কলকাতার প্রথম ডিটেকটিভ

কলকাতার প্রথম ডিটেকটিভ 

 

আর কদিন পরেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা মানে ফেলুদার গুরু ,
"লন্ডনে ফেলুদা" গল্পে ফেলুদা বেকার স্ট্রিটের সামনে দাড়িয়ে বলেছিল "গুরু তুমি ছিলে বলেই আমারা আছি"  হ্যাঁ অনেকেই বুঝে গেছেন শার্লক হোমসের জন্মদিন, হোমসিয়ান রা মনে করেন জানুয়ারি মাসের 6 তারিখে 1854 সালে শার্লক হোমস জন্মগ্রহণ করেন।


কলকাতার তখন আজকের মতো ছিল না, ইংরেজ তাদের সাধের ক্যালকাটা কে, তৎকালীন ইংরেজদের রাজধানী ছিল। একটু একটু করে লন্ডনের মত করে তুলেছিল । তবে রাত গুলো খুব ভয়ের ছিল তখনো গ্যাস বাতি কলকাতায় বসেলও খুব দূরে দূরে লাগানো থাকতো ।
অ্যামহার্ট স্ট্রিট পুলিশ স্টেশন থেকে মিনিটখানেক দূরে পাওয়া যায় এক মহিলার মৃতদেহ। কারণ যেখানে মৃতদেহ পাওয়া যায় সেখান থেকে নাকি অ্যামহার্ট স্ট্রিট পুলিশ স্টেশন আলো দেখা যাচ্ছিল।


এই মৃতদেহ দেখতে পায় এক টহলদার,
প্রথমে ঐ টহলদার প্রথমে বস্তা ভেবেছিল , কারণ তখন বেশ অনেক রাত , এত রাতে মৃতদেহ, তাও আবার মহিলার । এরপর জানা যায়, মৃতদেহটি একজন অ্যাংলো ইন্ডায়ান নাম হলো রোজ। আর যেভাবে মৃতদেহটি পড়ে ছিলো , সেটা থেকে অনুমান করা হয় , রোজ আততায়ীর হাতে থেকে বাঁচার জন্য দৌড়ার ছিল।


ব্যাস এইটুকুই । সময় টা ছিল 1868 এর পয়লা এপ্রিল। দিনের বেলায় লোকজন বাড়ির বেড়লেও রাত্রির বেলাতে কেউ বেশি বাইরে বেরত না । কয়েক বছর আগেই লর্ড ডালহৌসি কলকাতা পুলিশের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন। একটু একটু করে পুলিশ ব্যাবস্থাকে গোছাতে শুরু করেছে , তার মধ্যেই এই ঘটনা। জায়গায় জায়গায় এই ঘটনার কথা জানাজানি হয়ে গেল।
খবর কাগজ গুলো তে ঘটনার বিবরণ বের হল। মেয়েটির গলা কাটা , চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, একটি হাত কোমরে সাথে পিছনে বাঁধা। এই সব ঘটনা গুলো পড়ে সাবাই যেমন, শিউরে উঠে ছিল সবাই , ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল এটা খুন ! কিন্তু এই খুন নিয়ে এত হৈচৈ কেন ? খুন তো আগেও হয়েছে, গুন্ডা ডাকাতে মারামারি, রাজনৈতিক হত্যা , অনেক সময় বেহেড মাতালদের দেহ পাওয়া যায়। 

কিন্তু এভাবে কলকাতার রাজপথে মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তৎকালীন পুলিশ তদন্ত কিছুই   এগোতে পারিনি, বিরক্ত হয়ে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ, তার সহকারী কে চিঠি লিখলেন যে পুলিশ কিছুই করতে পারছে না। 

স্টুয়ার্ট হগ


তিনি একটি দল গঠনের নির্দেশ দিলেন, এবং এই দলের নেতৃত্ব দেন হগ সাহেবের প্রিয় অফিসার রিচার্ড রীডকে ‌। 

