পাঙ্খাপুলারদের গল্প !

পাঙ্খা পুলার 


দোল বা হোলি যাই বলি শেষ হয়ে গেছে, আবার পরের বছরে অপেক্ষা ।

তার মানেই গরমকাল চলে এসেছে, হোলি আগের থেকেই এই বছর গরমপরা শুরু হয়ে গেছে। অনেকের বাড়িতেই বৈদ্যুতিক পাখা চালু হয়ে গেছে, এক কথায় FAN চালু হয়ে গেছে। কিন্তু জানেন কি কলকাতায় বা ভারতে পাখা নিয়ে একটা জীবিকা ছিল, সেই জীবিকার নাম পাখা পুলার বা পাঙ্খা পুলার । পাঙ্খা পুলার দের গল্পে যাওয়ার আগে পাখা বিষয়ে বলে নেওয়া দরকার। রাজাদের সময় খুব বড় বড় পাখা দেখা যেত, কিন্তু এগুলো ঠিক পাখা বলা ঠিক হবে না, এগুলি কে বলা হতো চামর । হ্যাঁ এখনো চামর ব্যাবহার হয়, পুজোতে এই চামরের ব্যাবহার এখনো হয় । 

চামর


সুলতানদের আমলেও এই চামর দেখা যেত ‌। কিন্তু বাঙালিদের একটা পাখা যা এখন খুব কম দেখা যায় সেটা হলো তালপাতার পাখা । তবে যখন ব্রিটিশরা যখন পলাশির যুদ্ধে সিরাজ কে হারিয়ে, যখন বাংলা দখল করলো তখন সাহেবদের বাড়িতে দেখা যায় বড় বড় তালপাতার পাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে পাঙ্খাওয়ালা ।

সাহেব কে পাখা দিয়ে বাতাস করছে পাঙ্খাওয়ালা 


 এই পাখা গুলো কিন্তু খুব বড় হতো, বলা হয় পাখা গুলির হাতল তিন চার ফুট লম্বা ছিল, আর মাটিতে ভর দিয়ে ঐ পাখা গুলি দাঁড় করানো হতো, তাহলে ভেবে দেখুন কতবড় হতো ঐ পাখা গুলি । যদি পাখার ইতিহাস দেখতে হয়, তাহলে জানা যায় পাখার ব্যাবহার 500 খ্রিষ্টপূবেও প্রচলিত ছিল, আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে যুগেও পাখার ব্যাবহার হতো । কিন্তু ব্রিটিশদের ভারত দখল করার পর জাহাজ ঘাটায় জাহাজের ভিড় লেগেই থাকত, ইংল্যান্ড থেকে সব সাহেবরা ভারতে আসতে শুরু করলো । কিন্তু ইংল্যান্ডের ঠান্ডা স্যাতসেত্যে আবহাওয়া তে বেড়ে ওঠা সাহেবদের ভারতের আবহাওয়া সাথে মানিয়ে নিতে খুবই অসুবিধা হয়েছে ।

গরম কালে তো সাহেবদের নাজেহাল অবস্থা হতো, অনেকে বলে কলকাতার গোরস্থানে অনেক সাহেব সমাধিস্থ আছে এই গরমে জন্য । গরমকালে সাহেবদের বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে, খসখসের পর্দা টাঙিয়ে চার বেলা জল ছেটানো হতো । কিন্তু বড় তালপাতার পাখায়  কতক্ষণ হাওয়া বয়ানো যায়, তাই শুরু দড়ি দেওয়া টানা পাখা, তবে কলকাতায় এই টান দেওয়া পাখা অনেক দেরি আসে । আরবে এই দড়ি দেওয়া টানা পাখার উল্লেখ পাওয়া যায়, এই দড়িতে টানা পাখা ভারতে আসে ইউরোপীয় দের হাত ধরে আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে পর্তুগিজদের হাত ধরে । কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মোঘলদের বা মুঘলদের আমলে দড়িতে টানা পাখা ছিল, কিন্তু ফরাসি ডাক্তার তথা পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ে  আওরঙ্গজেবর সময় ভারতের ছিলেন এবং মোঘলদের বনিকের অন্দরমহলে দড়ি টানা পাখার কথা উল্লেখ করেন তার Trevel in Mughal emperor বইয়ে । 



