কলকাতার ট্যাক্সি !

কলকাতার ট্যাক্সি

 

সিনেমায় বা ওয়েব সিরিজ়ে বা YouTube vlog channel গুলিতে কলকাতাকে যখনই দেখানো হয় প্রথমেই আসে কলকাতার বিখ্যাত হলুদ ট্যাক্সি ।
কলকাতার ট‌্যাক্সি ব্যাপারে বলার আগে একটা দেখে নেওয়া যাক কেরকম,গণপরিবহন জন্য কোন যানবাহন ব্যাবহার করা হতো, ইতিহাস বলছে কুড়ি শতকের শুরুর দিকে সারা বিশ্বে বিভিন্ন শহরে, ট্যাক্সি ছড়িয়ে পড়ে। 17 শতকের শুরুর দিকে লন্ডন এবং প্যারিস হ্যাকনি ক্যারেজ পরিষেবা  চালু হয় । এগুলি ছিল ঘোড়ায় টানা ট্যাক্সি । ভাড়া নিয়ে গন্তব্য পৌঁছে দেওয়া জন্য, প্রথম ছিল হ্যাকনি কোচ । এই পরিষেবা টি প্রথম চালু হয় লন্ডনেই । সরাইখানার  কর্মচারীদের জন্য প্রথম  বার গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছিল, 1625 সালে। আর 1636 সালে মেপেল ইন এর বাইরের স্ট্র্যান্ডে ছিল হ্যাকনি ক্যারেজ।
তার আগের বছর অর্থাৎ 1636 সালেই ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে হ্যাকনি ক্যারেজ এর বিল পাস হয়ে গেছিল । 1637 সালে প্যারিসে নিকোলাস সভেজের হ্যাকনি ক্যারেজের মতই একটা পরিষেবা শুরু করেছিল । আর এই যানবাহন গুলি কে বলাহত, ফিয়াক্রের । 

হ্যাকনি ক্যারেজ


এরপর আরো একটা গাড়ি আসে, এই গাড়ি গুলি হ্যাকনি ক্যারেজ গুলির থেকে যথেষ্ট উন্নত ছিল। এই গাড়ি গুলির ডিসাইন করেন, নিউ ইয়র্কের একজন স্থপতি নাম জোসেফ হ্যানসম ।

হ্যানসম ট্যাক্সি 


 এই ক্যারজ গুলি দ্রুত ছিল আর এই গাড়ি দুচাকার ছিল। আর এই ট্যাক্সি ক্যারেজ গুলি আগের ক্যারেজের তুলনায় অনেক হালকা ছিল, সেই জন্য একটা ঘোড়া খুব সহজেই টেনে নিয়ে যেতে পারতো ।
হ্যানসম আসল ডিসাইন টি আরো অনেকে বিশেষ করে, জন চ্যাপম্যান আরো আধুনিক ও উন্নত করেছিলেন, কিন্তু হ্যানসম নামটি ধরে রাখা হয়েছিল । এই হ্যাকনি ক্যারেজ আস্তে আস্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শহর গুলি তে আর একই সাথে ইউরোপের বিভিন্ন শহর গুলিতে বিশেষ করে প্যারিস, সেন্ট পিটার্সবার্গ ও বার্লিন এ ছড়িয়ে পড়ে । এরপর উনিশ শতকের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক এর ক্যাব বা ট্যাক্সি চলতো। মনে রাখা দরকার ভাড়া বিনিময়ে কিন্তু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিত এই গাড়ি গুলি। 1897 সালে প্রথম মটর চালিত ট্যাক্সি ছিল ডেমেলার ভিক্টোরিয়া।
এই বিশ্বায়নের যুগে পেট্রল বা ডিজেল জন্য যে বায়ু দূষণ হচ্ছে, সেই জন্য এখন ইলেকট্রিক গাড়ির প্রচলন হচ্ছে, কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয় 19 শতকে ব্যাটারি চালিত ট্যাক্সি পাওয়া যেত ।

সেই সময়ের ইলেকট্রিক ট্যাক্সি


 ওয়াল্টার বার্সি নামে একজন লন্ডনে, এইরকম ট্যাক্সির ডিজাইন তৈরি করেছিলেন এবং 1897 সালের 19 আগস্ট লন্ডনের রাস্তায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
এই ট্যাক্সি গুলিকে একটি নামে ডাকা হতো , "হামিংবার্ডস ট্যাক্সি" কারণ হিসেবে বলাহয় এই ট্যাক্সি যখন চলতো, তখন একটি শব্দ হতো । সেই জন্য এই নাম ।