রিচার্ড রীডের ছিল তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ক্ষুরধার বু্দ্ধি, এবং সাহসী (একজন পারফেক্ট গোয়েন্দা যেই গুন গুলো থাকা দরকার ) এই জন্যই তিনি ছিলেন হগ সাহেবের প্রিয় অফিসার। হ্যাঁ যেটা বলছিলাম, শুরু হলো অ্যামহার্স্ট স্ট্রিট হত্যা রহস্যের তদন্ত ‌। 

তদন্ত হাতে নিয়েই রীড সাহেব তরুণীর পরিচয় জানার চেষ্টা করলেন তার জন্যই পুলিশ রোজ নাম টা জানতে পেরেছিল, আরো জানা যায় তরুণী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। রীড সাহেব অনুমান করেছিলেন এই অসম্ভব সুন্দরী মহিলা বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি থেকে বাইস, সেই জন্য রোজ কে তরুণী বলা হয়েছে। 

তরুণী মৃতদেহ দেখে কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করলেন রীড সাহেব, প্রথমত তরুণী পা কোনো জুতো বা চটি ছিল না, কিন্তু পায়ের তলা ছিল পরিষ্কার তাহলে কি রাস্তায় হাঁটতে ছিল না এই তরুণী, নাকি অন্য কোথায় খুন করে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে ? দ্বিতীয় সম্ভবনা টি বেশি, দ্বিতীয়তঃ যেভাবে গলা কাটা হয়েছে, তরুণীর দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিশেষ অস্ত্র ব্যাবহার করা হয়েছে সেটা সবার কাছে থাকা সম্ভব না । 

এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো অ্যামহার্স্ট
স্ট্রিট হত্যা কান্ডেই প্রথম ফটোগ্রাফিকে তদন্ত মধ্যে যুক্ত করা হয়। 

 কিছু দিন আরো পাঁচ জন মহিলারা খুন হয়েছিল
সাল টাও ছিল 1868 , এই পাঁচ ছিল বারবণিতা। তাহলে কি রোজ খুনে সঙ্গে এই ঘটনা গুলোর কোনো যোগাযোগ আছে ? । 

রীড সাহেব আরো একটা কাজ করলেন যা আগে কখনো হয়নি যা আগে কখনো হয়নি, তিনি রোজ একটা ছবি তুলে সব যায়গায় ছিড়েয়ে দিলেন। বেশ কয়েক সপ্তাহ চলে গেল কিন্তু, এই খুন সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া গেল না, সবাই প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু, রীড সাহেব ধৈর্য হারালেন না ।

 হঠাৎ একদিন আলো সন্ধান পাওয়া গেল, এক সাহেব এলেন থানায় নাম মিঃ হ্যারিস , থাকেন বৈঠকখানা রোডে। তিনি তরুণী চিনতে পেরেছেন, পুরো নাম ও বললেন তরুণীর রোজ ব্রাউন , খ্রিষ্টান এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং রীড সাহেব বয়সের ব্যাপারটাও ঠিক অনুমান করেছিলেন ‌। 

আরো একটা ব্যাপার জানতে পারলেন রোজ ও বারবণিতা ছিল। এই মিঃ হ্যারিস আরো জানালেন এই রোজ ব্রাউন কে  তিনি নাকি মাধবচন্দ্র দত্ত বলে একজন সঙ্গে বেশ কয়েক বার দেখেছেন ।
রীডে সাহেবের মনে হলো ডাল মে কুছ কালা হ্যাঁ । 

খোঁজ পড়লো এই মাধবচন্দ্র দত্তের , তবে খুব কষ্ট করতে হয়নি এই ব্যাক্তির ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য। মাধবচন্দ্র দত্তের দোকান বৌবাজার, পুলিশ হানা দিলো বৌবাজার এ আর দোকানেই পাওয়া গেল মাধবচন্দ্র কে , যথারিতি গ্রেফতার করলো মাধবচন্দ্র কে । এখানে উঠে আরো নতুন তথ্য, রীড সাহেব জানতে পারলেন যে, রোজ ব্রাউন নাকি প্রায় হাওড়া তে যাতায়াত করতো, হাওড়ার কোথায় যেত রোজ ?
জানা গেল হাওড়া একটা বাড়িতে খুব যেত রোজ ব্রাউন ।

