কলকাতার চার্চনামা !



 বড়দিন উপলক্ষে কলকাতার প্রাচীন চার্চ গুলোতে চলুন ঘুরে আসি, আর জেনে নি কিছু ইতিহাস।


 বাংলা ক্যাথিড্রাল

সেন্ট মেরিজ চার্চ 


কলকাতার বাঙালি খ্রিস্টানদের নিজস্ব ক্যাথিড্রাল ছিল , যার নাম সেন্ট মেরিজ চার্চ । এলগিন রোডে ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটির কলেজের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে, বাংল ক্যাথিড্রাল । আচ্ছা এই ক্যাথিড্রাল কেন বাংলা ক্যাথিড্রাল নামে পরিচিত? সেটা ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যাবে, কারণ সবকটি ফলক ঝরঝরে বাংলায় লেখা। 1889 সালে তৈরি হয় এই চার্চটি, এই চার্চটির বেশির সদস্য ছিল বাঙালি আর এই জন্য সেন্ট মেরিজ চার্চ বাঙালি ক্যাথিড্রাল নামে পরিচিত। এই ক্যাথিড্রালের পরিকল্পনা করেছিল রেভারেন্ড হরিহর সান্যাল । তিনি প্রথম যিনি বাঙালি খ্রিষ্টানদের জন্য বড় গির্জা গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন । তিনি নিজেই জমি ও টাকা জগোড় করেন, কিন্তু জনসাধারণের এই গির্জা খুলে দেওয়ার আগেই রেভারেন্ড হরিহর সান্যাল মারা জান । এই ক্যাথিড্রালের দায়িত্ব নেন রেভারেন্ড অঘোর নাথ ব্যানার্জী , 16 ফেব্রুয়ারি 1889 খুলে দেওয়া হয় জনসাধারণ জন্য । ্

ভেতরের কিছু ছবি


জোড়া গির্জা 

কলকাতার একটি আছে লোকমুখে যার নাম হয়েছে জোড়া গির্জা, কারণ চার্চটির দুটি চুড়া আছে । আসল নাম সেন্ট জেমস চার্চ । 1826 সালে লেবুতলা লেনে এই চার্চ তৈরি হয়, প্রথমে এই চার্চের কোনো চুড়া ছিল না সেজন্য এই গির্জাটিকে স্থানিয়রা নেড়া গির্জা বলতো। আবার এই গির্জাকে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে, বলা হয় ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মধ্য কলকাতায় হঠাৎ করে খৃষ্টানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেই জন্য একটি আলাদা চার্চের দরকার হয়ে পড়ে, সেই জন্য চার্চে বানানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।

সেন্ট জেমস চার্চ 

একটি জমি ঠিক করা হয় যেখানে চর্চাটি তৈরি হবে, সেই জমিতে অবশ্য একটা বাগান বাড়ি ছিল, পরে জানা যায় ঐ জমিতে একটি পুকুর ছিল সেইটা বুজিয়ে বাগান বাড়ি তৈরি হয়েছে, এই সব কথা অবশ্যই চার্চ কর্তিপক্ষ জানতো না ‌। চার্চ তৈরি করা শুরু হলে চার্চ মাটিতে বসে যেতে থাকে, ফলে চার্চের কাজ বন্ধ করে দেয় কর্তিপক্ষ এমনকি চুড়া পর্যন্ত বানানো হয়নি । এর মধ্যে উইপোকার আস্তানা হয়ে যায় চার্চটি, এরপর মহাবিদ্রেহের পরের বছর 1858 সালে 22 আগষ্ট চার্চটি ভেঙে পড়ে , চার্চ কতৃপক্ষে ঐ জমিতে আবার চার্চ তৈরির সাহস করেনি । সেই জন্যই আবার চার্চে তৈরির জন্য নতুন জমি খোঁজ শুরু হয় , জমি খুঁজতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন Archdeacon Pratt. আজকের এ.জে.সি বোর্ড রোডে মিস্টার কোটসের বাগানবাড়ি সাথে কিছু জমি ছিল সেখানেই তৈরি করা হয় নতুন চার্চ । কতৃপক্ষের মাথায় ছিল যে আগের গির্জায় কোনো চুড়া ছিল না, তাই নতুন চার্চ বানানোর সময় একটার বদলে দুটো চুড়া বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাই লোকের মুখে চার্চের নাম হয়ে যায় জোড়া গির্জা।