আবার বলা হয় সেই বছরেই নিউ ইয়র্কে স্যামুয়েল ইলেকট্রিক ক্যারজ এবং ওয়াগন কোম্পানি 12 টি হ্যানসম ক্যাব বা ট্যাক্সি চালায়। 1898 সাল পর্যন্ত এই কোম্পানি টা 62 টি ক্যাব চালায় ।
ট্যাক্সি গুলো তে কিন্তু মিটার বসানো থাকে, হ্যাঁ Ola কিংবা Uber থাকে না কিন্তু হলুদ ট্যাক্সি তে লাগানো থাকে। এই ট্যাক্সির মিটার গুলোর কাজ হলো দূরত্বের সময় ঠিক করে একটা সঠিক ভাড়া নির্ধারণ করা । এই ট্যাক্সি মিটার আবিষ্কার করেন একজন জার্মান 1991 সালে নাম উইলহেলম ব্রুহেন । গ্যাসলিন চালিত 1899 সালে প্যারিস এবং লন্ডনে । নিউইয়র্কে ট্যাক্সি ক্যাব গুলি ফ্রান্স থেকে আমদানি করা হতো।
এই ট্যাক্সি গুলো আমদানি করাতেন হ্যারি এন অ্যালেন , ইনি ছিলেন অ্যালেন কিংস্টন মোটর কার কোম্পানির মালিক । কোম্পানির গাড়ি গুলি তৈরি হতো ব্রিস্টলে, ব্রিস্টল ইঞ্জিনিয়ারিং এ । 1908 সালে বলা যেতে নিউইয়র্কের প্রথম ট্যাক্সি উৎপাদন করা হয় । এই ট্যাক্সি গুলির ডিজাইন করেছিলেন ফ্রেড ই. মোসকোভিক্স , ইনি আবার ডেমেলার ভিক্টোরিয়া ডিজাইন করেছিলেন। লক্ষ্যনিয় যে নিউইয়র্কে ট্যাক্সি গুলির রং আমাদের কলকাতার ট্যাক্সি মতো হলুদ । এই হলুদ রং টি করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ব্রিস্টল ইঞ্জিনিয়ারিং মালিক অ্যালবার্ট এফ রকওয়েলের স্ত্রী, এই হলুদ রঙের জন্য ট্যাক্সি গুলি দূর থেকে দেখা যাবে। বিশ শতকের শুরুর দিকে থেকে সারা বিশ্বে ট্যাক্সি পরিষেবা শুরু হয়ে যায় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ট্যাক্সি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ছিল। জানা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্যারিসের ট্যাক্সি মার্ন অঞ্চলে যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 1914 সালের 7 সেপ্টেম্বর গভর্নর জোসেফ গ্যালিনি পঞ্চাশ  কিলোমিটার দূরে সৈন্যদের নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাই 600  ট্যাক্সি ভাড়া করা হয়ছিলো, হাতে সময় খুব কম ছিল 24 ঘন্টার মধ্যে ছয় হাজার সৈন্যকে সরানো হয়েছিল সেই ক্ষেত্রে ট্যাক্সি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। প্রতিটি ট্যাক্সিতে পাঁচজন করে সৈন্য ছিল, চারজন পিছনে ও একজন ড্রাইভারের পাশে। এইভাবে বসানো হয়েছিল। যে সামনে ট্যাক্সির আলো অনুসরণ করতে বলা হয়েছিল এইভাবে জার্মান সেনিবাহিনীকে পেছনে সরিয়ে দিয়েছিল ফরাসি সৈন্যবাহিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। এছাড়া আহত ও শরণার্থীদের বহন করার জন্য ট্যাক্স চালানো হয়েছিল। সেই ক্ষেত্রে ট্যাক্সি মিটার ও চালানো হয় নিয়ম অনুযায়ী, সেই জন্য ফরাসি কোষাগার থেকে ভাড়া পরিষদ করার জন্য খরচ হয়েছিল 70, 012 ফ্রাঙ্ক। আরো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ট্যাক্সি। 

এবার আসা যাক আমাদের প্রিয় কলকাতার ট্যাক্সির কথায়।  কলকাতায় প্রথম ট্যাক্সি চলে 1906 সালে তখন ( ট্যাক্সির রং হলুদ ছিল না ) । চৌরঙ্গীতে ফ্র্যাঙ্ক রস কোম্পানির ওষুধের দোকান যেখানে সেখানেই ছিল ফরাসি শেভিজাঁ কোম্পানির অফিস, এই কোম্পানি মালিক ছিলেন, মাইকেল সেভাডিজান।