 কার বাড়ি ? জানা গেল কিংসেল নামের এক গুন্ডা বাড়ি, এই কিংসেলর সঙ্গে নাকি সম্পর্ক ছিল রোজ এর , একটা সময় ওখানেই ঐ বাড়িতে থাকতো রোজ ব্রাউন। তবে খুন হওয়ার আগে ঐ বাড়িতে থেকে চলে আসে রোজ । তবে খুন হওয়ার আগে রোজের ভয় ছিল, কিংসেল তাকে বাঁচাত দেবে না । 

খবর পাওয়া মাত্রই হাওড়ায় হানা দিল কলকাতা পুলিশের একটি দল , হাওড়ায় কিংসেলর বাড়িতে পুলিশ গিয়ে দেখলো পাখি উড়ে । 

খালি ঘরের মধ্যে একটি জামা , মেয়েদের জামা কাপড় পাওয়া গেল এর থেকে প্রমান হয় যে রোজ ব্রাউন ওখানে থাকতো । আর ঐ মেয়েদের জামাকাপড়ে রক্তের দাগ ! অনেক খোঁজাখুঁজি পরে ঘরে আর কিছু পাওয়া যায়নি, শুধু একটি চাবি ছাড়া। এরপর আরো গাঢ় সন্দেহ হয় কিংসেলর উপর, রীড সাহেব কিন্তু সব যায়গায় জাল ছড়িয়ে রেখে ছিল, কিংসেল কে ধরার জন্য। কিন্তু কিংসেল কিভাবে যেন হাওয়া হয়ে গেল । তবে রীড সাহেব কিংসেলকে ধরতে পারে ছিল কি না, সেটা জানা যায় নি ।

তবে এই তদন্ত কিন্তু রীড সাহেব কে অন্য একটা স্তরে পৌঁছে দিয়েছেল । আর পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ বুঝলেন কলকাতা পুলিশের বাইরেও গোয়েন্দা বিভাগ কাজে লাগাবেন। 1868 সালে নভেম্বর মাসে তৈরি হয়, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ।



এর ঠিক পাঁচ বছরের মাথায়, 1873 সালে কলকাতার গোয়েন্দা বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট হন রিচার্ড রীড ।
বলা হয় 1887 সালে রীড সাহেব একটি বই লেখেন "Every man his own detective" নামে একটি বই লেখেন । এই বই তে যায়গা রোজ ব্রাউন এর কেস টি ‌।

রীড সাহেবর বই  


ঠিক সেই বছরেই স্যার আর্থার কোনান ডয়েলে র বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের প্রথম গল্প The study in scarlet প্রকাশ পায় ।

 এই সুপার ইনটেনডেন্ট পদে কিন্তু এক বাঙালি ও গোয়েন্দা ছিল পুলিশ ছিল তিনি আর কেউ নন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, চিনি তার বিভিন্ন কেসে অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন নাম দারোগার দপ্তর । এই বই এই জায়গা পেয়েছিল প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার এর কেস সমাধান করেছিলেন এবং গ্রেফতার করে শাস্তি ও দিয়েছিলেন।
কলকাতার প্রথম ডিটেকটিভ  কিন্তু রীড সাহেব ।


ছবি সূত্র - internet

তথ্য সূত্র - https://www.livehistoryindia.com/story/people/amherst-street-murder

 

 https://www.anandabazar.com/rabibashoriyo/life-story-of-investigator-richard-reed/cid/1293430

https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/why-and-how-kolkata-police-got-its-detective-department


https://khabarerkagaj.com/index.php/2021/05/24/calcutta-police-detective-department-formed-in-1868/

Comments