তাহলে বলা ভালো প্রথমে মোঘল তারপর পর্তুগিজদের পর ব্রিটিশদের সময় এই দড়িটানা পাখা দেখা যায় । আবার কলকাতা কিন্তু দড়ি টানা পাখা অনেক দেরি তে এসেছে, কলকাতার দড়ি টানা পাখা এসছে 1784 থেকে 1790 সালের মধ্যে,  ঐতিহাসিক এইচ ই বাস্টিডের Echoes from old Calcutta, দড়ি টানা পাখার কথা জানা যায় আবার, সোফিয়া গোল পার্কে চিঠিতে উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতে নাকি দু ধরনের পাখা ছিল একটা তো তালপাতার হাতপাখা অন্যটা হল দড়িতে টানা আরেক ধরনের পাখা যা সাধারণত, ব্রিটিশ সাহেবদের বাড়িতে দেখা যেত । গুলি সিলিং থেকে লম্বায় ৮ ফুট বা অনেক সময় ১২ ফুট ছিল এর সাইজ, 

 কাঠ দিয়ে তৈরি ফ্রেমে এগুলি থাকতো অনেক সময় এগুলি মসলিনের কাপড় দিয়ে এই পাখা গুলি মোড়ানো থাকতো। প্রথমে যে বলেছিলাম পাঙ্খা পুলার  জীবিকার কথা, সেই সময় ক্যালকাটা সুপ্রিম কোর্টে রিচার্ড বিচারের সম্পত্তির তালিকায় একটি কাপড়ের পাখার উল্লেখ পাওয়া যায় আবার ১৭৭৫ সালে মহাজন নন্দকুমার এর বিচারের সময় বিচারপতি নাকি অনেকবার পোশাক পাল্টে ছিলেন কারণ ঘাম, তখনো কোথাও পাংখাপুলার এর কথা উল্লেখ মেলেনা, কিন্তু সেই সময় অনেক শিল্পী আঘাতেই পাংখা পুলারদের দেখা যাচ্ছে, যেমন ১৮১৩ সালে আঁকা শিল্পী ডি'অয়েলির আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে সিলিং থেকে কাপড়ের মোড়া পাখা ঝুলছে ,

 


আর দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন খালাসী এরকম আরো অনেক শিল্পী ছবিতে দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা খালাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায় আসলে সেই সময় অনেকগুলি পেশার সৃষ্টি হয়েছিল, তেমন ভিস্তিওয়ালা, ( ভিস্তিওয়ালাদের গল্প আগেই বলেছি ) পাংখা কুলি, প্রমূখ অর্থাত্‍ ধরা যেতে পারে এই পাঙ্খাকুলি হলো পাংখা পুলার। বসার ঘরে, শোয়ার ঘরে কড়িবরগা থেকে কাঠ দিয়ে তৈরি ফ্রেমে যেখানে ঝুলন্ত লং ক্লথ কখনো তাতে জুড়ে দেয়া হতো মসলিনের ঝালর । এই কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো বড় দড়ি চলে যেত পাংখা পুলারে হাতে, সে দড়ি টান দিতে পাখা থেকে বাতাস হতো। কিন্তু তে ঘুমানোর সময় কি করবে! তখন তো তার পাঙ্খা পুলার ঘরে  রাখা যায় না, থাকতো ঘরের বাইরে আর সেই ঝালের দড়ি চলে যেত পাঙ্খা পুলারদের হাতে টানা চার ঘন্টা দড়ি টানতো একজন, আর সময় শেষ হয়ে গেলে আর একজন এসে দড়ি টানতো অনেক সময় যদি, দড়ি টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়লে , টানা বন্ধ হয়ে গেলে সাহেবরা ঘুমের মধ্যে ঘন্টা বাজিয়ে পাংখা পুলার দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতো । ঘন্টার আগে পাখা বন্ধ হলে, সাহেব রা চেঁচিয়ে বলতো পুল পুল । 