তারাই প্রথম কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি এনেছিল । জানলে অবাক হতে ট্যাক্সির ও হেলপার ছিল , ড্রাইভারের পাশে জায়গাটি ছিল হেলপারের । কিন্তু হঠাৎ ট্যাক্সিতে হেলপার প্রয়োজন পরলো কেন ? প্রথমদিকে ট্যাক্সি চড়তো ব্রিটিশরা আর বড়োলোক মানে উচ্চবিত্ত বাঙালিরা, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ে মার্কিন সেনা বাহিনী কলকাতায় আসে, এবং তারাও ট্যাক্সি চড়তো। 1944 সালে এক মার্কিন সেনা সঙ্গে ঝগড়া লেগে যায়, ট্যাক্সি চালকের, রাগে ট্যাক্সি চালক মেরেই ফেলেন ঐ মার্কিন সেনা, আর তারপর থেকেই ট্যাক্সি তে হেলপার রাখা শুরু করে শেভিজাঁ কোম্পানি। এদের কাজ ছিল ড্রাইভের কে নিরাপত্তা দেওয়া। বিশ্বযুদ্ধের পরে অবশ্য আর হেলপার দেখা যায় নি ।
তখনকার ট্যাক্সিগুলিতে দুজন যাত্রী যেতে পারতো এখন আমরা  ট্যাক্সি বলতে যেই গাড়িগুলিকে দেখি সেগুলো কিন্তু তখন ছিল না তখন ছিল দুটো সিলিন্ডার যুক্ত charron গাড়ি । 



সেই সময় থেকেই ট্যাক্সিতে মিটার ছিল, আর প্রতিমাইলে ভাড়া ছিল আট আনা, প্রত্যেক সিকি মাইলের জন্য দু আনা । এই ট্যাক্সি যেত চৌরঙ্গী থেকে দমদম, ব্যারাকপুর, বজবজ আর এই ট্যাক্সি গুলির রং ছিল টকটকে লাল । এ সময়ে ট্যাক্স সেই সময় জনপ্রিয় ট্যাক্সি ছিল A কোম্পানির ট্যাক্সি, কারণ ট্যাক্সিগুল প্রত্যেকটারই নাম্বার শুরু হতো A দিয়ে । এই ট্যাক্সিগুলি রাস্তায় নামিয়ে ছিল ইন্ডিয়ান মোটর ট্যাক্সি ক্যাব এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এই কোম্পানির 80, 90 টা ট্যাক্সি ছিল আর এই ট্যাক্সিগুলি চালক ছিল বাঙালি, এদের মান ও ছিল ভালো আর সাথে ছিল কমিশন। কিন্তু আস্তে আস্তে এই চালকদের মধ্যে গাফিলতি, যখন তখন কাজে না আসা, মদ খাওয়া এইসবের জন্য বাঙালি চালকের জায়গা নেয় শিখ ড্রাইভার রা, ( আমার স্যার মনে করেন শিখ ট্যাক্সি ড্রাইভাররা অনেক ভালো। )



1957 সালে হিন্দুস্তান মোটর তৈরি করে এম্বাসেডর গাড়ি মানে এখন আমরা যাকে ট্যাক্সি হিসেবে চিনি, এই ট্যাক্সিগুলোতে অনায়াসে চারজন বসে যেত এমনকি মালপত্র নিয়ে যায় নিয়ে যাওয়া যেত এই ট্যাক্স এগুলি মধ্যে। বছরের মধ্যেই এই মডেলটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তুমি এই ট্যাক্সিগুলি রং ছিল কালো এবং হলুদ । রংয়ের মধ্যে একটা গল্প আছে কালো ট্যাক্সি চলত শুধুমাত্র শহরের মধ্যে আর শহরের বাইরে যেত হলুদ ট্যাক্সি । 

কলকাতার কালো ট্যাক্সি

সব ট্যাক্সি হলুদ হয়ে যায় কালো ট্যাক্সি হয়ে তখন হয়ে গেছিল ক্লাসিক । ১৯৫৮ তে এম্বাসেডর ট্যাক্সি অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এখনো অ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সি কলকাতার রাস্তায় চলে, তবে এখন অ্যাপ ক্যাবের ভিড়ে এই ট্যাক্সিগুলি প্রায় হারিয়ে গেছে । 


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://bengali.indianexpress.com/photos/kolkata-news/story-of-kolkata-yellow-taxi/


https://inscript.me/yellow-taxis-still-rule-kolkata-streets


https://prohor.in/history-of-yellow-taxi-in-kolkata


https://www.jiyobangla.com/bn/news/yellow-taxi-the-signature-of-great-kolkata

Comments