কলকাতা ও নাটোরের প্রেমপত্র !

রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা ও তার লেখা চিঠি 


 আজকে প্রেমের গল্প বলবো সেখানে কোনো  খলনায়ক নেই, সাধারনত প্রেমের গল্পে খলনায়কের চরিত্র থাকলে গল্পটি জমে ভালো কিন্তু আজকে গল্পে কোন খলনায়ক যদি একান্তই খলনায়ক হিসেবে কাউকে জোর করে বাছা হয় তাহলে, সেটা হবে দূরত্ব। তবে দূরত্বকে খলনায়ক  হিসাবে বলা যায় না , কারণ যদি দূরত্বই না থাকতো তাহলে চিঠি লেখা হতো না আর সেগুলো উদ্ধার করা যেত না। তাই দূরত্বে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আর ভাবতে অবাক লাগে সেই চিঠি এবং কালি ভালো ছিল যে ১০০ বছর পরেও সেগুলি পড়া যাচ্ছে। ইন্দুপ্রভা ও মহেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী প্রেম কথা পড়লে সত্যি চমকাতে হয় । এই কতইনা কবিতার পাওয়া যায় ইন্দুপ্রভার সিন্দুক থেকে , এমনকি দীঘাপাতির আর আশপাশে গ্রাম থেকেও রাজবংশের ব্যবহৃত বিভিন্ন বাসনপত্র উদ্ধার হয়েছে । সেই জন্য মূল গল্পে যাওয়ার আগে একটু চিঠির ইতিহাস টা একটু জেনে নেওয়া প্রয়োজন। 


চিঠি নিয়েও কয়েকটি কথা বলে রাখা দরকার, এই চিঠি শুরু কিভাবে হয় ? ইতিহাস বলছে, মিশর সুমেরু রোম ও ভারতে চিঠির প্রচলন হয় । প্রত্নত্ববিদরা গুহায়, পাথরে খোদাই করা চিঠি পেয়েছেন। বলাহয় চিঠিতে সেই সময় ছিল অভিজ্ঞতা, পাঠ চর্চা ও এমনকি খবর পাঠানোর রুপ ছিল । তবে কখন চিঠি শুরু হয়?  সেক্ষেত্রে বলা যায় মেসোপটেমিয়ায় গুহা চিত্রে, মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতো বিভিন্ন কিছু এঁকে । তীর ধনুকের ছবি এঁকে বোঝানো হতো যুদ্ধের ছবি । এইসব কে বলা হয় পিক্টোগ্রাম, এই পিক্টোগ্রাম ছিল চিঠির পূর্ব পুরুষ। আরো জানা যায় চিঠি, লেখার মাধ্যমে রাজা রা অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কুটনৈতীক সম্পর্ক রাখতো । যুদ্ধে কোনো খবর পৌছানো সেটাও জানানো সেই চিঠির মাধ্যমে। পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে দেয়া হতো সেই চিঠি পৌঁছে যেত নির্দিষ্ট স্থানে। সেই জন্য পায়রা কে রিতিমত ট্রেনিং দেওয়া হতো । শোনা যায় শের শাহ এর আমলে ডাক বিলি প্রথা চালু হয়, ঘোরায় চড়ে এই ব্যাবস্থা চালু হয়েছিল।

আবার ঐতিহাসিক মনে করেন যে পারস্য সাম্রাজ্যে ডাক ব্যাবস্থা চালু হয়েছিল, তবে এখনো অব্দি এর সাপেক্ষে প্রমান পাওয়া যায় নি । চীনের জিয়াং বা সাং রাজবংশের দাবি যে চিঠি বা ডাক ব্যাবস্থা তারাই এনেছিল । চীনের তাং রাজবংশের ইতিহাস বলছে 1639 টি পোস্ট অফিস এবং এবং কুড়ি হাজারেরও বেশি ডাক পিওনের খোঁজ পাওয়া যায় তাদের রাজবংশের সময়ে। আবার 220 খ্রিষ্টপূর্বে হ্যান রাজবংশীয় লি পুনরায় ডাক ব্যাবস্থা চালু করেন, অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় হ্যান রাজবংশের আগে ডাক ব্যাবস্থা চালু ছিল। 62 খ্রিষ্টপূবে রাজা আগস্ট কাসারের সময় নাকি ডাক ব্যাবস্থা কে বলা হত কারসাস পাবলিকাস । ভারতের ডাক ব্যাবস্থা কে শের শাহ নতুন করে গোড়ে তোলেন, আবার যীশু খ্রীষ্টের জন্মের 2400 বছর আগে মিশরের ফারাও রা দূতের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করতো বলে জানা যায় , অন্যদিকে চেঙ্গিস খাঁ তার অধিকৃত রাজ্য গুলির সঙ্গে পায়রার মাধ্যম যোগাযোগ রাখতেন, মানে সেই পায়রার পায়ে চিঠির মাধ্যমে আরকি । তবে বর্তমান কালে চিঠির ব্যাবহার খুব কম হয়ে গেছে শুধু মাত্র চাকরির চিঠি কিংবা আইনি নোটিশ ছাড়া চিঠি প্রায় উঠেই গেছে বলা যেতে পারে। অত্যধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বিশেষ করে মোবাইল ফোন এর অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে ।



