েছিল ভালই কিন্তু, যার মন প্রাণ গান কবিতায় তার কী ব্যাবসা হয় । রজনীকান্ত সেন নিজেই স্বীকার করেছেন 'আমি আইন ব্যবসায়ী কিন্তু ব্যবসা করিতে পারি নাই' কিন্তু তার গান আর কবিতা লেখার সুবাদে জন্য অনেক মক্কেল ছিল, কিন্তু গান কবিতার জন্য তিনি তাদের সময় দিতে পারতেন না । ঐ জন্যই আইন ব্যবসায় সুবিধা করতে পারেননি তিনি । রজনীকান্তের কাকা ও ওকালতি করতেন ।  ছোটবেলায় থেকেই তার মা বাবার গান প্রতি ভালোবাসা দেখেছিল রজনীকান্ত । রজনীকান্তের এক বন্ধু ছিল তারকেশ্বর চক্রবর্তী, সে নাকি খুব ভাল গান গাইতো তার সাথে মিশেই গানের নেশা রজনীকান্তের হৃদয়ে গেঁথে যায় । মাত্র 15 বছর বয়সে তিনি গান লিখে ফেলেন, ভাবতেও অবাক লাগে । রজনীকান্ত সেনের কবিতা ভাদ্র মাসের 1297 বঙ্গাব্দে আশালতা, নামের একটি পত্রিকায়  প্রকাশিত হয়।

একবার রাজশাহী গ্রন্থগারের, সাহিত্যসভায় রজনীকান্তের বন্ধু অক্ষকুমার মৈত্র বললেন খালি হাতে কেন, কিছু গান নিয়ে যাও । রজনীকান্ত সেন সঙ্গে সঙ্গে গান লিখতে বসে গেলেন, এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি লিখেও ফেললেন সেই গান। সুর দেওয়া হয়েছিল সেই গানটিতে, গান টি হলো 

'তব চরণ নিম্নে / উৎসব শ্যাম - ধরণী সরসা । দারুণ স্মৃতিশক্তি রসবোধের অধিকারি ছিলেন রজনীকান্ত সেন ।

কলেজের কোনো অনুষ্ঠান ডাক, পড়তো রজনীকান্তর । তিনি অনুষ্ঠান বসে বসেই গান লিখে, সেই গানে সুর ও দিতেন সঙ্গে সঙ্গে, এর উদাহরণ আগেই বলেছি ‌। 


1905 সাল গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ঠিক করলেন বাংল কে ভাগ করবেন, আসলে বিপ্লবের আগুন শুরু হয়েছে, ব্রিটিশরা ঠিক সুবিধা করতে পারছে না, দেশাত্মবোধক, বন্দেমাতরম , জাতীয়তাবাদ এই শব্দগুলোর সাথে পরিচয় হচ্ছে, দেশের মানুষের । ব্রিটিশরা অজুহাত দেখালো তাদের নাকি অসুবিধা হচ্ছে কাজ করতে, আসল কারণ কী সেইটা বুঝতে সময় লাগেনি সাধারণ মানুষের । আরো তীব্রতর হলো বিপ্লব, বিদ্রোহের আগুন জ্বাললো বাংলায় ।  

ঠিক করা হলো বিদেশি সবকিছুর বিরোধ করা হবে, বিদেশি পণ্য পুরিয়ে স্বদেশী পণ্য ব্যবহারে উপর জোর দেওয়া হলো । আর এই পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের জন্য ও স্বদেশী পণ্যের জন্য রজনীকান্ত সেন গান লিখলেন ও সুর দিলেন এবং সেই গান দেশের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে , সেই গানটি হলো 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি সাধ্য নাই । এই গানটির জন্য গুরুদেবের পাশাপাশি রজনীকান্ত সেন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে যায়গা করে নিলেন, এই সময় খাদি পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, ডি এল রায় সবাই সমসাময়িক । রজনীকান্ত সেন খুব রস বোধ ছিল, কিন্তু রজনীকান্ত সেন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, রজনীকান্ত সেনর সঙ্গে বিয়ে হয় হিরন্ময়ী দেবীর। তাদের ছয় সন্তান ছিল, চার ছেলে ও দুটি কন্যা, কিন্তু ছেলে ভূপেন্দ্র খুব অল্প বয়সে মৃত্যু হয়, খুব শোক পেয়েছিলেন রজনীকান্ত, কিন্তু থেমে থাকেনি তিনি, বরং ঈশ্বর কে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন 

'তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ, তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব । তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক - বারি, তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব।' জানা যায় ঈশ্বর প্রতি তার খুব আস্থা ছিল, তার কন্য শতদলবাসিনীর মৃত্যুর পর তার ঈশ্বর প্রতি রাগ হয় নি, বরং বিখ্যাত গান ।

রজনীকান্ত সেন গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে । মেডিকেল কলেজের ডাক্তার বলেন যে ওভারস্ট্রেনিং এর জন্য, শ্বাসনালীতে এই অবস্থা । এই রোগের খরচ অতিরিক্ত, তাই বাধ্য হয়েই নিজের প্রিয় দুটি বই 'বাণী' এবং 'কল্যাণী'র কপিরাইট বিক্রি করলেন মাত্র চারশো টাকায় ।



 আসলে এই রোগ টি এমনি যে ধনে এবং প্রাণে দুদিক দিয়ে মারে । মেডিকেল কলেজে যখন ভর্তি হন রজনী, তার তখন ভগ্ন প্রায় চেহারা, গলা দিয়ে আওয়াজ পর্যন্ত বের হচ্ছে না ‌। এই সেদিন ও গান গেয়েছেন এই মানুষটি কে বলবে, রজনীকান্ত কে দেখতে আসলেন রবীন্দ্রনাথ । এই প্রথম পা পড়লো তার মেডিকেল কলেজে । এই মারন রোগের সাথে যুদ্ধের প্রেরণা রজনীকান্ত পেয়েছিলেন, গুরুদেবের কাছ থেকে ।  একদিন স্ত্রীর কান্না দেখে রজনী বলেছিলেন

'আমাকে যদি দয়াল আর কিছু দিন বাঁচিয়ে রাখে তবে শত সহস্র বাণী, কল্যাণী লিখে তোমার পায়ে অঞ্জলী দেব । তুমি আর কেঁদোনা' 


রবীন্দ্রনাথ দেখে উঠে এসে ছিলেন, রজনীকান্ত সেন, কথা বলতে পারছিলেন না, তাই লিখে দিলেন যা বলার ছিল গুরুদেব কে ‌। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জন্য গলায় ফুটো করে দিয়েছিল ডাক্তারা । গুরুদেব দেখলেন সেই লেখা, সেই রাতেই গান লিখে পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে , গানটির নাম ছিল "যজ্ঞাভাঙা" শান্তিনিকেতন গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তার অনুভূতির কথা । কিন্তু 1910 সালের 13 সেপ্টেম্বর মাত্র 45 বছরেই চলে যান কান্ত কবি । 


জানা যায় রজনীকান্ত সেন 290 টি গান লিখেছেন, কিন্তু আরো অনেক গান তো খুঁজে পাওয়া যায় নি, কারণ গান লিখে তিনি সেগুলো উদাসীন ভাবে ফেলে রাখতেন । সেই জন্য অনেক গান পাওয়া যায় না।  জীবদ্দশায় তার তিনটি বই প্রকাশিত হয় আগে দুটোর কথা বলেছি , আর একটি হলো, 'অমৃত' । 


মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় পাঁচটি গ্রন্থ- ‘অভয়া’ ‘আনন্দময়ী’ ‘বিশ্রাম’ সদ্ভাবকুসুম ও শেষদান। এসব গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর গানগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক ও  হাস্যরসাত্মক গান। আর তার নামেই রয়েছে কলকাতার একটি রাস্তা। 




   

ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://www.prohor.in/rajanikanra-sen-sold-his-favorite-books-to-pay-medical-expenses


https://roar.media/bangla/main/literature/kantakabi-rajanikanta-sen

Comments