মুরগিহাটা গির্জা

সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আগস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত পর্তুগিজ খ্রিষ্টানরা তাই এসেছিল এই সময় জোব চার্নক তাদের কে 10 বিঘা জমি দিয়েছিল, মোঘল সাথে তখন চার্নকের ঝামেলা চলছিলো । আবার আরো একটা তথ্য বলে জোব চার্নক আসার অনেক আগেই পর্তুগিজদের আধিপত্য ছিল সুতানুটি অনঞ্চলে , পর্তুগিজদের সাহায্যেই জোড় চার্নক বসবাস আরম্ভ করে। তার আগে খড়ের চালের তৈরি উপাসনালয় তৈরি হয় । 1693 সালে জোব চার্নকের মৃত্যুর পর পর্তুগিজদের ঘাঁটি সরিয়ে দিয়ে ইংরেজদের ঘাঁটি তৈরি হয় । পর্তুগিজদের মুরগিহাটা অঞ্চলে তৈরি করে নতুন চার্চ বা গির্জা।

Cathedral of The Most Holy Rosary


1797 সালে গির্জার ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এই গির্জা তৈরিতে খরচ হয় 90 হাজার , মার্গারেট ট্রেন্জ ষোলোস টাকা দিয়ে একটি চার্চ তৈরি করে, বলাহয় এইটা হল কোলকাতায় ইটের তৈরি প্রথম চার্চ। এই চার্চ এর নাম কিন্তু Cathedral of The Most Holy Rosary এই চার্চটি মুরগীহাটা চার্চ নামে পরিচিত। এই চার্চ এর নাম ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে এই চার্চ টি ব্লেসেড লেডি অফ দ্য রোজারিকে উৎসর্গ করার জন্য এই নামকরণ হয়েছে। 1799 সালে নভেম্বর মাসের 27 তারিখ জনসাধারণের জন্য চার্চ খুলে দেওয়া হয়। 


 লাল দিঘির গির্জা

কলকাতার আর্মেনিয়ানদের বলে নাকি কলকাতার খৃষ্টানদের ঠাকুর্দা। ব্রিটিশরা কলকাতার আসার বহু আগে, আর্মেনিয়ানরা কলকাতায় আসে, এবং তারাই প্রথম কলকাতায় চার্চ তৈরি করে , তাই বলা হয় তাদের চার্চ কলকাতায় তৈরি প্রথম চার্চ। লাল গির্জা প্রথম প্রেটেস্টান চার্চ। যখন রবার্ট ক্লাইভ যখন গর্ভানর জেনারেল মানে পলাশি যুদ্ধের পরে 1758 তে তিনি ডেকে পাঠালেন, জাকারিয়া কিয়ার্নান্ডার কে। ইনি ছিলেন একজন সুইডিশ মিশনারি । 1767 সালে তিনি নিজের খরচাতেই চার্চ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং শেষ হয় 1770 সালে। এই চার্চের পাশেই একটা দিঘি ছিল, বলাহয় ঐ দিঘিতে চার্চের লাল ছায়া পড়তো কারণ চার্চের রঙ ছিল লাল , আর তারপর থেকেই নাম হল লাল দিঘি তবে এই বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক আছে। আর দিঘিটা আর নেই।

Old Misson Church 

এই চার্চটির নাম ওল্ড মিশন চার্চ আর এন মুখার্জি স্ট্রিটে এখন দাড়িয়ে আছে এই চার্চটি । 1843 এক ঘটনা ঘটে এই চার্চে 9 ফেব্রুয়ারি এক তরুণ  “I sat in darkness, Reason’s eye Was shut, – was closed in me; – I hastened to Eternity O’er Error’s dreadful sea….” এই গানটা গাইছিলেন। তার বয়স তখন মাত্র 19 তিনি আর কেউ নন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। 



 সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল 

সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল


ব্রিটিশরা কলকাতায় বসবাস আরম্ভ করলে আস্থে আস্থে ইউরোপীয়দের সংখ্যা বাড়তে থাকে, ফলে সেন্ট জনস চার্চের উপাসনা করতে অসুবিধা হচ্ছিলো । 1819 সালে গভর্নর জেনারেল মারকুইস অফ হেস্টিংসের অনুরোধ এ নেইন ফোর্বস ক্যাথিড্রালের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেন। কিন্তু সেটা বাতিল করা হয় কারণ প্রচুর খরচ পড়বে বলে। কিন্তু বিশপ মিডিলটন ঠিক করে কোথায় তৈরি হবে ক্যাথিড্রালটি । নির্মাণ কাজ শুরু করার আগেই মারা যান বিশপ । এরপরের তিন বিশপ অর্থাৎ রেজিনাল্ড হিবার, টমাস জেমস এবং জন টার্নার নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই মারা যান । অবশেষে 1832 সালে বিশপ ড্যানিয়েল উইলসনের নেতৃত্বে ক্যাথিড্রাল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ‌। যেখান বলেছিলেন বিশপ মিডিলটন, এখন যেখানে ক্যাথিড্রালটি সেখানে নাকি আগে খুব বাঘ দেখা যেত । ক্যাথিড্রাল তৈরির ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন উইলিয়াম নেইন ফোর্বস ‌। নরউইচ ক্যাথিড্রালের আদলে অনুসারে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের একটি টাওয়ার ও চূড়া তৈরিতে সাহায্য করেছিল, সি.কে. রবিনসন। 1839 সালে এই ক্যাথিড্রালের ভিত্তি স্থাপন হয় এবং 1847 সালে 8 অক্টোবর । এই ক্যাথিড্রালটি তৈরি করতে খরচ হয়

4, 35, 669 টাকা। রানি ভিক্টোরিয়া রুপোর গিলটি করা দশটি পাঠিয়েছিলেন। 1847 সালের ভূমিকম্পে ক্যাথিড্রালটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরে আবার 1934 সালে কলকাতার ভয়ানক ভূমিকম্পে ক্যাথিড্রালের একটি সুউচ্চ চূড়াটি ভেঙে পড়ে , পরবর্তী কালে বেল হ্যারি টাওয়ারের অনুকরণে চূড়াটি পুনঃনির্মাণ করা হয়।

কলকাতার সবচেয়ে বড় ক্যাথিড্রাল এটি এবং এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো এপিসকোপাল গির্জা এটি । 

চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ ডলার্স

Our Lady of Dolours church


এটা কলকাতার আরও একটি পর্তুগিজ চার্চ। 1804 পর্তুগিজ  ব্যবসায়ী লুই ব্যারেটো বৈঠকখানা বাজার অঞ্চলে একটি চার্চ তৈরিতে উদ্যোগী হলেও তিনি আচমকাই মারা যান ফলে কাজ থমকে যায়। পরে 1809 সাল নাগাদ গ্রেস এলিজাবেথের সাহায্যে আবারও এই চার্চের কাজ শুরু হয়। এতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন ডিয়েগো পেরেরা, ফিলিপ লিল, চার্লস কর্নওয়ালিস প্রমুখ ব্যক্তিরা। 1810 সালে চার্চটি লেডি অফ ডলার্স-এর নামে উৎসর্গ করা হয়। বাইরে যতই শব্দ আর কোলাহল হোক না কেন গির্জার ভিতরটি শব্দ প্রতিরোধক হওয়ায় শান্ত থাকে। 


ছবি সূত্র - internet 

তথ্য সূত্র - https://prohor.in/st-merrys-church-kolkata#:~:text=%E0%A7%A7%E0%A7%AE%E0%A7%AE%E0%A7%AF%20%E0%A6%96%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%87%20%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%BF%E0%A6%A4%20%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%20%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9C,%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2)%20%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9C%E0%A6%A8%20%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A4%20%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%20%E0%A6%9B%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A5%A4

https://salilhore.wordpress.com/2020/10/02/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%AC%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A7%9C%E0%A7%8B-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9F/

https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/st-paul-s-cathedral-of-kolkata

https://dailynewsreel.in/murgihata-portuguese-church/


Comments