সাহেব দেখে কলকাতা বাবুদের বাড়িতে বসে এই দড়ি টানা পাখা । বলা হয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের দূর্গাপুজো দেখতে আসবেন লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংসের মত সাহেবরা সেজন্য দড়িটানা পাখা বসানো হলো । জানা যায় যে এই পাঙ্খাপুলার দের জমিদার বাড়িত বেতন ছিল, মাসে পাঁচ কিংবা ছয় টাকা । 

জমিদার বাড়ি 

 

 শুধু কি ব্রিটিশ সাহেবেদের বাড়িতে এই দড়ি টানা পাখা ছিল না, জানা যায় 1800 সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি সেন্ট জনস চার্চে দড়ি টানা পাখা ব্যাবস্থা করেন । 1856 সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত Putnam's Monthly Magazine Of American Literature, Science And Art এ জানা যায় যে সেই সময় কলকাতা সব ইংরেজ বাড়িতে দড়ি টানা পাখার ব্যাবস্থা ছিল । তবে ইংরেজ বাড়িতে পাঙ্খাপুলার দের বেতন কত ছিল তা জানা যায় নি । কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় পাঙ্খাপুলারদের বিশেষ ছন্দে দড়ি টানদিত, মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী কখন আস্থে আবার কখনো জোরে টান পড়তো দড়িতে । কিন্তু একটা ব্যাপারে বিতর্ক আছে, কলকাতা এই দড়ি টানা পাখা আবির্ভাব কি করে এল ? প্রচলিত একটা ধারণা আছে সেইটা হলো প্রথম যার মাথাই এই ব্যাপারটা এসেছিল তিনি একজন ইউরোপীয় কেরানি, ফোর্ট উইলিয়ামের একটি খুব গরম ঘরে কাজ করছিল ঐ কেরানি, মাথা উপর মশার ভিন ভিন আওয়াজ, ভালো লাগছিল না তার, সেই সময় টেবিলের একটা দিক খুলে মাথার উপর টাঙিয়ে দেয়, আর দড়ি দিয়ে সেটা টেনে হাওয়া খেতে থাকে। এই ভাবেই নাকি কলকাতা আসে দড়ি টানা পাখা । তবে এই পাঙ্খাপুলারদের জীবিকা শেষ হতে বেশি সময় লাগেনি, 1856 সালে ডিপেনিং সাহেব পাঙ্খাপুলার যন্ত্র তৈরি করে, আর ঐ যন্ত্রের পেটেন্টর ব্যাবস্থা করলেন । আর এই যন্ত্রে কলের জল স্রোতে নিজেই চলতো এই যন্ত্র । 1895 সালে লেখা জি এফ অ্যাটকিন্সনের Curry and Rice বই এ লেখা থেকে জানা যায়, সেই সময় ব্রিটিশরা নিজেদের ঘরেকে দুটি ভাগে ভাগ করে, এই দুটি ভাগের নাম ছিল, বম্বে সাইড আর বেঙ্গল সাইড । 



এর কারণ হিসেবে বলাহয় পাখার দড়ি টানে যে দিকে দুলতো তার নাম ছিল বম্বে সাইড, আর দড়ি ছেড়ে দিলে পাখা যেদিকে দুলতো তার নাম বেঙ্গল সাইড ‌। মৌসুমী বায়ুর যাতায়াত পথের নাম অনুসারে এই নাম ।   


কিন্তু এই সব পাঙ্খাপুলারদের অনেক শোষণ করেছিল সেই সময়ের ব্রিটিশরা সেই গল্প বলবো অন্য একদিন । 


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - Times of India, wikipedia

https://irabotee.com/tana-pakhar-golpo/


https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/pankha-pullers-of-kolkata




 

Comments