" সচঞ্জল নিল জল 

বৈইছে কি ছলমল 

জ্যোৎস্না মাখিয়ে গায়ে 

সমুচ্চল নিরফল "  


আজ থেকে প্রায় একশো কিংবা একশো কুড়ি বছর আগে কলকাতার সাথে জড়িত নাটরের চিঠি চালাচালির খেলা ‌। হ্যাঁ শুনলে অবাক হতে হয়, এই চালাচালির চলতো দিঘাপাতিয়ার  রাজকুমারী ইন্দুবালা ও কলকাতা নিবাসী মহেন্দ্র কুমার চৌধুরীর সঙ্গে।

দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি


তৎকালীন নাটোরের দিঘাপাতিয়ার  রাজা প্রমথোনাথ তার মেয়ে রাজকন্যা ইন্দুপ্রভার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল  তারই এক পরিচিত ছেলের সঙ্গে । সেই ছেলের পড়াশোনার বন্দোবস্ত করলেন রাজামশাই স্বয়ং নিজেই । সেই পরিচিত পুরুষের আনাগোনা চলতো রাজমহলে কিন্তু তাকে কখনো দেখেননি ইন্দুপ্রভা । অনেক ছোট বেলায় মা কে হারিয়েছিল রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা , তার দিদি তাকে মানুষ করে ছিলেন, কিন্তু সেই দিদি ও একদিন তাকে ছেড়ে চলে গেলেন । তবে সেই পুরষটি র আনাগোনা লেগে থাকত বাড়িতে, বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও সুপুরুষটির সঙ্গে, তবে ইন্দুপ্রভা তাকে কখনো সামনা সামনি দেখেনি । সেই বন্ধুত্ব গড়ালো প্রেমের দিকে 

এবং পরবর্তীকালে অজানা কারণ

( সামনাসামনি দেখে নি ইন্দুপ্রভা ) পুরুষের নাম ছিল মহেন্দ্র। এত প্রিয় বন্ধু হওয়ার সত্তেও তাকে কাছে পেলেন না ইন্দুপ্রভা‌ । তিনি তখন কলকাতার দুঁদে উকিল,  ভবানীপুর ছিল তার বাড়ি। ফলে চিঠিতেই চলতে থাকলো মান-অভিমানের পালা, কারণ 

নাটোরে না গেলে দুজনের কাউর চোখের শান্তি হচ্ছে না ‌। সেই জন্য 

চিঠির মাধ্যমে দুঃখ বঞ্চনা অভিমানের পালা চলতো। চিঠিপত্র তেই চলতো দুঃখ, গঞ্জনা, কবিতা এই সব ।

আর কলকাতাতে সেই সব চিঠি পেয়ে কেঁদে উঠত কলকাতার সেই দুঁদে উকিল এর মনও, মহেন্দ্র প্রতিউত্তরে চিঠি লিখতো প্রথমে প্রিয়তমে শেষে তোমার মহেন্দ্র।

আর মাঝের টুকু ব্যক্তিগতই থাক । রাজকুমারী ও তাঁর রূপকথার রাজকুমার এর মধ্যে। 

রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা 

এই চিঠি গুলো একসাথে রাখলে দেখা যাবে প্রায় 285টি চিঠি, অসংখ্য কবিতা, অনেক গুলো বই । এইসবের মধ্যে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার আত্মজীবনী ও রয়েছে । তবে 1956 সালে জমিদারি প্রথা গেলে দিঘাপতিয়ার রাজবংশ চলে আসে কল্লোলিনী তিলোত্তমায় । কালের নিয়মে সবই হারিয়ে গেছে, কিন্তু দু তিন বছর আগে বাংলাদেশের আধিকারিকরা দিঘাপতিয়া রাজ বাড়িতে একটি সিন্দুক খুঁজে পেয়েছিল,

রাজমুকুট 

আর সেখানে পাওয়া গেছিল, থরে থরে সাজানো ইন্দুপ্রভার লেখা চিঠি, বিভিন্ন বই, মহেন্দ্র কুমার চৌধুরীর ব্যবহৃত দামি দামি পাথর বসানো মুকুট, হাতির দাঁতের বাঁটয়ালা বিভিন্ন জিনিসপত্র। ইন্দুপ্রভার দশটি ডায়রি পাওয়া যায়, রাজা ও রাণীর রুপোর ফ্রেম যুক্ত ছবি । আর সেই ছবির পিছনে নাম পাওয়া যায় ইন্দুপ্রভার ।

মহেন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর ব্যবহৃতি দোয়াত কলম সেই সব পাওয়া গেছে দিঘাপতিয়ার রাজ বাড়িতে। আরো জানা যায় ইন্দুপ্রভা কলকাতায় তখন ছিলেন, তিনটি ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছেন । দিঘাপতিয়া পাঠানো চিঠিতে গুলো তে কখনো শ্রীমতি ইন্দুপ্রভা দেবী আবার কখনো শ্রীমতি ইন্দুপ্রভা চৌধনী বলে লেখা পাওয়া গেছে । চিঠি গুলো খুব সুন্দর ভাবে খামে রাখা হয়েছিল এবং চিঠি গুলি রিতিমত পড়াও যায় । চিঠিপত্র গুলি বয়স একশো কুড়ি ।  আরো জানা যায় বাংলা সালের নিরিখে 1304 সাল মানে বঙ্গাব্দ নাগাদ দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ির প্রাইভেট সেক্রেটারি কাগজে মহেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী ইন্দুপ্রভার কলকাতার ঠিকানায় লিখছেন বারবার তাগাদা দিয়ে, খাম পাঠিয়েও ইন্দুর চিঠি পেতে দেরী হওয়ায় মহেন্দ্র তাঁর চিঠির শেষ বাক্য লিখছেন 'একবার কলকাতায় যেতে পারলে বাঁচি ' সেই সব চিঠি ইন্দুপ্রভার সিন্দুকে পাওয়া গেছে, এগুলি খুব যত্নো সহকারে রাখা ছিল । রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার ডায়রি থেকে জানা যায় তিনি রাজশাহী বসে ডায়েরি লিখেছেন।

বঙ্গাব্দ 1311 সালের নববর্ষের কথা উল্লেখ পাওয়া গেছে দিঘাপতিয়ার রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার ডায়রি থেকে, তখন রাজশাহী কে রামপুর লেখা হতো। আর ইন্দুপ্রভা বাংলা ও ইংরেজী দুটি তারিখ এবং কি বারে লেখা হয়েছে সেটার উল্লেখ রয়েছে। ও আর একটা কথা বলা হয়নি রাজা প্রমথোনাথ ছিলেন রাজবংশের চতুর্থ প্রজন্ম। 

আরে এখন আর এগুলো এখন নাটোরে সেই দিঘাপাতিয়ার রাজবাড়ির মিউজিয়ামে ।আর এই প্রেমিক প্রেমিকার সমুদ্র ভ্রমণে র কবিতা সাজিয়ে রাখা হয়েছে রাজবাড়ির দেওয়ালে 

দেড়শ বছর আগের লেখা বঙ্গপসাগর কবিতা বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। আর সেই কবিতা জুড়ে আজও ঝলমল করে ওঠে আসছে প্রেম। 


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://steemit.com/history/@binitabiswas/natore-princess-recovered-120-years-old-love-letter-with-photo


https://www.samoyiki.com/2021/09/17/17824/


https://bengali.momspresso.com/parenting/apanadera-bhalea-lagai-amara-anuprerana/article/induprbhaar-citthi?utm_source=AD_Whatsapp_Share


https://www.prohor.in/the-love-letter-from-nator-to-kolkata

Comments